আন্তর্জাতিক মানের কথাশিল্পী শফীউদ্দিন সরদার

 

মাহমুদ ইউসুফ

বাংলাদেশের মূলধারার কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে শফীউদ্দিন সরদার অন্যতম। তিনি নিভৃতচারী এক অসাধারণ এবং পাঠকনন্দিত লেখক। শেকড় সন্ধানে নিয়োজিত এ বরেণ্য কলম সৈনিকের ৮২ তম জন্মবার্ষিকী ছিল গত ১লা মে। কবিতায় ইসমাইল হোসেন সিরাজী, কাজী নজরুল ইসলাম, গোলাম মোস্তফা, ফররুখ আহমদ, মুফাখখারুল ইসলাম, বেনজীর আহমদ, সঙ্গীতে আব্বাস উদ্দিন, আবদুল আলীম, গল্পে শাহেদ আলী, নাটকে ড. আসকার ইবনে শাইখ, চিন্তা-গবেষণায় এম আকবর আলী, মাওলানা আকরম খাঁ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, সৈয়দ আশরাফ আলী, মোহাম্মাদ মোদাব্বের, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, ড. আবদুল করিম, প্রিন্সিপাল ইবরহিম খাঁ, আবুল মনসুর আহমদ, সরকার শাহবুদ্দিন আহমদ প্রমুখ আর উপন্যাসে শফীউদ্দিন সরদার জাতির কাণ্ডরির ভূমিকায় অবতীর্ণ।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এ সময়ের সেরা কবি আল মাহমুদ শফীউদ্দিন সরদার সম্পর্কে বলেন, ‘শফীউদ্দিন সরদার বাংলাদেশের সমকালীন সাহিত্যে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। যিনি ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী মুসলিম বীরত্বগাঁথার মহান উপস্থাপক। তিনি আমাদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত কথাশিল্পী। আমি উপন্যাসিক শিল্পীর একজন ভক্ত’। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় এই কালজয়ী কথাসাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক আজও দেশের সর্বোচ্চ মহল থেকে তার সাহিত্যকর্মের কোনো স্বীকৃতি পান নাই। একুশে পদক বা বাংলা একাডেমি পদকে তাঁর তকদির সুপ্রসন্ন হয়নি।

১৯৩৫ সালের ১ মে তিনি নাটোর সদর উপজেলার হাটবিলা গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। ১৯৫০ সালে মেট্রিকুলেশন পাশ করার পর রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট, সম্মান এবং মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। পরে তিনি লন্ডন থেকে ডিপ্লোমা-ইন-এডুকেশন ডিগ্রি লাভ করেন। নিজ গ্রামের স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে তিনি একে একে রাজশাহী সরকারি কলেজ ও সারদাহ ক্যাডেট কলেজে অধ্যাপনা করেন। এছাড়া বানেশ্বর কলেজ ও নাটোর রাণী ভবাণী সরকারি মহিলা কলেজে প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত তিনি প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবেও সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে অবসর জীবন করছেন। একই সাথে চলছে সাহিত্য চর্চা।

ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনায় বাংলাদেশে তাঁর স্থান সবার শীর্ষে। এক্ষেত্রে তিনি পুরোপুরি স্বার্থক। তাঁর রচিত বইয়ের সংখ্যা ৫০ এর অধিক। ঐতিহাসিক উপন্যাসসমূহের মধ্যে রয়েছে বখতিয়ারের তালোয়ার (১৯৯২), রূপনগরের বন্দী, গৌড় থেকে সোনারগাঁ, যায় বেলা অবেলায়, বিদ্রোহী জাতক, বারো পাইকার দূর্গ, রাজ বিহঙ্গ, শেষ প্রহরী, বারো ভূঁইয়া উপাখ্যান, প্রেম ও পূর্ণিমা, বিপন্ন প্রহর, সূর্যাস্ত, পথহারা পাখি, বৈরী বসতী, অন্তরে প্রান্তরে, দাবানল, ঠিকানা, ঝড়মুখো ঘর, অবৈধ অরণ্য, দখল, রোহিণী নদীর তীরে ও ঈমানদার এর মতো জনপ্রিয় ঐতিহাসিক উপন্যাস। এছাড়াও আমাদের সাহিত্য ভান্ডারে তিনি উপহার দিয়েছেন সামাজিক উপন্যাস চলনবিলের পদাবলি, অপূর্ব অপেরা, শীত বসন্তের গীত, পাষানী, দুপুরের পর, রাজ্য ও রাজকন্যারা, থার্ড প-িত, মুসাফির, গুনাগার প্রভৃতি। এগুলোর বাজার কাটতি এবং পাঠকপ্রিয়তাও ব্যাপক। তাঁর রচিত ভ্রমন কাহিনীর মধ্যে ‘সুদূর মক্কা মদীনার পথে’ উল্লেখযোগ্য। কল্পকাহিনী সুলতানার দেহরক্ষী, রম্য রচনা রাম ছাগলের আব্বাজান, চার চাঁন্দের কেচ্ছা ও অমরত্বের সন্ধানে উলেখযোগ্য। শিশু সাহিত্য উলেখ করার মতো ভূতের মেয়ে লীলাবতী, পরীরাজ্যের রাজকন্যা ও রাজার মেয়ে কবিরাজ। এছাড়া রয়েছে বখতিয়ারের তিন ইয়ার, রাজ নন্দিনী, লা-ওয়ারিশ, রূপনগরের বন্দী, দ্বীপান্তরের বৃত্তান্ত ইত্যাদি। তাঁর লেখালেখির মূখ্য উদ্দেশ্য আত্মবিমুখ জাতির উজ্জীবন। একই সাথে কলকাতা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার পূর্বকালীন ছয়শত বছরের আসল বা মূল বাংলাভাষার শব্দাবলি ব্যবহার ও নীতি প্রয়োগের প্রয়াস পেয়েছেন।

শফীউদ্দিন সরদারের লেখার ভাষা সহজ, সরল, ঋজু। গ্রামীণ এবং পুঁথির ভাষা তাঁর কাছে যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। একসময় রাজপ্রসাদ থেকে দিনমজুরের কুঁড়েঘর, সচিবালয়-সেনানিবাস থেকে কৃষকের আঙিনা পর্যন্ত ছিলো এ ভাষার বিস্তৃতি। সর্বত্রই ছিলো এ ভাষার একচ্ছত্র আধিপত্য। কালক্রমে কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের শঠতায় বাংলাভাষার গতি উল্টোদিকে প্রবাহিত হয়। বাংলাভাষাকে তারা সংস্কৃতের দুহিতায় রূপান্তরিত করে। সাম্প্রতিককালে দুই জন পণ্ডিত ফোর্ট উইলিয়াম ও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত নির্ভর বাংলাভাষাকে এড়িয়ে বাংলাভাষার প্রকৃত রূপকে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন তাদের লেখনীতে। তাদের মধ্যে একজন হলেন কথাসাহিত্যিক শফীউদ্দিন সরদার এবং অন্যজন বিখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস, এম, লুৎফর রহমান। এটাই বাংলাভাষার আসল চিত্র।

শফীউদ্দিন সরদারের গৌরবময় কালোত্তীর্ণ সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করা সত্ত্বেও জাতীয় পর্যায়ে উপেক্ষিত। বাংলার সাহিত্যাকাশে ধ্রুবতারা হওয়া সত্ত্বেও সকল ধরনের রাষ্ট্রীয় বা সরকারি স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত। যদি তিনি লিখতেন, ‘কৃষ্ণ আইল রাধার কুঞ্জে’, পরকীয়া প্রণয়োপখ্যান, শস্তা প্রেমকাহিনি, তরুণ তরুণীদের চরিত্র বিধ্বংসী লাভস্টোরি অথবা সাহিত্যে যদি আমদানি করতেন অশ্লীলতা, বেহায়াপনা বা প্রাচীন ভারতের দেব-দেবীদের লীলাখেলা, ইন্দ্র অরুণ বরুণ শিব গণেশ লীলাবতীদের কুকীর্তি তাহলে ঠিকই তিনি হতেন সাহিত্যের মহানায়ক, কিংবদন্তী। তাঁর তকদিরে জুটত বড় বড় এনাম, খেতাব, পুরস্কার, কাড়ি কাড়ি টাকা এবং জাতীয় খ্যাতি। কিন্তু তাওহিদে বিশ্বাসী হবার কারণে তাঁর সৌভাগ্য রবি উদিত হয়েও উদিত হলো না কায়েমি স্বার্থবাদিদের কারণে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সম্পাদক ও বরেণ্য লেখক মাহমুদুর রহমান বলেছেন, ইসলামের পক্ষে লেখালেখি এবং মুসলমান হবার কারণেই আজ আমি নির্যাতিত নিপীড়িত।’ শফীউদ্দিন সরদারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আল্লাহ এবং মহানবি স. এর পক্ষভুক্ত হওয়ার কারণেই তাঁর রচনাবলিকে আলোতে আসতে বাধা দিচ্ছে বাম-রাম-সেকুলাররা। তবে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস শতবছর পর হলেও একদিন তাঁর খ্যাতি দেশদেশান্তরে-বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে যাবে। তাঁর নামে সারা দুনিয়া হবে মাতোয়ারা। যেমন হচ্ছে ফেরদৌসি, ওমর খৈয়াম, শেখ সাদি কিংবা মাওলানা রুমির স্মরণার্থে।

তথ্যপঞ্জি :
১। বিভিন্ন অনলাইন ভিত্তিক খবরের কাগজ
২। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক
৩। ওয়েবসাইট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *