এক যে ছিল জাফর আলী

বেগম ফয়জুন নাহার শেলী

ষাটের দশকের প্রথম দিকের কথা। তখন আমার বয়স ৭/৮ বছর হবে। বরিশাল ব্রাউন কম্পাউন্ডে একটি রিকুইজিশন বাড়িতে থাকি। তখন ওই এলাকায় হাতে গোনা কয়েকটি বাড়ি ছাড়া সব ঘরই ছিল টিনের। যথারীতি আমাদের বাসাটিও টিনের। তবে বেশ বড় দোতলা। রাস্তার পাশে দুটো কালভার্টসহ প্রশস্ত বারান্দা, এরই দুপাশে ছোট্ট দুটো রুম। একটি অতিথিদের বসার জন্য। তখনকার দিনে একে বলা হত বৈঠকখানা। আরেকটি অনাত্মীয় কোন অতিথি এলে তাকে ঘুমুতে থাকার জন্য। আধুনিক যুগে যাকে বলা হয় গেস্টরুম। তবে অতটা কেতাদুরস্ত নয়। পরে অবশ্য ওই কক্ষটি এ কাহিনীর মুখ্য চরিত্রটির জন্য বরাদ্দ হয়েছিল। নীচের তলায় অনেক জায়গা। একটা বড় হলরুমের মত। সেখানে বড় দুভাই ও খাবার ব্যবস্হা, আরেকটি কক্ষ খালি, একটিতে স্নানের ব্যবস্থা আরেকটিতে রান্নার ব্যবস্থা। যদিও বাইরেও একটা বড় রান্নাঘর ছিল। আর আমরা বাকী আট ভাইবোন ও আব্বা আম্মা থাকতাম দোতলায়। এখানে তিন দিকে রেলিং ঘেরা বারান্দা। আর শৌচাগারটি ঘর থেকে একটু দূরে পরেশ সাগরের মাঠ লাগোয়া। মেথরটানা শৌচাগারের কারণে এ ব্যবস্হা। তখনকার দিনে এমনটিই ছিল। এই হল মোটামুটি আমাদের বাসার চিত্র।
একদিন বাসার বারান্দায় আমি ও আমার সমবয়সীরা কালভার্টে বসে আড্ডা দিচ্ছি। এমন সময় যুবক বয়সের এক ছেলে ঝাড়ু হাতে ঘর থেকে বের হয়ে বলল, ‘এই খোকাখুকিরা একটু সরো তো, ঝাড়ু দিয়ে নেই। ‘বিশুদ্ধ উচ্চারণে ওর ওই কথাগুলো শুনে আমরা তো হেসেই খুন।
এক যে ছিল জাফর আলীর গল্প এখান থেকেই শুরু। কীভাব আব্বা ওকে পেয়েছেন তার কিছুই আমার জানা নেই। আর এ বিষয়ে আব্বাকে কখনো কিছু জিজ্ঞেসও করিনি। কারণ ওকে নিয়ে যে কলম ধরব তা কখনো ভাবিনি। এতদিন শুধু অনেকের কাছে ওর মজার মজার গল্প করেছি কিছু লেখার কল্পনাও করিনি। আজ কেন যেন ওর সাথে আমাদের কিছু টুকরো টুকরো স্মৃতি তুলে ধরতে ইচ্ছে হলো, তাই এ লেখা।
হয়তো দেখা গেল স্যান্ডেল খুঁজে পাচ্ছি না। জাফর আলীকে জিজ্ঞেস করা হল, ‘জাফর ভাই, আমার স্যান্ডেল কোথায়? জাফর ভাইয়ের উত্তর, ‘খুইজ্জা আনো দ্যাহাইয়া দিমু’।
আমাদের বিনোদনের জন্য জাফর ভাই অবসর সময় গল্প শোনাতেন। গল্পের মাঝখানে এসে বলতেন ‘এমনকালে ক্যামন হইলো বেইন্নাকালে রাইত পোয়াইলো। ‘এগল্পের শ্রোতা শুধু আমরাই না। আমরা বন্ধু বান্ধব সবাই আসর জমিয়ে এ গল্প শুনতাম।
জাফর আলীর প্রচুর সিনেমা দেখার (অভ্যেস বললে ভুল হবে, বলা যায় নেশা) নেশা ছিল। শুনেছি আমাদের বাসায় কাজ করার আগে ও নাকী সিনেমার নায়িকা সুলতানা জামানের বাসায় কাজ করত। একদিন সুলতানা জামানের বাসায় কিছু অভিনেতা অভিনেত্রী বেড়াতে এসেছেন। সিনেমা প্রিয় জাফর আলী কাজ ফেলে উঁকি দিয়ে তাদেরকে বার বার দেখছে। এঘটনায় সুলতানা জামান ভীষণ রেগে গিয়ে ওকে মা-বাবা তুলে গালি দিলে চাকরি ছেড়ে চলে আসে।
সিনেমা প্রিয় জাফর আলী সারা দিনের কাজ শেষ করে নাইট শো দেখতে যেত। আমাদের মামাদের পুরনো কোটপ্যান্ট পরে কেতাদুরস্ত সাহেব সেজে জগদীশ (পরে কাকলি) সিনেমা হলে গিয়ে ১৪ পয়সার টিকেট কেটে সিনেমা দেখত। যেটা ভালো লাগতো সেটা যে কতবার দেখত তার ঠিক নেই। ‘বৌজিবাওরা’ সিনেমাটি মনে হয় প্রত্যেক দিন দেখত। যেদিন ও সিনেমায় যেত সেদিন আটটা সাড়ে আটটার মধ্যে আমাদের রাতের খাওয়া শেষ করত। আর যেদিন সিনেমা যেতনা সেদিন রাত ৯টায়ও খাবার দিতনা। বলত, ‘এখনও পড়া শেষ হয়নি, যাও লেখাপড়া কর। ‘বিদ্যুৎ, টেলিভিশনহীন রাত যে কত বড় হতে পারে তা এ যুগের ছেলেমেয়েরা বুঝবেনা। অগত্যা বাধ্যগত ছেলেমেয়ের মত পড়তে বসতাম। এখানে একটা কথা না বললেই নয় তা হল আমার মা বাবা দুজনেই চাকুরীজীবী হওয়ায় ঘরের সিংহভাগ দায়িত্ব জাফর আলীর। ও অনেকসময় সিনেমা দেখে এসে আমাদের অভিনয় করেও দেখাত।
বাসার কাজের পাশাপাশি গ্রীষ্মের দিনগুলোতে ও বরিশাল জিলা স্কুলে পাঙ্খাপুলারের কাজ করত। তখনকার দিনে বরিশালে বিদ্যুৎ ছিল না তাই বৈদ্যুতিক পাখাও ছিল না। শিক্ষার্থীদের বাতাস দেয়ার জন্যে ক্লাসরুমের সিলিংয়ে শীতলপাটির মত পাটি দিয়ে পাখার ব্যবস্থা করা হত। আর পাঙ্খাপুলার সেটাকে টানত। জাফর আলী একদিন করল কি ওর বেতনের সব টাকা একটাকা করে ভাঙ্গিয়ে বিছানার নিচে একটি একটি করে রেখে তার ওপর চাদর বিছিয়ে ঘুমোলো। পরদিন সকালে আম্মাকে বললো, ‘আম্মা, আমি আর বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখবো না। বড়লোকরা টাকার উপর ঘুমায়। কাল আমি টাকার উপর ঘুমিয়ে দেখেছি। একটুও ঘুমাতে পারিনি। এদিক ফিরি টাকা মচমচ করে ওঠে, ওদিক ফিরি টাকা মচমচ করে ওঠে। আর আমার মনে হয়, এই বুঝি চোর এসে আমার টাকাগুলা নিয়ে যাচ্ছে। না আম্মা, আমি আর বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখমু না।বড়লোকরা ঘুমাইতে পারেনা।”
জাফর আলীর বাড়ি ছিল বাবুগঞ্জ। কোন গ্রাম বলতে পারবনা। ছোট ট্রলার জাতীয় একতলা লঞ্চে করে বাড়ি যেত। বাড়ি যাবার সময় একটা ইংরেজি পত্রিকা কিনে নিত। পত্রিকাটির যে পাতায় ছবি নেই সেই পাতাটি সে খুব গম্ভীর হয়ে দেখত। অথচ সে ঠিক করে নিজের নামটাই লিখতে জানতনা। লঞ্চে কেউ তার পেশা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে বলত, আমি জিলা স্কুলের কেরানি।
ইত্যবসরে আব্বা ঝালকাঠি সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হয়ে বদলি হয়ে গেলেন। আমরা আম্মার সাথে রয়ে গেলাম বরিশালে। কারণ আম্মা বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। একদিন রাতে ঝালকাঠি থেকে আবুল বাশার স্যার (আব্বার ছাত্র)বাসায় বেড়াতে এলেন। জাফর আলী তখন সিনেমায় যাবার জন্য সেজেগুজে বেরিয়েছে। ও নিজেকে আমাদের লজিং মাস্টার বলে পরিচয় দিয়ে স্যারকে বাসায় ঢুকিয়ে সিনেমায় চলে গেল। পরদিন ভোরে স্যার যখন দেখলেন ‘লজিং মাস্টার’ তাকে কাজের ছেলের মতো চা পরিবেশন করছে তখন তিনি আম্মার ওপর ভীষণ অসন্তুষ্ট হলেন। মনে মনে ভাবলেন, আম্মা কেমন মানুষ যে লজিং মাস্টারকে দিয়ে কাজ করান। পরে তিনি জাফর সম্পর্কে জানতে পেরে হেসেই খুন।
একসময় আম্মা বি,এড পড়তে ঢাকাতে যাবার কারণে আমরা সবাই ঝালকাঠি আব্বার কাছে চলে যাই। যথারীতি জাফরও আমাদের সাথে। আরও একজন রয়েছে ওর নাম মালেকা। আমাদের গ্রামের মেয়ে। এখানে এসে মালেকা আমাদের দেখভাল করত আর জাফর আলী হল ছেলেদের হোস্টেলের বাবুর্চি। ও খুব ভালো রান্না করত। একদিন এক ছাত্র ওকে জিজ্ঞেস করল,‘জাফর ভাই, আপনার ডিম ভাজি এত ফোলে কেন? আমাদেরটা তো অত ফোলে না। জাফর আলী উত্তরে বলল, আ, জাননা, আমিতো সাবান দিয়ে ডিম ভাজি। সরলমনা ছাত্ররা কথামত সাবান দিয়ে ডিম ভাজল। এরপর আব্বার কাছে নালিশ। আব্বা জাফরকে জিজ্ঞেস করলে ও বলল, ‘আব্বা, আমি কীভাবে বুঝবো যে ওরা আমার কথা বিশ্বাস করবে? রাশভারী মানুষ আব্বা মুচকী হেসে চলে গেলেন।
আরেক দিনের কথা। স্কুলের সুইপার আবদুল জলিল আর জাফর দু’জনে মিলে মালেকার সাথে বাজী ধরল, মালেকা যদি একটা বোম্বাই মরিচ খালি খেতে পারে তবে ওকে কীযেন একটা দেবে বলেছিল ঠিক মনে পড়ে না। বোকা মালেকা মরিচটাকে চার ভাগ করে পানি দিয়ে গিলে ফেলল। ব্যাস আর যায় কোথায়! পেটের যন্ত্রণায় মালেকা সমানে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। জলিলভাই ,জাফর ভাই রশিদ ভাই সবার মুখ কালো। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। আম্মা তো বাসায় নেই। বড়আপা তখন সম্ভবত উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ১ম কি ২য় বর্ষের ছাত্রী। কিন্তু বড় আপা তো! বড় আপা কখনো ছোট থাকেনা। ওরা বড় আপার শরণাপন্ন হল। আপা ওকে বিচিকলা এনে খাওয়াতে বল্লেন। তারপর সুস্থ।
আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণীতেপড়ি। ‘জাউরা’ শব্দের অর্থ কী তা আমার জানা ছিল না। জাফর আমাকে ক্ষেপাত শেলী বেলী বলে আর আমিও ক্ষেপে গিয়ে ওকে জাফইররা জাউরা বলতাম। একসময় আমার মেঝবোন ওই জাউরা শব্দের অর্থ বলে দিলে আর কোনদিন ওকে ওভাবে বলিনি আর ও আমাকে কখনোই ক্ষেপায় নি। সত্যি বলতে কি জাফর আলীর কথা বললে শেষ হয়না।
পরে একসময় আব্বা ওকে বিভাগীয় শিক্ষা উপ-পরিচালকের কার্যালয় চাকুরির ব্যবস্হা করে দেন।
অনেকদিন জাফর ভাইএর সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিল না। জাফর ভাই দুটি সন্তান সহ এক বিধবাকে বিয়ে করেছেন। নিজের সন্তানের পাশাপাশি ঐ বাচ্চাদেরও তিনি পিতৃস্নেহে মানুষ করেছেন।
একদিন ডি,ডি আপার সাথে তার গাড়িতে করে ঢাকা যাবার পথে জাফর ভাইএর গল্প করছিলাম। তখন ড্রাইভার বললো,‘আপা, জাফর আলী ত মারা গেছে। আমি স্তব্দ হয়ে গেলাম।
জাফর ভাই, তুমি আল্লাহর প্রিয় বান্দা হয়ে তাঁর রহমতের ছায়ায় থেকো। আমিন।

বেগম ফয়জুন নাহার শেলী, প্রাক্তন বাংলা প্রভাষক, বরিশাল ইসলামিয়া কলেজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *