একটি ফুলের গল্প

নীলা আহমেদ ।।

জীবনতো বহতা নদীর মতোই বহমান। তার গতি কখনো ভাঁটার জলের মত স্থির শান্ত। কখনো জোয়ারের প্রবল স্রোতে আছড়ে পরা ঢেউয়ের নিরন্তর ছুটে চলা। এমনই এক বিচিত্র বিমুগ্ধ জীবনের নাম ‘সেজুতি’ । পড়ন্ত বিকেলে বেডরুমের জানালায় চোখ রাখতেই বৃষ্টির টুপটাপ শব্দে মন্ত্রমুগ্ধ মন হারিয়ে যায় শৈশবের দূরন্তপনায়। অসম প্রেমের টানে আষাঢ়ের পাগল করা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হারিয়ে গেল শামুক আর ঝিনুকের মিলন মেলায়।

‘ভ্রমর কইও গিয়া…………’ কৃষানের মিষ্টি গানের সুরের মুর্চ্ছনায় বিমুগ্ধ সেজুতি। হিজল বিলে সাদা চাদর গায়ে জড়িয়ে যেন পরীরা নৃত্য করবে শাপলা রাজ্যে। শাপলা, কদম তুলতে আর শামুক কুড়াতে কুড়াতে কখন যে স্কুল ছুটি হয়ে গেছে খেয়াল-ই নেই সেঁজুতির। বাড়ি ফিরতেই বাবার বকুনিতে বুক ধড়ফড় করে ওঠে। পরদিন ক্লাসে ঢুকতেই সিদ্দিক স্যার রেগে আগুন। চোখ ফেটে যেন আগুনের ফুলকি বেরুচ্ছে। বেদম মার খেয়ে সেজুতির পা কেটে রক্ত বের হচ্ছে। কিন্তু ভেজার আনন্দ যেন সব কষ্ট ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দিল। আজও অক্ষত আছে হিজলবিল, লালরঙে ছাওয়া কৃষ্ণচূড়া আর কদম গাছ, সবুজের কার্পেট বিছানো সেই স্কুল মাঠ। শুধু নেই একটি প্রিয় শব্দ, প্রিয় কন্ঠস্বর ‘বাবা’। সবাই জন্মের পর মায়ের হাত ধরে চলতে শেখে আর সেজুতি তার নিজের পৃথিবী চেনে বাবার হাতে হাত রেখে। চলার পথের পাথেয় আর চিরসজীব সঙ্গী ছিলেন ‘বাবা’। ‘মা’ জন্মের পর থেকেই ব্রেইন ক্যান্সারে আক্রান্ত। কখনও হাসে কখনও কাঁদে। কখনও আদর করে কাছে টানে আবার দূরদূর করে তাড়িয়ে দেয়। মনের মধ্যে নাড়া দেয় বাবার হাত ধরে এশহর ওশহর ঘুরে বেড়ানোর সোনালি মুহূর্তগুলো। সেই ইতিহাস খ্যাত হাতেম তাই, সিরাজউদদৌলা, ক্ষুদিরাম কত ঐতিহাসিক কাহিনী, নবীরাসুলদের জীবনী, একাত্তরের হৃদয় কাপাঁনো ভয়ানক সেই যুদ্ধের গল্প। গল্প শুনতে শুনতে বাবার কোলে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখত সেজুতি পাইলট, যোদ্ধা কিংবা বীরাঙ্গনা সখিনা হওয়ার। অনেক ভাই বোনের মধ্যে সে ছিল বাবার নয়নের মনি। তাই বাবা তাকে আদর করে ‘মা’ বলে ডাকতেন। আদরের এই ছোট্ট মেয়ে নিজেই যে কখন ‘মা’ হয়ে উঠল বুঝতে পারেনি।

হঠাৎ এক কাল বৈশাখি ঝড়ে এলোমেলো করে দিল সেজুতির গুছানো জীবনটা। ঢাকা থেকে দেশে ফেরার পথে স্ট্রোক করে পরপারে চলে গেলেন বাবা। এত সুন্দর জীবনের গল্পটি নিমেষেই কাচের টুকরোর মত ভেঙে গেল। বাবার বুকভরা স্বপ্ন ছিল সেজুতি লেখাপড়া শিখে বিসিএস ক্যাডার হয়ে গ্রামের মুখ উজ্জল করবে। অসুস্থ মা আর ছোট ভাই বোনদের নিয়ে অকুল সাগরে পতিত হল সেজুতি। শুরু হল জীবনের কঠিন সংগ্রাম। বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তি বে আইনি ভাবে দখল করল গ্রামের মাতব্বর। অনেক কষ্টে গ্রামের ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়িয়ে এসএসসি শেষ করে একটি সরকারি কলেজে ভর্তি সুযোগ পেল। কলেজ ছিল তাদের বাড়ি থেকে ২৫ কি. মি. দূরে। রাস্তা ঘাট ভালো ছিলোনা বলে যানবাহন ও তেমন চলতো না। বেশির ভাগ সময়ই পায়ে হেটে কলেজে যেতে হত সেজুতিকে। এভাবেই কষ্টের মধ্যদিয়ে এইচএসসি তে ভাল রেজাল্ট করে সে। উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে বিসিএস ক্যাডার হয়ে বাবার স্বপ্ন পূরণ করবে। কিন্তু নিয়তির একী নির্মম পরিহাস ! সেজুতির এক চাচাতো কাকা তাদের পরিবারের দায়িত্ব নিলেন। গ্রামের কিছু কুচক্রী লোক তাকে খোঁচাতে লাগল তারা বলল- ‘বা’ । সেজুতির চাচা আনিস মিয়া ভেবে দেখলেন তাদের কথায় যুক্তি আছে। বিনা পয়সায় বিয়ে দিতে পারলে মাথার বোঝা কমবে। বড়লোক গৃহস্থ ঘর থেকে সম্বন্ধ আসলো সেজুতিকে দেখে পছন্দ হলো ৫৬ বছর বয়সী বিপত্নীক হোসেন মিয়ার। তিনি খুশি হয়ে আনিস মিয়াকে বিশহাজার টাকা উপহার দিলেন। বিয়ের দিন তারিখ স্থির হলো। আনিস মিয়া টাকা পেয়ে খুশিতে আত্মহারা। সেজুতি চাচার পায়ে পড়ে খুব কান্নাকাটি করলো। আনিস মিয়ার পায়ে পড়ে মিনতি করে বলল ‘কাকাগো আমাকে একটু সুযোগ দাও। আমি লেখাপড়া শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। দোহাই তোমার আমার সুন্দর স্বপ্নকে গলাটিপে মেরে ফেলো না। দয়া কর! একটু দয়া কর! কথা শোনার কেউ নেই।

চাচার কঠিন সিদ্ধান্ত বাড়ি থেকে বের করে দেবে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে ‘বাবা তুমি কোথায়? কেন আমাকে একা ফেলে চলে গেলে? আমার যে আর কেউ রইলো না…..বাবা…? ’ বোবা কান্নায় বুকফেটে চৌচির হল কেউ শুনলোনা সে কান্নার শব্দ। ইচ্ছে হল পালিয়ে যাবে- পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে পারলো না। প্রণয়, পরিণয়, স্বামী-সংসার এসব নিয়ে কোনদিন ভাবেনি সেজুতি। তাই বাস্তব জীবনের সুখ, আনন্দ বিরহ দাম্পত্য রোমাঞ্চ কোনটিই তার মনকে নাড়া দিতে পারে নি। মনে মনে শুধু একটাই দাবী ছিল বর অন্ধ, খোড়া, বোবা যেমনই হোক তাকে লেখাপড়ার সুযোগ দিলেই হবে। বিয়ে শেষ কাগজের ফুল দিয়ে বাসর সাজানো হল। অবোধ শিশুর মত নির্বাক চোখে আর নিস্তব্ধ মনে সব অত্যাচার মেনে নিল সেজুতি। সতিনের সংসারে দাম্পত্য জীবন নামক অজানা এক যন্ত্রনার পথে পা বাড়ালো সেজুতি। ধীরে ধীরে তার সুন্দর স্বপ্নগুলো মাটি চাপা পড়ে গেল। সংসারের কাজে একটু সমস্যা হলেই শুরু হয়ে যায় শারীরিকও মানুসিক নির্যাতন। ফুলের মত সুন্দর শরীরটি আঘাতে জর্জরিত ক্ষত বিক্ষত হতে থাকে। লেখাপড়া চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল মেরুদন্ড সোজা করে যেন আর বাঁচতে পারবে না। জীবনটা বিবর্ণ ফ্যাকাশে আর বিষাক্ত মনে হতে লাগল। ষোল বছরের এই ফুটন্ত ফুলটি সমাজের সর্বত্র সুবাস ছড়ানোর আগেই ঝড়ে পড়ল। যেখানে হাসি কান্না, গন্ধ বর্ণ কিছুই নেই আছে বিষাদের গাঢ় নীল বেদনা।

উন্নত তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে এখনও দেশের আনাচে কানাচে অনেক সেজুতির আলো বিচ্ছুরিত হওয়ার আগেই অমানিশার কালো অন্ধকারে হারিয়ে যায়। গন্ধ ছড়ানোর আগেই ফুলের পাপড়ি ঝড়ে যায়। ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে অনেক অজানা তথ্য ছড়িয়ে পড়ে। খবরের কাগজের শিরোনামে চমকপ্রদ অনেক গোপন রহস্য উন্মোচিত হয়। কিন্তু সেজুতিদের জীবনের খবর রাখার ফুরসত কারো নেই। কালের কপোলতলে সমাজ আর সংস্কারের যাঁতাকলে পৃষ্ঠদলিত সেজুতিদের স্বপ্নের ছোট ছোট আল্পনা। আধুনিকতা আর শিল্পবিপ্লবের ছোঁয়ায় এগিয়ে চলছে সমাজ, সমৃদ্ধ হচ্ছে জাতি। ছিন্নমূল নারীজীবনের ছোট ছোট সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনার গল্পগুলো সমাহিত হয়ে যায় পুরুষশাসিত সমাজ আর সংস্কারের দাপটে। তাদের তৃষার্ত হৃৎপিন্ডের আত্মচিৎকার কেউ শোনে না।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *