প্রফেসর মো. মোসলেম উদ্দীন সিকদার
মানবতার একমাত্র মুক্তি সনদ মহাগ্রন্থ আল কুরআন নাজিল পূর্বক মহান আল্লাহতাআ‘লা দ্ব্যার্থহীন ভাষায় ঘোষণা দিলেন যে, ‘আমি এ কিতাবে কোন কিছুই বাদ দেইনি’ (সুরা আল আনাম ৬:৮)। সহজ ভাষায় অর্থ এই যে, মানুষের জন্য যা কিছুই প্রয়োজন তার সবকথাই আল কুরআনে উল্লেখিত আছে। দু’একটা দৃষ্টান্ত পেশ করে আল্লাহর এ কথার যথার্ততা প্রমাণ করার প্রয়াস নিচ্ছি। কথিত আছে জনৈকা নিকাব পরিহিতা বৃদ্ধাকে তার ব্যক্তিগত ব্যাপারে এক বুজুর্গেরকরা প্রায় আট/দশটি বা তারও অধিক প্রশ্নের জবাব মহিলা শুধু আল কুরআন থেকেই দিলেন।
আর একটি ঘটনা আহনাফ বিন কায়েস নামক একজন বীর যোদ্ধা ও আরব সর্দারকে নিয়ে। আরবি ভাষায় গভীর পারদর্শী নও মুসলিম আহনাফ কুরআন মাজিদের একটি আয়াত শুনে নিজের মধ্যে উক্ত আয়াতের অস্তিত্ব অনুসন্ধানে ব্রতী হলেন। আয়াতটি হলো ‘আমি তোমাদের কাছে এমন এক কিতাব অবতীর্ণ করেছি যাতে শুধু তোমাদের কথাই আছে। অথচ তোমরা কোন চিন্তা-ভাবনা করোনা। (২১:১০) কুরআনের একের পর এক পাতা উল্টাতে উল্টাতে এক সময় আহনাফ নিম্নোক্ত আয়াতটিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলে উঠলেন আমি যা খুঁজেছিলাম তা পেয়ে গেছি। আহনাফ তার মনের কথা যে আয়াতটিতে পেলেন তা হলো ‘হ্যাঁ তোমাদের মাঝে এমন ধরনের কিছু লোকও আছে যারা নিজেদের গুনাহ স্বীকার করে,ভালমন্দ মিশিয়ে কাজ করেÑ কিছু ভালো, কিছু মন্দ। আশা করা যায় আল্লাহতাআ‘লা তাদের ক্ষমা করে দেবেন। আল্লাহ বড়ই দয়ালু ও ক্ষমাশীল। (৯:১০২)। পবিত্র কুরআনের একেবারে শেষ দিকে আমপারার ১০৬ নং সুরা আল-ক্বুরাইশ আকারে ছোটো বিধায় আমাদের অধিকাংশেরই মুখস্ত।সালাতে প্রায়ই তিলাওয়াত করে থাকি। কিন্তু এই ছোট্ট সুরাটিতে শীত ও গরম কালের কথা রয়েছে তা আমাদের অনেকেরই অজানা।
কী আছে সুরা কুরাইশে
সুরা আল ফিলের সাথে সুরা আল ক্বুরাইশের বিষয় বস্তুর সম্পর্ক রয়েছে। সম্ভবত মক্কী যুগের প্রথম দিকে সুরা আল ফিলের পরপরই সুরাটি নাজিল হয়ে থাকবে। উভয়ই সুরার গভীর সম্পর্ক ও সামঞ্জস্যের কারণে প্রথম যুগের কোন কোন মুফাসসির দুটো সুরাকে মূলত একটি সুরা হিসেবে মত প্রকাশ করতেন। কুলাঙ্গার আবরাহা কর্তৃক মক্কা আক্রমণ যেহেতু রাসুলে করিম (স.) এর জন্মের অনধিক দুই মাস পূর্বের ঘটনা। তাই সবকিছু আরবদের কাছে একেবারে জ্ঞাত বিধায় মনে হতো সেদিনের ঘটনা। এই দুটো সুরাতে তাই উক্ত ঐতিহাসিক ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ বর্ণনা না দিয়ে আভাস ইঙ্গিত দিয়েছেন মাত্র। চার আয়াত বিশিষ্ট এই সূরার বাংলা অনুবাদ হলো এরকম:
১। যেহেতু ক্বুরাইশরা সুপরিচিত হয়েছে। ২। শীত ও গরমকালে সফরের নিরাপত্তার জন্য। ৩। সেহেতু তাদের এই কাবাঘরের মালিকের ইবাদত করা উচিত। ৪। যিনি তাদেরকে খিদে থেকে বাঁচিয়ে খাবার দিয়েছেন এবং ভয় থেকে বাঁচিয়ে নিরাপত্তা দিয়েছেন।
সুরাটির দ্বিতীয় আয়াত:
‘ঈলাফিহিম রিহ লাতাশ শিতায়ি অস সাঈফ’ এখানে উল্লেখ্য আল কুরানের আরবি শীত শব্দটিই আমাদের বাংলা ভাষায় আত্মস্থ হয়েছে, শীতকালিন মৌসুম হিসেবে।
এখন আমরা এই সুরাটিঅবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপট এবং এর তাৎপর্য ও শিক্ষা নিয়ে আলোকপাত করতে চাই।ইতিহাস স্বাক্ষী সপ্তম শতকের শুরুতে বিশ্বের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বাক্কা কিংবা মক্কা শহরে রাসুলুল্লাহ (স.) ইসলামের দাওয়াত নিয়ে আবির্ভূত হলে তাঁর সীমাহীন সবর, হিকমাত ও ত্যাগ কোরবানীর বদৌলতে হাজার বছরের জমাটবাধা আইয়্যামে জাহিলিয়্যাতের আঁধার কেটে ধীরে ধীরে ঐশি আলোর বিকিরণ ঘটতে থাকে। এই সময় প্রচলিত নক্ষত্র, জীব-যন্তু ও মূর্তি পূজা ত্যাগ করে এক আল্লাহর ইবাদাত করার আহ্বান জানালে এ নগরীর সম্ভ্রান্ত ও আখিরি নবী (স.) স্বগোত্রীয় অধিকাংশ কুরাইশরা তা প্রত্যাখ্যান ও বিরোধীতার এক পর্যায়ে তাঁর জানি দুশমনে পরিণত হয়। এ সুরায় মক্কার মুশরিকদেরকে বাইতুল্লাহার ইবাদত করার যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তা বোঝানো হয়েছে।
কাবাঘরপুনর্নির্মাতার দু’আ:
হযরত নূহ আ‘লাইহিস সালাম এর সময় সর্বগ্রাসী প্লাবনে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত ও বালুকাস্তুপে আচ্ছাদিত পবিত্র কাবাগৃহ মিল্লাতে ইব্রাহিম আ‘লাইহিস সালাম ও তাঁর শিশু পূত্র ইসমাইল আ‘লাইহিস সালাম কর্তৃক পুনর্নির্মিত হয়। নির্মাণ কাজ শেষে মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইব্রাহিম আ‘লাইহিস সালাম আল্লাহর দরবাওে যে মুনাজাত করেছিলেন তার সারমর্ম নিম্নরূপ। ‘ হে আমার প্রভু আপনি এ নগরকে শান্তি ও নিরাপদ নগরীতে পরিণত করুণ, আর এর অধিবাসীদেরকে ফলমূল ও বিভিন্ন আহার্য বস্তু এবং যাবতীয় জীবন ধারণ সামগ্রী প্রচুর পরিমাণে দান করে সমৃদ্ধ করুণ। (২:১২৬)
কাবাগৃহ হিফাজতের ঐতিহাসিক ঘটনা:
মহাকাল স্বাক্ষী আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ‘লা তাঁর প্রিয় খলিলের উচ্চারিত দু’আ পুরোপুরি কবুল করে বিশ্বের সকল রাজা-বাদশাহ ও শক্তিধর স্বৈর শাসকদের আগ্রাসী কবল থেকে এ ঘরকে বরাবর সংরক্ষিত ও পবিত্র রেখেছেন। কুরাইশগণ এ ঘরের মূল মালিকের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে এই ঘরে শত শত মূর্তি সংস্থাপন ও পূজা অর্চনা শুরু করে। তা স্বত্বেও এ পবিত্র ঘরের প্রতিবেশী হওয়ার কারণেই আল্লাহতাআ‘লা ষষ্ঠ শতাব্দির শেষার্ধে ইয়েমেনের ক্ষমতাদর্পী স্বৈরশাসক আবরাহার বিশাল হস্তী বাহিনীর ধ্বংস অভিযান থেকে কুরাইশ ও বাইতুল্লাহকে রক্ষা করেছেন। এর ফলে সমস্ত আরব ভূখন্ডে কুরাইশদের সম্মান ও প্রতিপত্তি যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায় । এমনকি তাদের প্রতি ঈর্ষা ও শত্রুভাবাপন্ন গোত্রসমূহের মধ্যেও তাদের সুখ্যাতি ও মর্যাদা বেড়ে গেল। কুরাইশদের কষ্টকর ঝুঁকিপূর্ণ বাণিজ্যিক সফরও তাদের জন্য আরামদায়ক ও নিরাপদ হয়ে গেল। তারা উত্তর-দক্ষিণ ইয়েমেনে ও সিরিয়ার সর্বত্রই লাভজনক বাণিজ্যিক সফরে আসক্ত হয়ে পড়লো। সাইয়েদেনা হযরত ইব্রাহিম আলাই হিস সালামের দু’আ তাদের বাস্তব জীবনে আল্লাহ কিভাবে প্রতিফলিত করেছেন তার অনুপম নজীর স্থাপিত হলো। স্মর্তব্য সেকালে বাইতুল্লাহর মোহাফিজ, বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহ আলাই হিস সালাম এর দাদা ও কুরাইশ গোত্রপতি খাজা আবদুল মুত্তালিব নিরস্ত্র অবস্থায় স্বশস্ত্র আধিপত্তবাদী শক্তির বিরুদ্ধে আল্লাহর সাহায্য চেয়ে যেভাবে সফলকাম হয়েছিলেন আজকে আমরা যেনো সেই সর্ব শক্তিমাণ আল্লাহর উপরে ঈমানীয় ও ইয়াক্বিনি মজবুতি দিয়ে সকল দেশী ও বিদেশী আধিপত্যবাদী শক্তিকে প্রতিহত করতে পারি বা মোকাবেলা করতে পারি।
সুরা আল কুরাইশের শিক্ষা:
উপরোক্ত আলোচনায় সুরাটির শিক্ষা ও তাৎপর্য সংক্ষেপে কিছুটা আলোচিত হয়েছে। নিম্নে আরো কয়েকটি দিক নির্দেশনার প্রয়াস নেয়া হলো।
০১। রাসুলুল্লাহ সা. মক্কার সম্ভ্রান্ত কুরাইশ গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন বিধায় আমরা শৈশব থেকে তাদের সম্পর্কে সু-ধারণা পোষণ করি। নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের অহংকারে কুরাঈশ তথা আরব মুসলিমরা যদি এসব ঐতিহাসিক শিক্ষা ভুলে যান তাহলে এই মূল মালিকই তাদের মর্যাদা ও মাতুব্বরী কেড়ে নিবেন। (ইতিপূর্বে তুর্কী আধিপত্যের কথা স্মরণযোগ্য)
০২। কুরাইশ গোত্রে বীর কেশোরী হযরত আলী (রা.) ও সাইয়েদুস শুহাদা হযরত হামজার মত বীরের পাশাপাশি আবু জেহেল আবু লাহাবের মতো ধিকৃত কুলাঙ্গার কুরাইশ বংশে জন্ম গ্রহণ করেন এবং নানাভাবে জেনে দুশমনি করেন। আলো-আধার, হক-বাতিলের এ চিরন্তন দ্বন্দ্ব অবস্থান ও বাস্তবতা সামনে রেখে আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে।
০৩। বাইতুল্লাহ-আল্লাহর ঘর বিশ্ব মুসলিমের জন্য মহান নিয়ামত, হিদায়াত ও আন্তর্জাতিক মিলনকেন্দ্র (আরাফাত) তার শুকরিয়া আদায়কল্পে আমাদেরকে সর্বদা আল্লাহর পথে চলতে হবে এবং হজ্জ ফরজ হওয়া মাত্র তা অবিলম্বে আদায় করতে হবে। বলা বাহুল্য সৌদি সরকার ও আরববাসীর জন্য হজ্জ্ব ও ওমরাহ একটি মর্যাদাকর ও আর্থিক সম্মৃদ্ধির উৎস বটে।
০৪। প্রত্যহ সালাতের মধ্যে বাইতুল্লাহ ও তাঁর রবের মহান নেয়ামতের কথা স্মরণে রেখে সালাতে এ সুরা বেশি বেশি তিলাওয়াত কাম্য।
০৫। যাবতীয় বালা মসিবত ও বৈশ্বিক মহামারি থেকে অব্যহতি পেতে এই সুরা সর্বদা পড়া আবশ্যক। তাফসিরে বর্ণিত আছে ‘যে ব্যক্তি জান-ই শত্রুতা কিংবা বিপদের আশংকা করে তার জন্য সুরা কুরাইশ তিলাওয়াত হিফাতের রক্ষা কবজ।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, সরকারি গৌরনদী কলেজ, বরিশাল