অস্তিত্ব সংকটে পোস্ট অফিস

মাকসুদুর রহমান পারভেজ ।।

হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যের চিঠিপত্র। অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে অনেক পোস্ট অফিস। হারিয়ে যেতে বসেছে কালি-কলম-মন এই তিনের সমন্বয়ের চিঠি। হারিয়ে যাচ্ছে হলুদ, নীল খামে প্রিয়জনকে কাগজে লেখার সেই আবেগ। শহর থেকে দেশের প্রত্যন্ত অজপাড়াগায়ে পৌঁছে গেছে প্রযুক্তির সেবা। যখন ইচ্ছে প্রিয়জনের সঙ্গে বার্তা আদান-প্রদানে চিঠির বদলে সবার ভরসা এখন নতুন নতুন প্রযুক্তি।

ফুরিয়ে গেছে ডাকঘরের মাধ্যমে চিঠি পাঠানো কিংবা টেলিগ্রাম সেবার প্রয়োজনীয়তা। অভিজ্ঞদের ধারনা, একটা সময় আসবে যখন ভাষা ও জ্ঞানের শৈলিতে সৃষ্টিশীল ভাবনায় লেখা চিঠির আবেগ, অনুভূতি কখনোই স্পর্শ করবে না বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির আলোয় বেড়ে ওঠা একটি ছেলে-মেয়েদের অনুভূতিতে।

একটা সময় ছিল যখন চিঠিই যোগাত বিনোদনের খোরাক। সাইকেলের বেল বাজিয়ে ডাক পিয়নের সেই হাক-চিঠি এসেছে চিঠি। এসব চিঠি ব্যথাতুর হৃদয়ে ঝড়াতো কান্না, কখনো করত উৎফুল্ল ­, আবার কখনো করত আবেগাপ্লুত । চিঠি লেখার বাক্য চয়ন, ভাষার প্রায়োগিক ব্যবহারের নান্দনিকতায়, স্নেহ ভালবাসার পূর্ণতায় অপার মমতা উঠে আসতো এক একটি চিঠিতে। প্রণয়ের চিঠি ছিল তারুণ্যের উচ্ছ্বাস হৃদয়ের আবেগের এক মধুময় পাঠশালা।

প্রেমিক হৃদয়ের আকুলতা-ব্যাকুলতা প্রতীক্ষার প্রহরের খুঁটিনাটি ভাষার মাধুর্যে শত ফুল দিয়ে গাঁথা একটি চিঠি হৃদয়ে জোগাত মধুময় শিহরন। মার্জিন টানা কাগজে, কলমের কালিতে প্রিয়জনের কাছে হৃদয়ের কথা ফুটিয়ে তুলে পাঠানো সে চিঠির জবাবের জন্য পথ চেয়ে বসে থাকা। কখনও কাগজের ভাঁজে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দেয়া, কখনও পারফিউমের দুই এক ফোঁটা ফেলে সুগন্ধী করা ছিল বাড়তি অনুভূতির প্রকাশ। বারবার চিঠি খুলে পড়া আবার ভাঁজ করে রাখতে গিয়ে ভাঁজের অংশগুলোই ছিঁড়ে যেত।

এখন আর নেই পিয়নের পানে পথ চেয়ে থাকা প্রিয়জনদের উদ্বিগ্নতা। ডাক বিভাগেও নেই এখন আর সেই ব্যস্ততা । কেউ আসে না চিঠির খোঁজ নিতে। প্রিয়জনদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় এখন আর নেই চিঠির প্রচলন। ফলে চিঠি শূন্য এখন ডাকঘর। তাই কর্মীদেরও চিঠি পৌঁছে দেয়ার নেই কোনো তাগিদ। অলস সময় কাটে সকলের। পথের ধারেও এখন আর দেখা যায় সুদৃশ্য পোস্টবক্স। জেলা এবং উপজেলা ডাকঘর ছাড়া গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ ডাকঘর দিনের পর দিন বন্ধ থাকছে। অধিকাংশ ডাকঘরে নেই কোনো ডাকবাক্স। দু-একটি থাকলেও চিঠির পরিবর্তে তার মধ্যে থাকছে ময়লা-আবর্জনা। আবার অনেক ইউনিয়নে সরকারিভাবে নিজস্ব ঘর নেই পোস্ট অফিসের। ইউনিয়ন পোস্ট মাস্টার বা পিয়নরা নিজেদের বাড়ী বা দোকান ঘরে পোস্ট অফিসের কার্যক্রম চালিয়ে থাকেন ।

অভিজ্ঞরা মনে করেন, দ্রুত চলমান জীবনে চিঠি লেখার অবকাশ নেই কারো। চিঠি পাওয়ার আকুলতা, পড়ার আনন্দ, সবকিছুই আজ দখল করে নিয়েছে মোবাইল, ফেইজবুক, ইমো, টুইটার, ভাইবার, মুঠোফোন, ইন্টারনেট, চ্যাট, ই-মেইল, এসএমএস এবং ফেসবুক। এসব প্রযুক্তির গতির ধাক্কায় কাগজ-কলম হাতে এখন আর লেখা হয় না চিঠি। ফলে কালি-কাগজে, হলুদ-নীল খামের অদ্ভূত সেই টানের সময়টুকুও আজ হারিয়ে গেছে।

একসময় ডাক বিভাগ ছিল যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। চিঠি, পণ্য পার্সেল, টাকা পরিবহনে একমাত্র ভরসা ছিল ডাক বিভাগ। টেলিফোন এক্সচেঞ্জ আওতা বহির্ভূত এলাকার পোস্ট অফিসে ছিল টেলিগ্রাম ব্যবস্থা। মানি অর্ডারের বদলে মোবাইল ফোনে হচ্ছে মানি ট্রান্সফার। অফিসিয়াল চিঠি ও ডকুমেন্ট পাঠাতে ব্যবহার হচ্ছে কুরিয়ার সার্ভিস।

ভোলার লালমোহন উপজেলার লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়ন পোস্টমাস্টার মো: মিজানুর রহমান বলেন পোস্ট অফিসে কাজ কম নয়, কিন্তু সম্মানী ভাঁতা একেবারেই নগন্য। ইউনিয়ন পোষ্ট মাস্টারদের ভাঁতা মাত্র ৪হাজার ৫ শত টাকা । এ সামান্য টাকায় কিছুই হয়না।

লালমোহন উপজেলা পোস্টমাস্টার লক্ষী নারায়ণ দে বলেন, কালের আবর্তনে ব্যক্তিগত চিঠিপত্র বিলুপ্ত হলেও অফিসিয়াল কাগজপত্র , পার্সেল ও বিপি সহ পোস্ট অফিসে কাজের চাপ কমেনি বরং আরও বাড়ছে । এবং জনবল সংকটে রয়েছে পোস্ট অফিসগুলো ।

মাকসুদুর রহমান পারভেজ 
লালমোহন, ভোলা
০১৭২২৬১৮৫৯০