আরবি-ই পৃথিবীর প্রাচীনতম ভাষা – পর্ব ৩

মাহমুদ ইউসুফ

এ বিষয়ে সকল গবেষকই একমত যে, মানবজাতির সূচনায় সবাই-ই এক জাতির অন্তর্ভুক্ত ছিলো। আর সবার বুলি-জবানও ছিলো এক। তৌরাত শরিফে ভাষার জন্মকথা অধ্যায়ে বলা হয়েছে, তখনকার দিনে সারা দুনিয়ার মানুষ কেবল একটি ভাষাতেই কথা বলত এবং তাদের শব্দগুলো ছিলো একই। পরে তারা পূর্বদিকে এগিয়ে যেত যেতে ব্যবিলন দেশে একটা সমভূমি পেয়ে সেখানেই বাস করতে লাগল।—— (তৌরাত শরিফ: পয়দায়েশ) এ প্রসঙ্গে নামজাদা রাজনীতিক, গবেষক ও ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু বলেন, বিভিন্ন ভাষাগুলির গোড়াতে একটা ভাষা-ই রয়েছে। (জওহরলাল নেহেরু: পৃথিবীর ইতিহাস, পৃ ৬২) সকলেই তখন এক ভাষায় কথা বলত ও মনের ভাব প্রকাশ করত। কালক্রমে বনি আদমের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায়, নতুন নতুন বংশধারা ও জাতিগোষ্ঠী পয়দা হওয়ায় নিত্য নতুন ভাষার সৃষ্টি হয়। আর মূল আরবি ভাষা থেকেই সময়ে প্রয়োজনে এসব ভাষার উৎপত্তি ঘটে। বর্তমান দুনিয়ায় তালিকাভুক্ত ভাষার সংখ্যা প্রায় ৬০৬০টি। বাংলাদেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে কম করে হলেও প্রায় ৩০টি ভাষা প্রচলিত রয়েছে।

শব্দাবলি ও সমার্থবোধক শব্দাবলির দিক দিয়ে আরবি অভিধান সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী। একটি বড় আরবি অভিধানে প্রায় ১ মিলিয়নেরও বেশি শব্দ থাকে। কেননা আরবি হল শব্দের বুৎপত্তির ভাষা। যেমন ফরাসি শব্দের সংখ্যা ২৫ হাজার, ইংরেজি শব্দের সংখ্যা ১ লক্ষ আর আরবি মুল অক্ষর বা মাদ্দাহ ভিত্তিক শব্দের সংখ্যা ৪ লক্ষ। প্রসিদ্ধ আরবি অভিধান লিসানুল আরব গ্রন্থে ৮০ হাজার মাদ্দাহ ভিত্তিক শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে। যেগুলো হতে আরো অনেক শব্দ বের করা যাবে। (কওমী নিউজ, ০৯ জানুয়ারি ২০১৬)

আরবি ভাষাতে সহজেই বিজ্ঞান ও শিল্পের প্রয়োজনে নতুন নতুন শব্দ ও পরিভাষা তৈরি করা যায়। ইসলামের প্রচারকেরা সপ্তম শতাব্দিতে আরব উপদ্বীপের সীমানা ছাড়িয়ে এক বিশাল আরব সাম্রাজ্য গড়তে বেরিয়ে পড়েন এবং প্রথমে দামেস্ক ও পরে বাগদাদে তাঁদের রাজধানী স্থাপন করেন। এসময় ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী এক বিশাল এলাকা জুড়ে আরবি প্রধান প্রশাসনিক ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হত। ৯ম ও ১০ম শতকে বাগদাদে এক মহান বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন সম্পন্ন হয়। সেসময় বিশ্বের অপরাপর প্রাচীন ভাষা, বিশেষত গ্রিক ভাষার বহু প্রাচীন বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক লেখা আরবিতে অনুবাদ করা হয়। এগুলোতে আবার আরবি চিন্তাবিদেরা নিজস্ব চিন্তা সংযোজন করেন। পরবর্তীতে আরব স্পেনে এই জ্ঞানচর্চাই ইউরোপে মধ্যযুগের অবসান ঘটিয়ে রেনেসাঁসের সূচনা করেছিল। আরবিই ছিল ১১শ শতকে মনুষ্য জ্ঞানভাণ্ডারের বাহক ভাষা এবং এই দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাচীন গ্রিক ও লাতিনের উত্তরসূরী। আরব সভ্যতা বলতে কেবল আরব জাতি বা ইসলামকে বোঝায় না; এই ভাষার মহিমা এই যে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর মানুষকে এটি আকৃষ্ট করেছিল। বিস্তীর্ণ আরব সাম্রাজ্যের নানা জাতের মানুষ আরবি ভাষার ছায়ায় এক বৃহত্তর সমৃদ্ধিশীল আরব সভ্যতার অংশ হিসেবে একতাবদ্ধ হয়েছিল। ৮ম শতক থেকে ১২শ শতক পর্যন্ত সংস্কৃতি, কূটনীতি, বিজ্ঞান ও দর্শনের সার্বজনীন ভাষা ছিল আরবি। ওই সময়ে যারা আরিস্টোটল পড়তে চাইত বা চিকিৎসাবৈজ্ঞানিক পরিভাষা ব্যবহার করতে চাইত বা গাণিতিক সমস্যার সমাধান খুঁজত বা যেকোন ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনায় অংশ নিতে চাইত, তাদের জন্য আরবির জ্ঞান ছিল অপরিহার্য। (উকিপিডিয়া; ১২.০২.২০১৭ তারিখে সংগৃহীত)

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, নবি করিম স. বলেছেন, তোমরা তিন কারণে আরবিকে ভালোবাস, কেননা আমি আরবি ভাষাভাষি, কুরআন আরবি ভাষায় অবতীর্ণ এবং জান্নাতিদের ভাষা হবে আরবি। (শুয়াবুল ইমান, বায়হাকি, বুখারি)  উমার রা. বলেন, তোমরা হাদিসের জ্ঞান অর্জন কর এবং আরবি ভাষার জ্ঞান হাসিল কর। অপর এক বর্ণনায় তিনি বলেন, তোমরা আরবি ভাষা শেখো কেননা, এটা তোমাদের দীনের অংশ। (ইবন আবি শায়বা)

প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, গবেষক মোঃ আবু ইউসুফ বলেন, আরবি পৃথিবীর একটি পরিপূর্ণ ও সমৃদ্ধশালী সর্বশ্রেষ্ঠভাষা। প্রাচীন ভাষা হিসেবে মানুষের শিক্ষার ভাষা আরবি হওয়াটাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। আরবি ভাষার ন্যায় এত সমৃদ্ধশালী, মোহনীয়, সুমিষ্ট, চিত্তাকর্ষক ভাষা পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। এর প্রাঞ্জলতা, সাবললীতা, ভাবগাম্বীর্য, নান্দনিকতা, সৃষ্টিশীলতা সবকিছুই এ ভাষাকে পৃথিবীর অন্যসব ভাষা থেকে স্বতন্ত্র মহিমায় দেদীপ্যমান করে রেখেছে। সুতরাং মর্যাদার দিক থেকে অন্যান্য ভাষার চেয়ে আরবি ভাষার গুরুত্ব অনেক বেশি। এমন মর্যাদাপূর্ণ ভাষার যথাযথ পরিচর্যা ও প্রয়োগ ছাড়া বিশ্বায়ন পরিকল্পনা অবান্তর। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০০৪, পৃ ১৭৪- ১৮১) তাই আরবি ভাষা, কুরআন হাদিসের ভাষা, অহির ভাষা শিক্ষায় মনোযোগী হওয়া আমাদের প্রধান ও মৌলিক কাজ। নৈতিক এবং দীনি দায়িত্বও বটে।

দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও এখানে আরবি শিক্ষা নেই বললেই চলে। স্কুল, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়ে কোনো আরবি বা কুরআনিক শিক্ষা দেয়া হয় না। মাদ্রাসায় কোনমতে টিকে আছে আরবি ভাষা। অথচ এক সময় (১২০৫-১৭৫৭) আরবিই ছিলো শিক্ষার প্রধান বাহন। সে আমলই বাংলার ইতিহাসের স্বর্ণযুগ। সেই স্বর্ণালী ইতিহাস ফিরিয়ে আনতে হলে আজ সর্বাগ্রে দরকার আরবি ও কুরআনিক শিক্ষার বাস্তবায়ন। তাহলেই গড়ে ওঠবে সোনার মানুষ। এই সোনার মানুষেরাই হবে দেশ গড়ার সত্যিকার কারিগর। একাডেমিক শিক্ষার নীতি নির্ধারকরা সেদিকে নজর দিবেন কী?

তিন পর্বে খতম

হদিস:

১. অধ্যাপক ড. এস. এম. লুৎফর রহমান: বাঙালীর লিপি ভাষা বানান ও জাতির ব্যতিক্রমী ইতিহাস দ্বিতীয় খ-, ধারণী সাহিত্য-সংদ, ভেতরবাড়ী লেন, রথখোলা, ঢাকা, প্রকাশকাল- জানুয়ারি ২০০৫

২. মোঃ আবু ইউসুফ, বিশ্বায়নে আরবী ভাষা ও সাহিত্যের গুরুত্ব, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, ৪৪ বর্ষ ২য় সংখ্যা, অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০০৪ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এর একটি গবেষণা ত্রৈমাসিক)

৩.  বাইবেল (বাংলা তরযমা ওয়েবসাইট কপি)

৪. সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, প্রথম খণ্ড, ইসলামক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, পঞ্চম সংস্করণ, মে ২০০৭

৫. সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, দ্বিতীয় খণ্ড, ইসলামক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, চতুর্থ সংস্করণ, জুন ২০০৭

৬. উইকিপিডিয়া, ওয়েবসাইট ও বিভিন্ন খবরের কাগজ

৭. আব্দুল মাতিনঃ আরবী ভাষা: উৎপত্তি, বিকাশ ও বৈশিষ্ট্য, কওমী নিউজ (বাংলাদেশের প্রথম বাংলা-আরবী অনলাইন নিউজ), শনিবার, ০৯ জানুয়ারি ২০১৬

৮. ড. মুহাম্মদ আবদুল হাননান: ধর্মগ্রন্থে ভাষা প্রসঙ্গ, সচিত্র বাংলাদেশ, অমর একুশে সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০১৭, মাঘ-ফাল্গুন ১৪২৩

৯. জওহরলাল নেহেরু: পৃথিবীর ইতিহাস, (তরযমা-শ্রীপ্রবোধ চন্দ্র দাশগুপ্ত), বইঘর, ১১০-২৮৬ বিপণি বিতান, চট্টগ্রাম, পঞ্চম প্রকাশ, অগ্রহায়ণ ১৩৯৭

লেখক:

মাহমুদ ইউসুফ