উপজেলা শহরে শিশুদের বিনোদন কেন্দ্রের গুরুত্ব

সাদিয়া কারিমুন ||

নব্বই দশকের ছোট বেলাটা খুব একটা ধরাবাঁধা আর দালানঘেরা হবার সুযোগ পেতনা। কারণ, বাড়ির আশেপাশে বেশ খোলা যায়গা পেতাম বিকেলটা খেলাধুলা আর ঘুড়ে বেড়িয়ে কাটাতে। তখনও এমন মাছের ঘের, আবাদি জমি থেকে শুরু করে সবকিছু ভরাট করে প্লট জমি বিক্রির প্রতিযোগিতা শহরকেন্দ্রীক ছিল।তাই বাণিজ্যিক শহরগুলোর কথা আলাদা। নব্বই দশকের ছেলেমেয়েরা এখনও ছোটবেলার যেসব খেলা খেলত তা মনে পড়লে হারিয়ে যায় স্মৃতির পাড়ায়। খুঁজে ফেরে হারানো সুখ, কখনওছোটবেলাটা ফিরে পাবেনা বলে দীর্ঘশ্বাসে ভাবনার প্রসঙ্গ বদলায়। বাংলাদেশের বেশিরভাগ বাচ্চারাই বড় হয়, উপজেলা, পৌরসভা আর ইউনিয়নকেন্দ্রীক পরিবেশে। এদের পড়াশোনাটাও অধিকাংশই মাধ্যমিক পর্যন্ত এখানেই কাটায়।

বাবা – মা ও কাছছাড়া হতে দেননা। শৈশবের এই মোক্ষম সময় প্রয়োজন সুস্থ বিনোদন আর জ্ঞানমূলক পরিবেশ। যে পরিবেশে শিশু তার ভাবনার গুরুত্ব বুঝবে, বিভিন্ন বইয়ের জানালায় , খেলাধুলায় নিজেকে সজীব রাখবে। কিন্তু উপজেলাসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে শিশুদের সুস্থ মানবিক বিকাশ কেন্দ্র বা পরিবেশের যথেষ্ট অভাব। বরং নেই বললে ভুল হবেনা। ব্যতিক্রম নয় ঝালকাঠি জেলার নলছিটি থানাও। নলছিটি দক্ষিণবংঙ্গের প্রাচীনতম উপজেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম ঐতিহ্যবাহী উপজেলা, এর আয়তন ২১৪.২৪ বর্গঃ কিঃ মিঃ এবং জনসংখ্যা ২,১৪,৪১৮ জন। শহরটা বেশ ছোট, সরু রাস্তায় হাজার গাড়ির সাঁই সাঁই শব্দে হাঁটা দায়। কিন্তু নেই কোন বিনোদন কেন্দ্র, নেই লাইব্রেরি বা শিশু লাইব্রেরি, নেই ঘুরতে যাবার যায়গা। বিকেল হলে শহরের নদীর ধারে কেউ কেউ ঘুরতে বেরোয়, সম্ভব হলে পাশেই বাংলোবাড়িটাতে ঢোকে। সেখানে বাচ্চারা হাসে, খেলে। কিন্তু তা মোট শিশু জনসংখ্যার এক থেকে দুই শতাংশ। একজন মানুষকে মনে প্রাণে আধুনিক এবং উদার হবার জন্য তার ছেলেবেলাটাই শেখা ও জানার প্রথম পর্ব। এসবকথা ভেবে অনেকেই শহরমুখী হচ্ছেন কিংবা সন্তানকে সুস্থ পরিবেশে বড় করার কথা ভেবে বিচলিত।

বেশিরভাগ বাচ্চারাই বাসার গলিতে দৌড়ঝাপ, চেচামেচি আর খেলাধুলা করে থাকে। এতে অনেকসময় প্রতিবেশিরাও বিরক্ত হন এবং সৃষ্টি হয় না না সামাজিক সমস্যার। অথচ যদি সুস্থ স্বাভাবিক ও জ্ঞানচর্চামূলক খেলাধুলা করার নির্দিষ্ট স্থান থাকত, তবে এসব দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার সৃষ্টি হতনা। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ছোঁয়ায় এখন আবাসিক এলাকাগুলোতেও গড়ে উঠছে দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, অফিস আর যানবাহনের আবাস। তাই যায়গা কমে গিয়ে নানা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশও সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়াও অপরিকল্পিত শহরায়ন, ময়লা নিষ্কাশনের অব্যবস্থাপনাও শিশুদেরকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে এ শহরগুলোতে। অনেক অভিভাবকেরই অভিযোগ এই নিয়ে যে, শিশুরা ঘরে থাকলে অবসর পেলেই মোবাইল, পি সি গেমিং এ ডুবে থাকে। কিছু করার নেই দেখে অভিভাবকেরাও এসব দিয়ে শিশুদের মন ভোলাচ্ছেন। অথচ শৈশবে এসব ইলেকট্রনিক ডিভাইস তাদের শারিরীক ও মানসিক বিকাশের কতটা হানি ঘটায়, তা এখন সবার কাছেই পরিষ্কার।

তবু প্রশাসনিকভাবে এগুলোর গুরুত্ব প্রতিফলন হচ্ছে কই? এসব শিশুই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ, আজকের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। যেসমস্ত ক্ষতি এই ডিভাস কেন্দ্রীক জীবন বাড়াচ্ছে তান্মধ্যে শিশুর অবাধ্যতা, অসামাজিক আচরণ, সৌজন্যবোধের অভাব অন্যতম। এগুলো সামাজিক সম্পর্কগুলোকে ম্লান করছে, বাবা মায়ের প্রতি সন্তানের কর্তব্যবোধে বাধা সৃষ্টি করছে। পরিবার হল ব্যক্তির প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কিন্তু আজ তার গুরুত্ব হারাচ্ছে। তাই এসব উপজেলাশহরগুলোতে যদি শিশু বিকাশ কেন্দ্র, শিশুপার্ক কিংবা শিশু লাইব্রেরী চালু করা হয়, তাহলে শিশুদের এই ডিভাইস কেন্দ্রীক জীবনকে একটু প্রাকৃতিক পরিবেশ দেবে। পরিবারের সাথে বেড়াবে, সম্পর্ক মজবুত হবে আর বাড়বে শিশুর সঠিক মূল্যবোধ। মানুষের প্রতি মানুষের দায়িত্ববোধ তাদের মনে জাগ্রত হবে নির্দিধায়।

বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারিভাবে শুদ্ধাচার কৌশলের আওতায় শিশুদের নানা নৈতিক শিক্ষামূলক কার্যক্রম রাখা হচ্ছে; বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। এগুলো থেকে কিছু যদি পরিবারের আওতায় দেওয়া হয়, তাতে পারিবারিকভাবে শিশুরা বেশি সময় কাটাতে পারবে এবং সেইসাথে বিনোদনকেন্দ্রে খেলাধুলাও হবে। যদিও এসবের জন্য সময় প্রয়োজন, বাজেট প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে শিক্ষাক্ষেত্রে বাজেট বর্ধিত করে বিভিন্ন প্রজেক্ট এর মাধ্যমে শিশুর শারিরীক ও মনস্তাত্ত্বিক উন্নয়নকেও শিক্ষার আওতাভুক্ত করা উচিত। একটি দেশ ডিজিটাল হবার সাথে সাথে যদি এর নেতিবাচক প্রভাবটি ভবিষ্যৎ মানবসম্পদের ওপর শীড়দাড়া করে, তবে টেকসই উন্নয়ন কল্পনায় থেকে যাবে অনেকাংশেই। তাই, আমাদেরকে এখনই এসব সমস্যা নিয়ে বিশ্লেষণ করতে হবে, এসব বিষয়ের ওপর গবেষনার সুযোগ তৈরী করে প্রনোদনা দিতে হবে এবং বাজেট সম্প্রসারণ করতে হবে বৈকি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *