রবীন্দ্রনাথ : বাংলা সাহিত্যের ধ্রুবতারা

সিরাজ মাহমুদ ।।

ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে তথা ১৮৬১ সালের  ৭ মে, ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ, বাংলা সাহিত্যের দিকপাল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও তিনি সেই সোনার চামচের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তার কণ্ঠে, কলমের খোঁচায় গরীব, দুঃখী, সাধারণ মানুষের নিখুঁতচিত্র জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছে। পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মাতা সারদা দেবীর কোলে জন্ম নিলেও তিনি নিজেকে পৃথিবী নামক বিশ্ব মায়ের আচলতলে স্থান দিয়েছেন। আট বছর বয়সে ‘হিন্দু মেলার উপহার’ কবিতা লেখার মাধ্যমে সাহিত্যে হাতেখড়ি হয়েছিল তার। এরপর তার কলম আর থামেনি, টানা ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত নিজেকে সপে দিয়েছিলেন সাহিত্য সাধনায়।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বয়স ১৫ শত বছর। সেই তুলনায় তার সাহিত্য সাধনা যদিও প্রায় ২১ ভাগের এক ভাগ, বাংলা সাহিত্যে তার অবদান আকাশচুম্বী। সাহিত্যের প্রায় এমন কোন শাখা নেই যেখানে তার বিচরণ ছিল না। তিনি ছিলেন একাধারে সব্যসাচী লেখক, কবি,নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, সঙ্গীত রচয়িতা, সুরস্রস্টা, গায়ক, চিত্রশিল্পী, অভিনেতা, সমাজসেবক ও শিক্ষাবিদ। তার লেখায় আমরা জমিদার কর্তৃক প্রজাদের নির্মম নিপীড়ন দেখতে পাই। তার ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় তিনি বলেছেন-

‘এই জগতে হায় সেই বেশি চায়, আছে যার ভুঁড়িভুড়ি, রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙ্গালের ধন চুরি।’

রবীন্দ্রনাথ ১৮৭৮ সালে ব্যারিস্টারি পড়তে লন্ডনে গেলেও প্রাণ জুড়ানো বাংলাই হয় তার সাহিত্য সাধনার প্রধান ক্ষেত্র। সেখানে গিয়েই শেক্সপিয়ার ও অন্যান্য ইংরেজি সাহিত্যিকদের সৃষ্টকর্ম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। ১৮৭৮ সালে রবীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কবি -কাহিনী’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই গ্রন্থকার হিসেবে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৮৩ সালে ভবতারীনি দেবীর সঙ্গে তার বিবাহ হয় যার নাম তিনি দিয়েছিলেন মৃনালীনি। বিদ্যালয়ের ছক বাধা নিয়ম নীনি তিনি পছন্দ করতেন না বলেই তাকে বাসায় গৃহশিক্ষক এর মাধ্যমে পড়ানে হতো। তিনি বাংলা ছোট গল্পের জনক। তার কাবুলিওয়ালা, ছুটি, পোস্ট মাস্টার’র মত ছোট গল্পগুলো পাঠকের হৃদয়কে যুগ যুগ ধরে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। তার দেওয়া ছোটগল্পের সংজ্ঞাটিও চমৎকার,

‘ছোট প্রাণ ছোটকথা, ছোট ছোট দুঃখ ব্যাথা,
নিতান্তই সহজ সরল,
সহস্র বিশ্রিত রাশি, প্রত্যাহ যেতেছে ভাসি,
তারি দু -চারটি ছটা, ঘটনার ঘনঘটা,
নাহি তত্ত্ব, নাহি উপদেশ,
অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গকরি মনে হবে,
শেষ হয়ে হইলনা শেষ।

সংজ্ঞাটি পড়লেই ছোটগল্পের আদ্যোপান্ত পাঠক হৃদয়ে ভেসে ওঠে। ছোটগল্পের মূল বৈশিষ্ট্যটিই ফুটে ওঠে সংজ্ঞার ভিতরে। মানবজীবনের এক অন্তর্দশনের দেখা মেলে তার বিখ্যাত ‘সোনার তরী’  কবিতার ভেতর।
রবীন্দ্রনাথকে, গুরুদেব, বিশ্বকবি, কবিগুরু  অভিধায় অভিষিক্ত করা হয়। তার প্রায় ১০ টি ছদ্মনাম থাকলেও, ভানুসিংহ নামটিই সকলের কাছে পরিচিত। তার ৫২ টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮ টি নাটক, ১৩ টি উপন্যাস, ৩৬ টি প্রবন্ধ তার জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়। তার  সর্বমোট ৯৫ টি ছোটগল্প ও ১৯১৫ টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তিনি তার নিজের লেখা ১৩ টি নাটকে নিজেই অভিনয় করেছেন। তার অঙ্কিত ছবির সংখ্যা প্রায় ২০০০. নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ কবিতায় তিনি দেখিয়েছিলেন ভবিষ্যত বিপুল সম্ভাবনাময়। ১৪০০ সাল, কবিতায় ভবিষ্যৎ দূরদর্শিতা সম্পর্কে এক অমোঘ সত্যবানী লিখে গেছেন,তার আগামীর পাঠকদের পানে দূরদৃষ্টি দিয়ে তিনি বলেছেন,

আজি হতে শতবর্ষ পরে,
কে তুমি পড়িছ বসে আমার কবিতাখানি, কৌতহল ভরে,
আজি হতে শতবর্ষ পরে।

তিনি বাংলা, ইংরেজি, ল্যাটিনসহ বহু ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন। তার লেখায় ফুটে উঠেছে ভাবগাম্ভীর্যতা, গীতিধর্মীতা, রোমান্টিক সৌন্দর্য চেতনা, সরস প্রকৃতি, বিশ্বপ্রেম, মানবপ্রেমী, প্রকৃতিপ্রেম,আত্ন সচেতনতা প্রভৃতি। বিহারীলাল চক্রবর্তীকে গীতিকবিতার জনক বলা হলেও এর সমৃদ্ধি ও বিকাশে রবীন্দ্রনাথই অগ্রগণ্য। তিনি একাধারে ভারত, বাংলাদেশ ও শ্রীলংকার জাতীয় সংগীতের রচয়িতা। প্রকৃতির এক সুনিপুণ বর্ণনায় দুই বাংলার ভাঙ্গন রোধের জন্য রচনা করেছিলেন ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি ’

গানটি যা বিবিসির জরিপে শ্রেষ্ঠ গান হিসেবে নথিভুক্ত হয়ে আছে। ২০০৪ সালের বিবিসির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালীর তালিকায় ২য় স্থান অর্জন করেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি পরিভ্রমণ করেন জমিদারি দেখভালের খাতিরে। কুষ্টিয়ার শিলাইদহে রয়েছে তার কুটিবাড়ী। তার সৃষ্টি জগতের মধ্যে ‘গীতাঞ্জলি’ কবিতার সংগ্রহটির ইংরেজি অনুবাদ তাকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছিল যার জন্য তিনি ১৯১৩ সালে এশিয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

১৯১৬ সালে ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘নাইট’ উপাধী দিলেও ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তা ত্যাগ করেন। বাংলা সাহিত্যের এই ধ্রুবতারা ১৯৪১ সালে সাহিত্যের তরী বোঝাই করে নিজে চলে গেলেন পরপারে তার কবিতার কথার মতো,
‘এ বিশ্ব চরাচরে স্বর্গমত্য ছেয়ে,
সবচেয়ে পুরাতন কথা,
সবচেয়ে গভীর ক্রন্দন,
যেতে নাহি দেব হায়,
তবু যেতে দিতে হয়,
তবু চলে যায়।

সিরাজ মাহমুদ
প্রভাষক, দক্ষিণ আইচা অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম কলেজ

চর‌ফ্যাশন, ভোলা।
মোবাইল: ০১৭৩৪৩৭৪৮৫৬
E-mail: [email protected]

One comment

  1. অসাধারণ।
    স্যারের লেখার ধরনের কোনো জুড়ি নেই। আপনি ধীরে ধীরে আপনার লেখনীর ওজস্বিতার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছেন। আমি আপনার উত্তরোত্তর উন্নতি কামনা করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *