সব মানুষের ধর্ম ইসলাম

মাহমুদ ইউসুফ

ইসলাম নির্দিষ্ট কোনো জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায় বা  সীমানাভুক্ত কোনো জনগোষ্ঠীর ধর্ম নয়। কোনো দেশ বা রাষ্ট্রের মধ্যে ইসলাম সীমাবদ্ধ নয়। আল্লাহ মহাবিশ্বের স্রষ্টা, পালনকর্তা, আইনদাতা, রিজিকদাতা। তিনি নির্দিষ্ট কোনো সীমারেখার প্রভু নন। আল্লাহ পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। মানুষ পৃথিবীকে খণ্ড বিখণ্ড করে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বিভক্ত করেছে। তাই ইসলাম কোনো বর্ডার বা সীমারেখা মেনে নেয় না। এখানে ভিসা বা পাসপোর্টের স্থান নেই। কারণ রসুল স. বলেছেন, ‘সমস্ত পৃথিবী ও জমিন আল্লাহর আর সমস্ত মানুষ আল্লাহর বান্দা। তাই সেখানেই তুমি মঙ্গলজনক মনে করে সেখানেই বাস কর।’

আল কুরআন বিশেষ ভূখণ্ড বা শুধু মুসলমানদের জন্য নাযিল হয় নাই। প্রাচ্য-প্রতীচ্য বা উত্তর-দক্ষিণের সকল মানুষের জন্যই আল কুরআন। এই কিতাব ঘোষণা করেছে, ‘আল্লাহর নিকট থেকে মানবজাতির কাছে এসেছে একটি জ্যোতি ও সুস্পষ্ট কিতাব। যারা তার সন্তুষ্টি চায়, এ কিতাবের মাধ্যমে তিনি তাদের দেখিয়ে দেন শান্তি ও নিরাপত্তার পথ, নিজ ইচ্ছয় তাদের বের করে আনেন অন্ধকার থেকে আলোতে এবং তাদের নির্দেশিকা প্রদান করেন সরল সঠিক পথের।’(আল কুরআন: সুরা ৫: আল মায়িদা: আয়াত ১৫-১৬)। কুরআন শরিফের ফাস্ট টু লাস্ট সকল নির্দেশনাই বিশ্ববাসীর জন্য। ‘রমজান মাসে নাজিল করা হয়েছে আল কুরআন মানবজাতির জীবন যাপনের ব্যবস্থা হিসেবে। আর এ গ্রন্থ এমন অকাট্য বা সুস্পষ্ট নির্দেশিকা সম্বলিত, যা সঠিক পথ দেখায় এবং সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য পরিষ্কার করে দেয়।’(আল কুরআন: সুরা ২: আল বাকারা: আয়াত ১৮৫)।

মহানবি স. এর জন্ম আরব ভূমিতে। তাই বলে তিনি শুধু অ্যারাবিয়ান জাতি বা আরবভূমির নবি ছিলেন না। আল কুরআনে এমন একটি আয়াত বা বাক্যও পাওয়া যাবে না যেখানে বলা হয়েছে- মুহাম্মাদ স. শুধু মুসলিম বা মক্কা-মদিনার পথ-প্রদর্শক। আল কুরআনের ঘোষণা: ‘হে মুহাম্মাদ! আমি আপনাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী হিসেবে পাঠিয়েছি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না।’ (আল কুরআন: সুরা ৩৪: সাবা: আয়াত ২৮)। ‘তিনি সেই সত্ত্বা, যিনি তার রসুলকে হিদায়াত ও সত্য জীবন ব্যবস্থা ইসলামসহ পাঠিয়েছেন, যেনো তিনি এ দীনকে সমস্ত বাতিল ব্যবস্থাসমূহের ওপর বিজয়ী করেন।’(আল কুরআন: সুরা ৪৮: ফাতহ্: আয়াত ২৮)। ‘আর আমি আপনাকে সমস্ত মানুষের জন্য রসুলরূপে প্রেরণ করেছি এবং আর আল্লাহই ইসাদি হিসেবে যথেষ্ট।’ (আল কুরআন: সুরা ৪: আন নিসা: আয়াত ৭৯)।

ইসলাম মানবজাতির ঐক্যে বিশ্বাসী। বিভেদ, বিভক্তি, খণ্ডিতকরণ, আঞ্চলিকতাবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ ইসলাম সমর্থন করে না। বিখ্যাত ইসলামি বিশেষজ্ঞ ড. ছালেহ বিন ফাওজান আল ফাওজান তাঁর ‘কিতাবুত তাওহিদ’ শীর্ষক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘বিবেক-বুদ্ধি বিবর্জিত ভ্রান্ত মতবাদসমূহের সাথে, এমনকি আঞ্চলিকতাবাদী মতবাদের সাথে সম্পৃক্ত হওয়াও কুফরির অন্তর্ভুক্ত। এটি দীন ইসলাম থেকে সম্পর্ক ছিন্নকারী বিষয়। কেননা ইসলাম আঞ্চলিকতার ডাকসহ যাবতীয় জাহেলি ও মূর্খপনার ধ্বনিকে ধরিত্রী হতে মিটিয়ে দিয়েছে।’

ইসলামে গ্রুপিং, সাংঘর্ষিক মতপার্থক্য, দলাদলির স্থান নেই। আল-কুরআনের ঘোষণা, ‘তোমরা সেই সব লোকদের মতো হয়ো না যারা বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে লিপ্ত হয়ে রয়েছে, তাদের জন্যে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে’। (আল কুরআন: সুরা ৩: আল ইমরান: আয়াত ১০৫)। ‘তোমরা মূলত একই দলভুক্ত, আর আমি তোমাদের প্রভু। সুতরাং আমাকেই ভয় করে চলো। (সুরা ২৩: মুমিনুন: আয়াত ৫২)

প্রাচীনকাল বা মধ্যযুগে কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিলো না। মানুষকে নির্দিষ্ট সীমারেখায় বন্দী থাকতে হতো না। মানুষ তার সুবিধামতো দুনিয়ার যে কোনো জায়গায় হিজরত করতে বা রিজিকের সন্ধানে চলে যেতে পারতো। ‘ভিসামুক্ত পৃথিবী’র আন্দোলনকারীরা সেটাই দাবি করছে। অতীতে সমগ্র পৃথিবীই ছিলো মানুষের কর্মক্ষেত্র। কিন্তু ব্রিটিশরা মানবজাতির সেই অবারিত সুযোগকে নষ্ট করে দিয়েছে। গ্রেট ব্রিটেন এক সময় প্রাচ্য-পাশ্চাত্য পুরোটাই শাসন-শোষন করেছে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাদের প্রশংসা করে লিখলেন, ‘ব্রিটিশ রাজত্বে সূর্য অস্ত যায় না’। পর্তুগিজ, ফরাসি, ডাচ এবং ব্রিটিশদের পূর্বে বিশ্বজুড়ে ছিলো মুসলমানদের একচেটিয়া আধিপত্য। তখন জ্ঞান বিজ্ঞান সভ্যতার নেতৃত্বে ছিলো মুসলিম রাজা বাদশা, মুজাহিদ সৈনিক, বুদ্ধিজীবী এবং জ্ঞানী বিজ্ঞানীরা। তখন মুসলিম জাতি ছিলো সীসা ঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ। একজনের বিপদে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়তো। শুধু তাই নয়, তারা অত্যাচারী রাজাদের কবল থেকে বনি আদমকে রক্ষা করতে ছিলো উদগ্রীব।

রাজা রডারিকের অত্যাচার থেকে স্পেনবাসীদের রক্ষা করতে এগিয়ে যায় তারিক বিন জিয়াদ। সিন্ধু থেকে একজনমাত্র নির্যাতিত তরুণীর চিঠি পেয়ে বসরার শাসনকর্তা হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর নির্দেশে মুহাম্মাদ বিন কাসিম সন্ত্রাসী রাজা দাহিরের বিরুদ্ধে তেড়ে আসেন ভারতীয় উপমহাদেশে। সেন বর্মনদের জুলুম অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে বাংলার বৌদ্ধ ও শুদ্র জনগণ। তারা ভারতের মুসলিম শাসকদের কাছে আবেদন জানায় উপনিবেশবাদী ব্রাহ্মণদের কবল থেকে রক্ষা পেতে। তাদের করজোর আবেদনে ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খলজি অভিযান চালায় বাংলাদেশে। মুসলিম জাতির সেই শক্তি, সাহস, অমিত তেজ নি:শেষ করতেই বিংশ শতকের সূচনাপর্বে মুসলিম বিশ্বকে খণ্ড-বিখণ্ড করার উদ্যোগ গ্রহণ করে ব্রিটিশ সরকার। তারা মুসলিম শৌর্য-বীর্যকে চূর্ণ-বিচুর্ণ করে ৫০-৬০টি রাষ্ট্রে বিভক্ত করে। পশ্চিমা বিশ্ব ডিভাইড এন্ড রুল এবং সাম্প্রদায়িক নীতি অবলম্বন করে মুসলমানদের এখনও শোষন করে যাচ্ছে। সীমারেখায় আবদ্ধ না হলে আরাকান, কাশ্মির, মিন্দানাও, চেচেন, ফিলিস্তিন, মায়ানমার, ভারত, সোমালিয়া, মিশর, সুদান, ইরাক, আফগানিস্তানে মুসলমানদের রক্ত নিয়ে হোলিখেলায় মেতে ওঠতে পারতো না ইসরাইল-মার্কিন-ভারত কিংবা চীন-বার্মা-ফিলিপাইন। মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ একাতাবদ্ধ হলে ইসলাম বিরোধী অপশক্তি একদিনও ময়দানে টিকে থাকতে পারবে না।

মহানবি স. ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আঞ্চলিকতার কারণে সংগ্রামে লিপ্ত হয় কিংবা যে ব্যক্তি আঞ্চলিকতার কারণে ক্রোধান্বিত হয় এরা আমাদের (মুসলমানদের) দলভুক্ত নয়। অথচ কী আশ্চর্য ! এজন্য যারা নিহত হয় তাদেরকে আমরা ‘শহিদ’ মর্যাদায় অভিসিক্ত করি। ইসলামের সাথে, আল্লাহর সাথে এর চেয়ে বড় প্রতারণা আর কী হতে পারে? এমনকি অমুসলিমদেরও আমরা ‘শহিদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করছি। যেমন- শহিদ গোবিন্দ চন্দ্র সাহা, শহিদ বাবুল মুখার্জী, শহিদ উপেন্দ্রনাথ, শহিদ বিশ্বজিৎ, শহিদন রণপ্রসাদ … ইত্যাদি। নবি করিম স. এর আদর্শ বাস্তবায়ন, কুরআনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং আল্লাহর পথে যারা নিহত হয় একমাত্র তারাই ‘শহিদ’ মর্যাদায় সিক্ত। স্বায়ত্ত্বশাসন, আঞ্চলিকতা, দেশ বা জাতিরাষ্ট্র সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ স. বলেছেন, ‘আল্লাহপাক তোমাদের অন্তর থেকে স্বীয় পূর্ব পুরুষদের নামে গৌরব প্রদর্শন এবং আঞ্চলিকতার মোহকে দূরীভূত করে দিয়েছেন। ব্যক্তি হয়তো একজন পরহেজগার মুমিন হবে অথবা বদবখত গোনাহগার হবে।

 

হদিস :

১.   মুহাম্মদ মতিউর রহমান, মানবাধিকার ও ইসলাম, বিআইসি, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, অক্টোবর, পৃ ৫৩

২.   মুসলমান কেমন করে কাফের হয়?, কুরআন হাদীস রিসার্চ সেন্টার, ইশা’আতে ইসলাম কুতুব খানা, (ফুরফুরা শরীফের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান) মার্কাজে ইশাআতে ইসলাম, ২/২ দারুসসালাম রোড, মিরপুর ঢাকা-১২১৬, জুন ২০০১ ঈসায়ী, পৃ ৮৪

৩.   ওই, পৃ ৮৪

৪.   ওই, পৃ ৮৪-৫