ফরহাদ মজহার
ক্রকোডাইল টিয়ার্স বা ‘কুমিরের অশ্রু’ নামে একটি প্রবাদ আছে। নরম্যাল ফিঙ্কেলস্টাইন ক্রকোডাইল টিয়ার্স কথাটিকে আরো তুমুল অর্থপূর্ণ করে তুলেছিলেন। তাঁর একটি সভায় একটি ইহুদি মেয়ে হোলোকস্ট বা নাৎসিদের হাতে ইহুদি নিধনের জন্য কান্নাকাটি করে ফাঁপা আবেগ তৈরি করতে চাইলে তিনি পরিষ্কার বলেন, এই সব ক্রকোডাইল টিয়ার্সে তাঁর মন গলবে না। হোলকস্টের কথা যারা বলে কিন্তু প্যালেস্টাইনী জনগণের বিরুদ্ধে ইহুদিবাদী ইসরাইয়েলের নির্যাতন ও হত্যার কথা বলে না তাদের চোখের পানি কুমিরের চোখের জল ছাড়া কিছুই না। যদি আমরা একরামের হত্যাকাণ্ডে বিচলিত হয়ে থাকি তাহলে এযাবত সংগঠিত সকল আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রতি আমাদের অনুভূতি ও আবেগও প্রবল হতে হবে। রাষ্ট্রের দ্বারা গুম হয়ে যাওয়া মানুষ ও ক্রসফায়ারে নিহত সকল ঘটনাই গভীর ভাবে বিচার করে দেখতে হবে। একরাম হত্যার ঘটনা মানুষের আবেগকে নাড়া দিয়েছে। কিন্তু একরামের জন্য অশ্রুপাত যেন ক্রকোডাইল টিয়ার্স না হয়।
বিরাট ঘটনা যে একরামের পরিবার অন্তত প্রমান করতে পেরেছেন সমাজে কোন ব্যক্তি বিচ্ছিন্ন কেউ নন, প্রত্যেকেরই মা বাবা পরিবার পরিজন আত্মীয় স্বজন রয়েছে। গুলির শব্দে একরামের স্ত্রী ও কন্যার আর্তনাদ মানুষের বুকে এসে বিঁধেছে। একরামের হত্যার প্রতিবাদ জানাবার সুবিধা আছে। এক. তিনি আওয়ামী লীগ করতেন, ফলে তার পক্ষে কথা বলার অর্থ আওয়ামী সমবেদনার আবরনটুকু পাবার সুবিধা। দ্বিতীয় সুবিধা, এটা বোঝা যাচ্ছে তিনি মাদক ব্যবসায়ে যুক্ত কেউ ছিলেন না। তৃতীয়ত একরামের হত্যাকাণ্ড একজন স্নেহপ্রবণ বাবার হত্যাকাণ্ড হিশাবে হাজির হয়েছে। কোন মাদক ব্যবসায়ীর নয়। এটাও বোঝা যাচ্ছে স্থানীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের মধ্যে আভ্যন্তরীণ কোন্দল রয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে থাকাও বিচিত্র নয়।
তথাকথিত ক্রসফায়ারে হত্যা নতুন কিছু নয়। সিরাজ সিকদার হত্যার মধ্য দিয়ে এর শুরু। এরপর ‘চরমপন্থি’দের হত্যা করা হয়েছে। এরা ছিলেন বাম বিপ্লবী রাজনীতি বা কমিউনিস্ট রাজনীতির ধারক। বিপ্লবী রাজনৈতিক ধারা মনে করে ধনি শ্রেণির শাসন মূলত সহিংস রাষ্ট্রের আইন শৃংখলা বাহিনী, মিলিটারি এবং বিচার ব্যবস্থার দ্বারা পরিচালিত মজলুমের বিরুদ্ধে নিত্য দিনের যুদ্ধ ও সহিংসতা; এ ছাড়া কিছুই নয়। বুর্জোয়া স্কুল কলেজের গরিব বিরোধী শিক্ষাব্যবস্থা যে মতাদর্শ তৈরি করে তাতে দেশপ্রেম, সামাজিক শৃংখলা ইত্যাদির নামে সহিংস রাষ্ট্রের বশ্যতা মানাই শেখানো হয়। ফলে সন্ত্রাসী রাষ্ট্রকে সামরিক কায়দায় মোকাবিলা ছাড়া নিপীড়িতের বা গরিবের মুক্তি নাই।
বিপ্লবী রাজনীতির রণকৌশল সঠিক কি বেঠিক সেটা ভিন্ন তর্ক। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রের সন্ত্রাস নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিশেষ তর্ক নাই। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও সহিংসতা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ধারণার মধ্যেই নিহিত। সার্বভৌম ক্ষমতা হচ্ছে যে কোন নাগরিককে স্রেফ বায়োলজিতে পরিণত করার ক্ষমতা, অর্থাৎ রাষ্ট্রের নাগরিকদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেবার সার্বভৌম ক্ষমতা। এই ক্ষমতার চর্চা হয় আইনী মোড়কে। যেমন, ‘জরুরি অবস্থা’। তিনিই সার্বভৌম যিনি আইনের মধ্যে থেকেও আইনের বাইরে থাকেন। কারন তিনি আইনী ভাবেই জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে নাগরিকদের নাগরিক অধিকার আইনী প্রক্রিয়ায় হরণ করতে পারেন। আগে মনে করা হোত ‘জরুরি অবস্থা’ একটি বিশেষ অবস্থা মাত্র। এখন দর্শন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সামনের সারির ভাবুকরা বলছে মোটেও তা না। আধুনিক রাষ্ট্রের ভিত্তিটাই সার্বভৌম ক্ষমতার ওপর দাঁড়ানো। ফলে আধুনিক রাষ্ট্রে মধ্যে আইনী সুরক্ষার আবরণ বা পোশাক খুলে পড়া এবং মানুষের ক্রমশ ল্যাংটা জীব হয়ে যাওয়া অনিবার্য ঐতিহাসিক পরিণতি। ফলে জরুরি অবস্থা কোন বিশেষ অবস্থা নয়। বরং এটাই আধুনিক রাষ্ট্রের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। এই অবস্থা রাষ্ট্রকেন্দ্রিক চিন্তা, সাররবভৌমত্বের ধারণা কিম্বা কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা বহাল রেখে অতিক্রম করা যাবে না। ক্ষমতা ও সমাজ নিয়ে নতুন ভাবে ভাবতে হবে।
জীবের জীবন হরণ করবার ক্ষমতার সঙ্গে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার ধারণা ও প্রয়োগ অজানা কিছু নয়। রাষ্ট্র জীবন দিতে পারে না, কিন্তু মৃত্যুদণ্ড দিয়ে জীবন হরণ করতে পারে। তবে আধুনিক গণতান্ত্রিক বা লিবারেল রাষ্ট্র এই মৌলিক তর্ক আড়াল করে রাখতে পারে গঠনতন্ত্র, আইন ও বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নাগরিক অধিকার সমুন্নত রেখে ও নিশ্চিত করবার চেষ্টার মধ্য দিয়ে। যেমন নিদেনপক্ষে মেনে যে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে এবং আদালতে প্রকাশ্য বিচারে অভিযোগ প্রমাণ ছাড়া আইনবহির্ভূত হত্যা দূরের কথা, শাস্তিও দেওয়া যাবে না। রাষ্ট্রে কেউই ল্যাংটা জীব (bare life) না, বরং প্রত্যেকেই রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্র এবং আইনের আবরণ (legal protection) দ্বারা তৈরি ‘নাগরিক’। নাগরিকতার আইনী ধারণা রাষ্ট্রের স্বেচ্ছাচার থেকে রক্ষা পাবার একটা সাময়িক উপায় মাত্র। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ভিক্টিমের পক্ষে দাঁড়িয়ে নাগরিক ও মানবিক অধিকার আদায় করবার চেষ্টা সে কারণে আকাশকুসুম আদায় করার নামান্তর হয়ে ওঠে।
বর্তমান শতাব্দির শুরুতে পাশ্চাত্য যখন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ শুরু করল তখন ‘চরমপন্থি’দের জায়গায় তথাকথিত ‘ইসলামি জঙ্গি’রা হত্যার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হতে শুরু করল। বাংলাদেশ ব্যতিক্রম নয়। ফলে নানান রাজনৈতিক আদর্শের ইসলামি জঙ্গি ক্রসফায়ারে কিম্বা পুলিশি হেফাজতে মরতে থাকল যাদের নামও আমরা এখন আর মনে রাখি নি। ‘চরমপন্থি’ ও ‘ইসলামি জঙ্গি’দের হত্যার ক্ষেত্রে গণসম্মতি আদায় করা সহজ ছিল, কারণ এদের সম্পর্কে যে দানবীয় ভাবমুর্তি মিডিয়া তৈরি করে তাতে সমাজের অধিপতি শ্রেণি এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয় যে এদের ‘নির্মূল’ করা সমাজে শান্তিশৃংখলা রক্ষার জন্যই আবশ্যক। হত্যার পরিপ্রেক্ষিত তৈরির জন্য মিডিয়া প্রবল ইসলাম ভীতি ও ইসলাম বিদ্বেষ প্রচার করে। বাংলাদেশে এক এগারোর মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা আরও মজবুত হবার পর ক্রসফায়ারের লক্ষ্যবস্তু হিশাবে হাজির হোল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামি, ছাত্রদল ও শিবির কর্মীরা। দুই হাজার সালের ৫ই মে শাপলা চত্ত্বরে হেফাজতের সমাবেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও হত্যার ঘটনা ভুলে যাবার নয়। এদের হত্যাকে ন্যায্য প্রমাণ করবার জন্য ফ্যাসিস্ট রাজনীতি ও মিডিয়া খুবই পরিচিত একটি প্রপাগাণ্ডার আশ্রয় নেয় তা হচ্ছে এরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি নয় এবং ইসলামি জঙ্গীদের মতো এরাও সন্ত্রাসী। ফলে এদের নাগরিক অধিকার থাকা না থাকা কোন বিষয়ই নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সন্ত্রাসের যুক্তিতে তাদের নাগরিক অধিকারের প্রশ্নকে অনায়াসেই আড়াল করে ফেলা যায়। বলাবাহুল্য, এই কেচ্ছা জনগণ পুরাপুরি বিশ্বাস না করলেও ক্ষমতাসীনদের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের গুম ও হত্যা অভিযান অব্যাহত ভাবেই পরিচালিত হয়েছে। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ রাষ্ট্রী সন্ত্রাস ও সহিংসতা অব্যাহত রাখতে ভালই কাজে লেগেছে।
ইসলামি জঙ্গির পর এখন চলছে মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান। লিবারেল বা ন্যূনতম গণতান্ত্রিক নীতি হচ্ছে আইন ও বিচার প্রক্রিয়ার বাইরে হত্যা দূরের কথা, কোন শাস্তিও দেওয়া যাবে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ রীতিমতো ল্যাংটা হয়েই ক্রসফায়ারে নেমেছে। রাষ্ট্রের গায়ে আর কোন আব্রু নাই।
একথা তাহলে মনে রাখতে হবে একরাম ছাড়াও বাংলাদেশে আরও যাদের গুম করা হয়েছে, পুলিশি হেফাজতে কিম্বা ক্রসফায়ারে, তাদেরও স্ত্রী পুত্রকন্যা পরিবার আত্মীয় স্বজন আছে। তারাও আর্তনাদ করে কেঁদেছে এবং এখনও কাঁদে। কিন্তু তাদের বুকফাটা চিৎকারের কোন অডিও ক্লিপ নাই। তাই আমরা শুনি নি। একরাম হত্যার অডিও ক্লিপ আমরা যখন শুনব তখন সকল আইন বহির্ভুত হত্যার কথা আমাদের মনে রাখতে হবে। যেসব হত্যার অডিও ক্লিপ নাই সেই সবের আর্তনাদও যেন আমরা শুনবার ক্ষমতা লাভ করি।
যারা ভাবুক তাঁদের নতুন ভাবে সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্র সমাজ ইত্যাদি নিয়ে ভাবতে হবে। ক্রকোডাইল টিয়ার্স আমাদের কোত্থাও নেবে না।
২ জুন ২০১৮। শ্যামলী।
[Source, Onno Ek Diganta, Ramkrishna Mission Raod, Dhaka-1203, July 2018, Page 12-14]