প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

মুক্তবুলি ডেস্ক

কিছু মানুষ তাদের অবদানের মাধ্যমে মৃত্যুকে অম্লান করে বেঁচে থাকে স্মৃতির মাঝে। কখনো বা জীবন্ত মানুষের ছায়ায় আরও বেশি জীবন্ত রূপে। কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তেমনি একজন মানুষ। মাত্র দুটি উপন্যাস আর হাতেগোনা কয়েকটি ছোটগল্প লিখে তিনি পাঠকদের মনে জায়গা করে নিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা লেখক হিসেবে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে যে তার লেখা শব্দ কিংবা বাক্যের কলেবরে পরিমাপ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার, তিনি তার লেখার গুণগত ব্যাপ্তি দিয়েই নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।

আখতারুজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এবং মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি বাবা বদিউজ্জামান মুহম্মদ ইলিয়াস ও মা মরিয়ম ইলিয়াসের কোল আলো করে ১৯৪৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধা জেলার গোটিয়া গ্রামে মাতুলালয়ে জন্ম নেন।

তার পৈতৃক বাড়ি বগুড়া শহরের নিকটবর্তী চেলোপাড়ায়। শৈশবে তার ডাকনাম ছিল মঞ্জু, তবে লেখক হিসেবে তিনি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস নামেই সমাদৃত।

১৯৪৯ সালে আখতারুজ্জামানের শিক্ষাজীবন শুরু হয় ঢাকার সেন্ট ফ্র্যান্সিস জেভিয়ার্স স্কুলে, এরপর কেএল জুবিলি স্কুল, ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল পরবর্তিতে ঢাকা ছেড়ে সপরিবারে বগুড়া যাওয়ার ফলে তার স্কুলজীবন শুরু হয় বগুড়া জিলা স্কুলে এবং এখান থেকেই তিনি ১৯৫৮ সালে মাধ্যমিক পাশ করেন। পরে আবার ঢাকায় চলে আসেন এবং উচ্চ মাধ্যমিকে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৬০ সালে উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেড়িয়ে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর সেখান থেকেই ১৯৬৪ সালে বাংলাতে বিএ অনার্স ও এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।

জগন্নাথ কলেজে প্রভাষক পদে যোগদানের মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু হয়। এরপর তিনি মিউজিক কলেজের উপাধ্যক্ষ, প্রাইমারি শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরিচালক, ঢাকা কলেজের বাংলার প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মফিজউদ্দিন শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন। এছাড়াও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এদেশের প্রগতিশীল ও মানবতাবাদী সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতিও তার ছিল পরোক্ষ সমর্থন।

তার সাবলীল লেখায় পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধপরবর্তী রাজনৈতিক এবং সামাজিক বাস্তবতা। ষাটের দশকে লেখালেখি শুরু করে আমৃত্যু তিনি লিখেছেন। নিজের মেধা মননকে ব্যবহার করে সমাজের নিচু তলা থেকে উপর তলা পর্যন্ত মানুষের জীবনকে নিজের লেখনীর মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।

বাস্তবতার নিপুণ চিত্রণ, ইতিহাস ও রাজনৈতিক জ্ঞান, গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও সূক্ষ্ম কৌতুকবোধের অদ্ভুত এক মিথস্ক্রিয়ায় বাংলা গদ্যসাহিত্যকে দাঁড় করিয়েছিলেন শক্তিশালী ভিতের উপর। যা তার রচনাকে দিয়েছে ব্যতিক্রমী সুষমা।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের রচিত গ্রন্থের সংখ্যা খুব কম। তার মধ্যে উপন্যাস চিলেকোঠার সেপাই (১৯৮৭), খোয়াবনামা (১৯৯৬), ছোট গল্প সংকলন খোঁয়ারি (১৯৮২), অন্য ঘরে অন্য স্বর (১৯৭৬), দুধভাতে উৎপাত (১৯৮৫), দোজখের ওম (১৯৮৯), জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল (১৯৯৭), প্রবন্ধ সংকলন সংস্কৃতির ভাঙা সেতু, ছোট গল্পের তালিকায় আছে প্রেমের গপ্পো, রেইনকোট, জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল, ফোঁড়া, কান্না, নিরুদ্দেশ যাত্রা, যুগলবন্দি, ফেরারী, অপঘাত, পায়ের নিচে জল, দুধভাতে উৎপাত, সন্তু, ঈদ, মিলির হাতে স্টেনগান ইত্যাদি।

বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যে অসমান্য অবদানের জন্য ও নিজের সুনিপুণ লেখনীর দ্বারা তিনি পেয়েছিলেন হাজারো পাঠকের ভালবাসা পাশাপাশি পেয়েছিলেন হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার, বাংলা একাডেমী পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, আনন্দ পুরষ্কার, সাদাত আলী আখন্দ পুরষ্কার, কাজী মাহবুবুল্লাহ স্বর্ণপদক ও মরণোত্তর একুশে পদকের মতো বিভিন্ন পুরষ্কার।

এছাড়াও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কিছু কাজ অন্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং চিলেকাঠার সেপাই উপন্যাস ও কান্না গল্পটির অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র ।

লেখালেখির সঙ্গে কখনোই আপোস করেননি কীংবদন্তী এই লেখক। তাইতো গ্রামে গ্রামে ছুটে বেড়িয়েছেন লেখনীর সন্ধানে, মানুষের সঙ্গে মিশেছেন, শুধু লেখার খাতায় নয়, জীবনের খাতায়ও দৌড়েছেন বহু পথ।

এই কিংবদন্তী ১৯৯৭ সালের ৪ জানুয়ারি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *