কবি আল মাহমুদের বরিশাল সফর

আনোয়ার হোসাইন খান ।।

কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রিশেষে শুভ শুক্রবারে / মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ
অপ্রস্তুত এলোমেলো গৃহের আলো অন্ধকারে / ভালোমন্দ যা ঘটুক, মেনে নেব আমার ঈদ৷ (স্মৃতির মেঘলাভোর)

মহান প্রভু হয়তো তার মনের আকাঙ্খা পুরন করেই ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখ রাতে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদকে নিয়ে গেছেন৷ ১৯৩৬ সালে জন্ম নেয়া ব্রাম্মনবাড়িয়ার মোল্লাবাড়ীর ছেলে মীর আব্দুস শকুর আল মাহমুদ এর জম্মদিন ১১ জুলাই । শুভ জন্মদিনে ক্ষনজন্মা এ মহান কবির সাথে আমার একান্ত স্মৃতি চারণ করা বর্তমান প্রজন্মের জন্য সহায়ক হবে বলে প্রত্যাশা রাখি । বিশেষ করে যারা সুস্থ সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়ার অতন্দ্রপ্রহরী তাদের জন্য আল মাহমুদ আলোর বাতিঘর ।
দুই
শিশুমনেই এ প্রতিথযশা কবিকে চিনেছি ক্লাস থ্রি’র ‘একুশের কবিতা’ ও ‘পাখির কাছে ফুলের কাছে’ কবিতার মত ছন্দময় কবিতার মাধ্যমে, তখন কবিতার ভাব, আল্পনা এবং শৈল্পিক উপস্থাপনা না বুঝলেও অন্যসহপাঠিদের সাথে স্যারের উচ্চ কন্ঠে কোরাসের তালে তালে আওয়াজ করে মুখস্থ করেছিলাম …
প্রভাতফেরী প্রভাতফেরী / আমায় নেবে সঙ্গে
বাংলা আমার বচন / আমি জন্মেছি এ বঙ্গে ।

পরে যখন সংস্কৃতিতে হাতেখড়ি ক্লাস এইট বা নাইনে তখন গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী আমিরুল মোমেনীন মানিক’র সুর করা ‘নোলক’ কবিতা আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে ..এবং সাইমুমের শিশু শিল্পীদের গাওয়া গান ‘আম্মু বলেন পড়রে সোনা আব্বু বলেন মন দে, পাঠে আমার মন বসেনা কাঠাল চাপার গন্ধে .. হ্রদয় ছুয়ে যায় ।

কিন্তু ২০০৯ সালে দক্ষিণ বাংলার ইতিহ্যবাহী সুস্থ ও মননশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন হেরাররশ্মি শিল্পীগোষ্ঠীর দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ৩০ বছর পূর্তি উৎসবে সাবেক সকল সংগঠক, শিল্পী, কলাকুশলি ও শুভানুধ্যায়ীদের মিলন মেলার জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাস্তবায়ন কমিটির  সভায় আধুনিক ইসলামি মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের কবি আল মাহমুদকে প্রধান অতিথি
করার সিদ্ধান্ত সর্ব সম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয় । উৎসব বাস্তবায়ন কমিটির আহবায়ক ছিলেন অধ্যাপক মাহমুদ হোসাইন দুলাল , যুগ্ম আহবায়ক ছিলেন সাংবাদিক আযাদ
আলাউদ্দীন, বরিশাল ওয়েল ফেয়ার ফাউন্ডেশনের তৎকালীন সভাপতি  সাইফুল ইসলাম এবং সদস্য সচিব ছিলাম আমি আনোয়ার হোসাইন খান।

ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে কবিদের স্বরুপ অন্বেষনে সবসময় আগ্রহের কমতি ছিল না আমার। তাই উৎসবের প্রধান অতিথি কবি আল মাহমুদ সম্পর্কে আরও জানার জন্য আগ্রহ তৈরি হয় । তাঁকে যত জেনেছি তাঁর সৃষ্টির সৃজনশীলতা গ্রাম বাংলার সাধারন মানুষের মুখসৃত শব্দের সাহিত্যরুপ তত বুঝেছি।  বাংলা কবিতাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন আল মাহমুদ । তাইতো পশ্চিম বাংলার বিশিষ্ট লেখক ও সাহিত্য সমালোচক শিবনারায়ণ রায় বলেছেন, ’বাংলা কবিতায় নতুন সম্ভাবনা এনেছেন আল মাহমুদ, পশ্চিম বাংলার কবিরা যা পারেনি তিনি সেই অসাধ্য সাধন করেছেন ’। অবশ্যই আল মাহমুদ শুধু কবি হিসেবেই নয়, তিনি একাধারে একজন
শক্তিমান গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, গবেষক, সাংবাদিক ও কলম লেখক। সাহিত্যের অনেক শাখাতেই তার  অবাধ বিচরণ ১৯৭৫ সালে তার প্রথম ছোট গল্প গ্রন্থ ’পানকৌড়ির রক্ত’ এবং ১৯৯৩ সালে প্রথম উপন্যাস ’কবি ও কোলাহল’ প্রকাশিত হয় । তাঁর সৃষ্টির পরিধি সাহিত্যে বিশাল এলাকা জুড়ে। কিন্তু এত কিছু ছাড়িয়ে তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন কবি এবং শুধুই কবি । (সূত্র: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ আনন্দ বাজার পত্রিকা)
কবি জয় গোস্বামী ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বাংলাদেশে এসেছিলেন, আল মাহমুদের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ কে তিনি তীর্থ দর্শন বলে অবিহিত করেছেন ।

তিন

’উৎসবে মাতোয়ারা হয়েছে এ মন / তারই মাঝে খুঁজে ফিরি প্রভুর মনন’
এমন মন মাতানো সৌরভ স্নিগ্ধ শেকড়ের সুধামালা গেঁথেই ৩০ অক্টোবর ২০০৯ সালে হেরাররশ্মি শিল্পীগোষ্ঠী পালন করেছে ৩০ বছর পূর্তি উৎসব । প্রত্যাশা ছিল ১৯৭৮ সালে হেরাররশ্মি প্রতিষ্ঠার অগ্রসৈনিক, বাংলার প্রতিটি জনপদে ইসলামি মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়ার স্বপ্নীল বীরযোদ্ধা, প্রচার বিমুখ কবি, গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী মতিউর রহমান মল্লিক কে প্রধান অতিথি করার, কিন্তু তার শারীরিক অসুস্থতার কারনে কবি আল হাফিজ ও বোরহান মাহমুদ এর অনুরোধে কবি আল মাহমুদ প্রধান অতিথি হয়ে উৎসবে আসার সদয় সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন । কবির আগমনি বার্তা এক মাস পূর্বেই হেরাররশ্মির সাবেক পরিচালক, সাংবাদিক আযাদ আলাউদ্দীন এর মাধ্যমে বরিশালের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ব্যাপক উৎসাহ ও আগ্রহের জন্ম দিয়েছিল, তাই সকল অঙ্গনের সাহিত্য ও সংস্কৃতি মনা কবি সাহিত্যিক এবং জনসাধারন কবিকে বরণ করার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলেন । সাংস্কৃতিক কর্মশালা, শুভাকাংঙ্খি ও শুভানুধ্যায়ীদের সহযোগীতার আশ্বাস গ্রহণ, বাস্তবায়ন কমিটিকে আপডেট প্রদানসহ ব্যাপক কর্মযজ্ঞের মধ্যেও মনের ভিতর মধুময় আনন্দ অনুভূত হত এই ভেবে যে কবি আল মাহমুদ আমাদের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি! এ সুপ্ত বাসনা থেকেই বোরহান মাহমুদকে একমাসে অনেক ফোন দিয়েছিলাম, যেন প্রধান অতিথি আবার মিস হয়ে না যায় ! প্রবীণ কবি আল মাহমুদকে তখন নিয়মিত সাহচর্য দিচ্ছিলেন তরুন কবি আবিদ আজম। দীর্ঘ কয়েক বছর তিনি কবি আল মাহমুদের অন্যতম শ্রুতি লেখক হিসেবে কাজ করেছেন। কবি আল মাহমুদের মৃত্যুর আগে এবং মৃত্যুর পরে তাঁকে নিয়ে এখনো নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন কবি আবিদ আজম। তিনিও কবি আল মাহমুদের সাথে সফর সঙ্গী হিসেবে বরিশালে এসেছিলেন।

চার

অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষন। পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বরিশাল সংস্কৃতিকেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক মাহমুদ হোসাইন দুলাল, পরিচালক আযাদ আলাউদ্দীন, সাবেক পরিচালক আহমদ আল আমিন, শিল্পী এনামুল হক ও জহিরুল ইসলাম এবং বরিশাল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারি কাজী সাইফুল ইসলাম সহ আমরা সবাই বরেণ্য এই গুনি ব্যক্তিত্বকে হেরাররশ্মি’র পক্ষ থেকে খুব ভোরে লঞ্চঘাটে ফুলেল সংবর্ধণা জানাই । একই সময় কবিকে ফুলেল সংবর্ধণা প্রদান করেন শেকড় সাহিত্য সংসদের সভাপতি কবি নয়ন আহমেদ, আল হাফিজ, কামাল আহসান সহ পুরো শেকড় পরিবার, আব্দুর রহমান তপন ফাউন্ডেশন, সাংবাদিক ফোরাম, ফুলকুঁড়ি আসর সহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন । বরিশাল প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকেও কবিকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। ওই সংবর্ধনা সভায় বক্তব্য রাখেন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ব্যুরো চিফ জিএম বাবর আলী, প্রেসক্লাবের তৎকালীন সভাপতি অ্যাডভোকেট এসএম ইকবাল, কবি অরূপ তালুকদার প্রমুখ । বরিশালের অর্ধশতাধিক সাংবাদিক সেই সংবর্ধনায় যোগ দেন।

২০০৯ সালের ৩০ অক্টোবর সেই দুপুরে কবি আল মাহমুদ ও তাঁর সফর সঙ্গীদের জন্য মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেন সাংবাদিক আনিসুর রহমান খান স্বপন। তাঁর বাসায় বাহারি স্বাদের বরিশালের ঐতিহ্যবাহি হরেক রকম খাবারের শৈল্পিক আয়োজন করা হয় । যা দেখে কবি অভিভূত হন। একই সাথে কবি আল মাহমুদ তাঁর তেহরান সফরকালে সাংবাদিক আনিসুরহমান স্বপন ও ফয়জুন নাহার শেলী দম্পতির আতিথেয়তার কথা স্মরণ করেন। উল্লেখ্য সাংবাদিক আনিসুরহমান স্বপন ও ফয়জুন নাহার শেলী দম্পতি ১০ বছর তেহরান বেতারের বাংলা বিভাগে চাকুরি করেন। তখন আল মাহমুদ ইরান সফরে গেলে সেখানেও কবি আল মাহমুদকে যথাযোগ্য মর্যাদায় সম্মাননা প্রদান এবং তেহরান বেতারে তাঁর সাক্ষাৎকার প্রচার করেন তাঁরা।

পাঁচ

সেদিন বিকেলে বরিশাল নগরীর অশ্বিনী কুমার টাউন হলে হেরাররশ্মি শিল্পীগোষ্ঠীর ৩০ বছর পূর্তি উৎসবের ১ম পর্ব আলোচনাসভার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় । শরুতেই আমন্ত্রিত অতিথিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন ও কানায় কানায়পূর্ণ হলরুমের দর্শক স্রোতাদের শুভেচ্ছা জানিয়ে স্বাগত বক্তব্য উপস্থাপন করেন হেরাররশ্মির প্রধান পরিচালক আনোয়ার হোসাইন খান । অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সরকারি বিএম কলেজ ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের চেয়ারম্যান এবিএম আমজাদ আলী।  বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ সংস্কৃতিকেন্দ্রের উপপরিচালক ও চিত্রনায়ক শেখ আবুল কাশেম মিঠুন, বিশিষ্ট সংস্কৃতি ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক সাইফুল্লাহ মানছুর ও কবি আবিদ আজম।

প্রধান অতিথি কবি আল মাহমুদ তাঁর বক্তব্যে বলেন, হেরাররশ্মি সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশে আমাকে তাদের ৩০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত করে ধন্য করেছেন- আমি উচ্চ কন্ঠে বলতে চাই- ‘আগামী শতাব্দী হবে ইসলামের বিজয়ের শতাব্দী’। দেশ মাতৃকাকে ভালোবাসার বন্ধনে আকড়ে ধরার জন্য সকলের প্রতি আহবান জানান এই মুক্তিযুদ্ধা কবি। আলোচনার শেষ দিকে তিনি তাঁর বিখ্যাত ‘নোলক’ কবিতাটি আবৃত্তির মাধ্যমে বক্তব্য শেষ করেন ।

অনুষ্ঠানের সাংস্কৃতিক পর্বটিও ছিলে বেশ উপভোগ্য। সাংবাদিক ও শিল্পী আমিরুল মোমেনীন মানিক, নয়ন মুরাদ, বোরহান মাহমুদ, আহমদ আল আমিন, নূরুন্নবী জনি সহ হেরাররশ্মির সাবেক পরিচালক ও সংগঠকদের সরব উপস্থিতি ও পরিবেশনা দর্শকদের বিমোহিত করে।

কবি আল মাহমুদের উপস্থিতিতে হেরাররশ্মি শিল্পীগোষ্ঠীর ৩০ বছর পূর্তির এই বর্ণিল উৎসব চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

 

কবি আল মাহমুদের বরিশাল সফরের আনকাট ভিডিও দেখুন নিচের লিংকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *