জাহিদুল ইসলাম পলাশ
.
বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত বা সমালোচিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হচ্ছে ফেসবুক। তরুণ প্রজন্মের কাছে ফেসবুক বিনা জীবন যেন অন্ধকার। তরুণদের তো বটেই, অনেক প্রবীণদেরও সারাদিনের প্রায় অর্ধেক সময় কাটে ফেসবুকের টাইমলাইনে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে। ফেসবুক নিয়ে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মত রয়েছে। এই অ্যাপের ভালো-খারাপ দিক নিয়ে কম লেখালেখি বা আলোচনা হয় নি।
ফেসবুকের ভালোমন্দ নিয়ে বলতে গেলে উল্লেখ করতে হয় যে প্রায় প্রতিটি জিনিসের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক রয়েছে।
ছুরি যেমন খারাপ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি বা তৈরি করা হয় নি, তেমনি ফেসবুকও না। ব্যাপারটা হলো এই ছুরিকে বা ফেসবুককে আমরা কিভাবে ব্যবহার করি; ভালো কাজে নাকি মন্দ কাজে? সংবাদ ব্রিফিংয়ে সংস্থাটির ভাইস প্রেসিডেন্ট চামাথ পালিপিতিয়া বলেছিলেন, ফেসবুক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে। সামাজিক কাজকর্ম করার জন্য ফেসবুক অনেক রকম টুলস এনেছে।
ফেসবুকের ফলে বিশ্বে তথ্য প্রযুক্তির যে বিপ্লব ঘটেছে তা অনায়াসেই বোধগম্য হয়। ফেসবুকের মাধ্যমে নাম মাত্র খরচে আমরা বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের লোকজনের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারি। ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গ ঠিক পরস্পরের যোগাযোগ রক্ষা করার জন্যই ২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ফেসবুক প্রতিষ্ঠা করেন। তখন শুধু হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসটি এর আওতাভুক্ত ছিলো কিন্তু অতি দ্রুত এর জনপ্রিয়তা ও প্রসারতা লাভ করে।
.
এখন ফেসবুকে কোটি কোটি ব্যবহারকারীর প্রবেশ বলে এখানে বিভিন্ন ধরণের বাণিজ্যিক পেজ ও বিজ্ঞাপনের সমাহার দেখতে পাওয়া যায়। তবে ফেসবুকের ভালো দিকের চেয়ে মন্দ বা খারাপ দিকের ব্যবহার অধিক লক্ষ্যনীয়। খারাপ দিকের বরাত দিয়ে সম্প্রতি ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা জুকারবার্গ জানালেন, এটি প্রতিষ্ঠা করা ‘মারাত্মক ভুল’ ছিল। ফেসবুক সমাজকে বিপুল ক্ষতির মুখোমুখি করছে বলেও স্বীকার করলেন তিনি। একই সাথে ফেসবুকের ভাইস প্রেসিডেন্ট চামাথ পালিপিতিয়াও স্বীকার করলেন, এটি প্রতিষ্ঠা করা ‘ভয়ংকর ভুল’ ছিল। এমনকি তার সন্তানকে ফেসবুক ব্যবহার করতে দেন না বলেও অকপটে স্বীকার করলেন। এছাড়া কীভাবে মানুষের মন ঘোরানো যায় সেটা নিয়েও তারা ভাবছেন।
.
ফেসবুক যেন এখন জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে সমগ্র বিশ্বে। ভালোর পাশাপাশি খারাপভাবে বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে জনপ্রিয় এই অ্যাপসটিকে। নানা অপরাধমূলক এবং প্রতারণামূলক কাজ করা হচ্ছে এটি ব্যবহার করে। জীবনের ওপর এবং সমাজের ওপর ক্রমেই ফেসবুক তার থাবা বসিয়ে চলেছে। নষ্ট হচ্ছে বহু সম্পর্ক। যার কারণেই চিন্তিত আজ সমাজ বিজ্ঞানী, মনস্তাত্ত্বিক বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকরা।
ফেসবুকে ফেক আইডি ব্যবহারকারী রয়েছে অসংখ্য মানুষ। এরমধ্যে অনেকে বিভিন্ন সময়কে উপলক্ষ্য করে অবান্তর ও ভুয়া খবর পোস্ট করে সাধারণ মানুষকে আতঙ্কে রাখে। ২০১৪ সালে ভারতের লোকসভা নির্বাচনে ফেক আইডি ব্যবহার করে নির্বাচনী সময় নানা গুজব রটানো হয়; যা তৎকালীন নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। মূলত ২০১৩-১৪ সালে ফেসবুকে ফেক আইডির উদ্ভব বেশি ঘটেছে। ফেসবুকের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এলিট শ্রেণির লোক ফেসবুক ব্যবহার করতেন কিন্তু এখন ফেসবুকে সব ধরণের লোকের প্রবেশ ঘটেছে, যার ফলে যারা একটু মেধা ও মননে পিছিয়ে আছে তারা কোন তথ্য বা সংবাদের সত্যতা যাচাই না করেই অহরহ পোস্ট ও শেয়ার দিচ্ছে। ফলশ্রুতিতে, সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়। আবার ফেসবুক থেকে তথ্য চুরি হওয়ার প্রবণতাও কম নয়; ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে প্রায় পাঁচ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীর তথ্য চুরি করা হয়। হামলাকারীরা ফেসবুকের ‘ভিউ এজ’ ফিচারটি ব্যবহার করে হামলা করে।
এছাড়াও সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে ফেসবুকের কারণে আত্ম-সম্মানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে যা ইর্ষার জন্ম দেয়। যেমন অবকাশ এবং ছুটির দিনে বন্ধুরা দর্শনীয় স্থানগুলোতে ঘুরতে যায় ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি পোস্ট করে। এই ছবি দেখার কারণে অন্যান্য বন্ধুদের মাঝে ইর্ষার উন্মেষ ঘটে। অন্যান্য ইর্ষার কারণগুলোর মধ্যে আছে বন্ধু বান্ধবের পারিবারিক সুখী এবং কারো দৈহিক সোন্দর্যের ছবি। এধরনের ইর্ষান্বিত অনুভূতি মানুষকে তাদের জীবনে একা এবং অতৃপ্ত করে দেয়। জার্মান দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে তিনজনের মধ্যে একজন ফেসবুক চালানোর পর নিজেদের জীবন নিয়ে অসন্তুষ্ট। এবং অন্য একটি গবেষণায় (যা উটাহ ভ্যালি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক পরিচালিত হয়েছিল) উঠে আসে যে, ফেসবুকে সময় কাটানো বাড়ানোর পর তারা তাদের জীবন সম্পর্কে নিকৃষ্ট অনুভূতি হয়েছিল।
এখন জনসাধারণের মনে এ প্রশ্নই জাগে সত্যিকার অর্থে ফেসবুক/সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের কোন পথে প্ররোচিত ও পরিচালিত করছে?
কখনো ভেবে দেখেছেন, আপনি ফেসবুক ব্যবহার করেন নাকি ফেসবুক আপনাকে ব্যবহার করে?
★ আপনি কি দৈনিক দেড় ঘন্টার বেশি ফেসবুক/ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে থাকেন?
★ সকালে ঘুম থেকে উঠে কোন কিছু করার পূর্বে ফেসবুক/সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম চেক আউট করেন?
★ যখন আপনি অবসর সময়ে থাকেন তখন কি ফেসবুক/সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বারংবার প্রবেশ করেন?
★ বাস্তব জীবনের বন্ধুদের চেয়ে ভার্চুয়াল বন্ধুদের সাথে অধিক যোগাযোগ রাখেন?
★ অনলাইনে থাকার জন্য অন্যান্য কাজগুলোকে অবহেলা করেন বা প্রত্যাখ্যান করেন?
★ কারো ডাকে সাড়া না দিয়েও অনলাইনে থাকতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
★ ব্যক্তিগত গোপন তথ্য ফেসবুক/সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করে পরে অনুতপ্তবোধ করেন?
★ কোন বিষয় আপনার রিয়াল লাইফের বন্ধুদের বলার পূর্বে ফেসবুক/ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলেন?
★ আপনি যদি কয়েকঘন্টা ফেসবুক/সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবেশ না করে থাকেন, তাহলে কি অস্বস্থিবোধ করেন?
★ রাতে ঘুমাতে যাওয়ার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত ফেসবুক/সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে থাকেন?
উপরিক্ত লক্ষণগুলোর অধিকাংশ যদি আপনার মাঝে বিদ্যমান থাকে তাহলে ফেসবুক আপনাকে ব্যবহার করে অর্থাৎ আপনি
.
ফেসবুক/সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্ত।
আমি হলফ করে বলতে পারি শুধু ফেসবুক ব্রাউজিং করে কেউ সফল হতে পারে নি। শো অফ করে কেউ অন্যের কাছে নিজেকে সুখী প্রমাণ করতে চাইলেও প্রকৃত পক্ষে সে সুখী নাও হতে পারে।
আর কেউ যদি এখন সুখী হয়, পরবর্তী সময়ে সে সুখী থাকবে কি থাকবে না, তা আমরা জানি না। উদাহরণস্বরূপ, দেখা গেল কেউ আপনার চেয়ে এখন খুব সুখী কিন্তু কিছুদিনপর তার জীবনে এমন কিছু ঘটলো তাতে মনে হল তার চেয়ে আপনি অনেক সুখী।
তাই অন্যের হ্যাং আউট, শো অফ বা সুখের মুহুর্ত দেখে নিজেকে অসুখী, অসন্তুষ্ট মনে করা শ্রেফ পাগলামি বলেই মনে হয়। আবার একই সময়ে আট-দশজন বন্ধু আড্ডা দিচ্ছেন কিন্তু যে যার মতো অনলাইনে ব্যস্ত। এতে করে কাছের বন্ধু থেকে দূরের বন্ধু অগ্রাধিকার পেল আবার আড্ডার উদ্দেশ্যতেও ব্যত্যয় ঘটলো। যার ফলে কাছের বন্ধুদের মাঝে দুরত্ব ঘটে।
যারা ফেসবুকে আসক্ত তারা এখন কি করতে পারি? কিভাবে এর কু-প্রভাব থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারি ও কিভাবে সুস্থ সামাজিক মাধ্যম তৈরিতে ভুমিকা রাখতে পারি?
★ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম রুটিন অনুযায়ী ব্যবহার করা।
★ দৈনিক দেড় ঘন্টার বেশি অনলাইনে না থাকা।
★ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাপসগুলোর নোটিফিকেশন অফ করে দেয়া।
★ ফেসবুক থেকে বের হওয়ার সময় লগ আউট করে বের হওয়া।
★ সম্ভব হলে সপ্তাহে একদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবেশ না করা।
এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করার সময় যে বিষয় সচেতন থাকা উচিৎ–
★ সঠিক তথ্য নিশ্চয়তার পর তা ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা।
★ অন্যের কোন পোস্ট, ফটো বা ভিডিও এর সত্যতা যাচাই করে শেয়ার বা পোস্ট করা।
★ অপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলো পোস্ট ও শেয়ার করা থেকে বিরত থাকা।
★ কোন পোস্ট বা সংবাদ যদি ভুয়া মনে হয়, তাহলে পোস্টটি সম্পর্কে রিপোর্ট করা।
★ অনলাইনের এমন কিছু বিষয় যা মানুষকে নেতিবাচক দিকে প্রভাবিত করে সে সকল বিষয়গুলো এড়িয়ে চলা।
★ কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না করা।
★ ব্যক্তিগত বা সাম্প্রদায়িক কাউকে হেয় না করা।
উল্লিখিত বিষয়গুলো সম্পর্কে যদি সাধারণ মানুষকে সচেতন করা যায় ও সকলে মেনে চলে তাহলে অনেকাংশে সুস্থ ফেসবুক/সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বাস্তবায়ন করা সম্ভব বলে মনে করি।
.
জাহিদুল ইসলাম পলাশ
শিক্ষার্থী, সরকারি বিএম কলেজ, বরিশাল।