রুবি বিনতে মনোয়ার
রাহেলা বেগম চমকে আকাশ থেকে পড়লেন। এ কি করে সম্ভব! একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি! বার বার যুথিকে একই প্রশ্ন করছেন, একই উত্তর দিতে দিতে যুথির ক্লান্ত লাগছে, সে আবারও একই উত্তর দিয়ে এক গ্লাস পানি খেল।
যুথিকে শখ করে ছেলের বউ করে ঘরে তুলেছেন রাহেলা বেগম, বাল্যসইয়ের মেয়ে। এই যে তাদের বিয়ে হল, সংসার হল, দুই বান্ধবীর ছেলেমেয়েরাও বড় হল, কিন্তু তাদের বন্ধুত্বে ভাটা পড়েনি।
যুথীর রুমে মহিলারা গিজগিজ করছিল ঘটনার পরে, রাহেলা বেগম সবাইকে বের করে দিয়েছে।
সেইম ঘটনা রাহেলার নিজের ক্ষেত্রেও ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে। যুথির মত সেদিন রাহেলারও বউভাত ছিল। এর আগের দিন বিয়ে হয়ে নতুন এসেছে শ্বশুরবাড়ী, তখন বেলা ১১টা হবে, রাহেলার শাশুড়ী রাহেলাকে গোসল করতে বলে গেলেন। বিয়ে বাড়ী কতজন আসছে যাচ্ছে, তবে রাহেলার রুমে কেউ আসেনি, সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। রাহেলা বাথরুমে ঢোকার আগে গায়ের ভারী গয়নাগুলো খুলে রেখেছিল লেদারে। এমন সময় বোরখা পড়া একজন এলেন, বললেন ‘তুমি নিশ্চয়ই কিছু খাওনি! এদের কাণ্ডই এমন। এই নাও বাটিতে কিছু খাবার রান্না করে এনেছি, গোসল করে খেয়ে নিও। কখন খেতে দেবে ঠিক ঠিকানা নেই, আজ তো আবার বউভাত’। রাহেলা মহিলাকে পায়ে ধরে সালাম করে। বাটিগুলো হাতে দিয়েই মহিলা চলে যায়। রাহেলা ভাবে, আহা এত ভাল মহিলা, নিশ্চয়ই এদের আত্মীয় কেউ হবে, নতুন বউ তাই আগ বাড়িয়ে পরিচয় নেওয়া হল না। মহিলা একটু তোতলিয়ে কথা বলেন। রাহেলা বাথরুমে ঢুকে গোসল সেরে তাড়াতাড়িই বের হয়ে আসে। নতুন বউ, যাতে কেউ বদনাম করতে না পারে। রাহেলার গোসল সারার পর প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিল, গতরাতেও সে তেমন কিছু খেতে পারেনি। রাত একটায় কি খাওয়া যায়। মশলার গন্ধে খিদেটা জেগে উঠল আরও। মাংস আর পরটা, রাহেলা একটা পরটা খানিকটা মাংস দিয়ে খেয়ে নিয়ে চুপচাপ বসে রইল।
রাহেলার ননদ আর বান্ধবীরা একটু পরেই এল রাহেলাকে সাজাতে। সারাক্ষণ তারা রাহেলার সাথেই ছিল, কেবল একটু আগে রাহেলার গোসলে যাবার আগে তারা সাজানোর কিছু আইটেম আনতে বাইরে গিয়েছিল। সাজানো শুরু হলে এক পর্যায়ে তারা গয়না চাইল। রাহেলা লেদারে হাত দিয়ে থ। একটা গয়নাও নেই, খালি বাক্সটা পড়ে আছে। রাহেলার ননদ ঝুমু বারবার বলছে, ‘ভাবী কই রেখেছিলে বল’। রাহেলার এক কথা, সে গয়না খুলে লেদারে রাখা বক্সে রেখেছে। ‘কেউ কি এসেছিল ঘরে?’ ‘নাহ্’— রাহেলার উত্তর। এ কান ও কান হয়ে সারাবাড়ি রটে গেল, নতুন বউয়ের গয়না খোয়া গেছে।
এই গয়না খোয়া যাওয়ায় রাহেলাকে কম গঞ্জনা সইতে হয়নি। রাহেলার বাবা আবার গয়না গড়িয়ে দিয়েছিলেন।
রাহেলার শাশুড়ি বাটির ভেতর মাংস পরটা দেখে জানতে চেয়েছিলেন, কে দিয়েছে এসব। রাহেলার জবাব ছিল ‘একজন বোরকা পরা মহিলা, একটু তোতলায়, উনি বললেন আপনাদের আত্মীয়, আমি গোসলে যাবার আগে উনি এসে এগুলো দিয়ে গেছেন। পরনের বোরকা নীল রঙের ছিল। সারাবাড়ি খুঁজেও নীল রঙের বোরকাওয়ালী কেউ খুঁজে পায়নি, গয়নাও আর পাওয়া যায়নি।
রাহেলা বেগম যতটুকু জানতে পারলেন, আজ যুথির রুমে নীল রঙের বোরকা পরা এক মহিলা খাবার নিয়ে এসেছিলেন ঠিক গোসলে যাবার আগে, যুথি যখন গয়না খুলে স্টিলে রাখছিল, রুমে তখন কেউ ছিল না। ঠিক এর পর পরই মধুমাখা কণ্ঠে কেউ একজন খেতে বলেছিল খাবারের বাটি দিয়ে, মহিলার কণ্ঠ তোতলা, বাটি দিয়েই মহিলা চলে যায়। যুথির খিদে পেয়েছিল তাড়াহুড়োয় স্টিলে চাবি দিতে ভুলে যায়। গোসল শেষে যুথি একটা পরটা ও মাংস ভুনা খেয়ে কাপড় চেঞ্জ করে, একটু পরই পার্লারে যেতে হবে সাজের জন্য, ভাবল গয়নাগুলো পরে নিই। তখনই দেখে গয়নার বাক্স উধাও। বিয়েবাড়িতে কত মহিলাই বোরকা পরে আসে, সবুজ কালারের বোরকা পরা কাউকে দেখা গেল না। নাই নাই, রাহেলা বেগমের শাশুড়ী বেঁচে আছেন, তিনি বকতে লাগলেন রাহেলা বেগমকে, কেন সে নতুন বউকে সাবধান করল না।
রাহেলা এবং তার ছেলের বউ দুজনেই গয়না খুইয়েছে বউভাতের দিন। কোনো রকমে সিটিগোল্ড পরিয়ে বউভাতের অনুষ্ঠান চালানো হল। যুথির বাবা অবশ্য আরেক সেট গয়না মেয়েকে গড়িয়ে দিলেন। কিন্তু গয়না কে নিল, তার কোনো হদীস পাওয়া গেলনা।
কইতরী বেগম, খুবই এলেমদার মানুষ, কথা ভীষণ মায়ামাখা, হাতে তসবী থাকে সবসময়। ইনি রাহেলা বেগমের চাচাতো শ্বশুরের দিক দিয়ে জা লাগেন। অবশ্য রাহেলার শ্বশুরবাড়ির সবাই মুসল্লী টাইপের। মোটামুটি শরীয়ত মেনে চলেন সবাই।
কইতরী বেগমের বয়স হয়েছে, রাহেলারও। রাহেলার শাশুড়ী বেঁচে নেই।
কইতরী বেগমের ছেলেরা বেশ আয় রোজগার ভালই করে। পুরনো বাড়ীটা ভেঙে ডুপ্লেক্স বাড়ী গড়া হবে। তাই কাজ চলছে। পাশাপাশি বাড়ী, তাই সবাই দূর থেকে উৎসাহের সাথে কাজ দেখছে। পুরনো ভিটের মাটি সরিয়ে নীচে ঢালাই করার জন্য, পিলার পোঁতার জন্য মাটি সরানো হচ্ছে। হঠাৎ করেই টং করে একজনের কোদালের বাড়ি লেগে শব্দ হল। সে বড় মিস্ত্রীকে ডাক দিল, কইতরী বেগমের ছেলেরা এবং উৎসুক প্রতিবেশী আত্মীয়রাও এল। মাটির নীচ থেকে জং ধরা, মরচে পড়া একটি ট্রাংক বের হয়ে এল। রাহেলা বেগমের ছেলেরাও পাশে ছিল, ট্রাংক কোদালের এক বাড়িতেই ভেঙে গেছে, ট্রাংকের ভেতর সোনার অলংকার ঝলমল করছে। টিনের ট্রাঙ্কে মরচে পড়েছে, কিন্তু সোনায় তো মরচে পড়ে না।
দেখতে দেখতে আত্মীয় স্বজন পাড়াপড়শীর ভিড় লেগে গেল, রাহেলা বেগম নিজের ও ছেলের বউয়ের অলঙ্কার দেখেই চিনতে পারলেন। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা, কিন্তু এতটা বছর চলে গেছে, সম্পর্কের বন্ধন, প্রয়োজনের তাগিদ সবই বদলে গেছে।
এখন কী আর বিচার চাওয়া কিংবা প্রতিশোধ নেওয়া যায়? রাহেলা বেগম তখন যেমন আল্লাহর উপর বিচারের ভার ছেড়ে দিয়েছিলেন, আজও তাই করলেন। গয়না কইতরী বেগমই কি গয়না সরিয়েছিল? কিন্তু সেতো তোতলায় না, সে কি বোরকা বদল করেছিল? হয়ত ওই সময়গুলোতে সে ইচ্ছে করে তোতলার অভিনয় করেছিল, বোরকাও এক ফাঁকে বদল করেছিল। এই সমাজে বোরকার আড়ালে, তসবীর আড়ালে, ধর্মকে ঢাল করে চুরি ডাকাতি অপকর্ম করার উদাহরণতো কম নয়। এই গয়না দিয়ে সে কী করেছিল? তার কোনো কাজেই লাগে নাই, তবে এই এত বছর পর গয়না চোর ধরা পড়েছে, সবার সামনে, এটাই সান্ত্বনা, কারণ নীল রঙের বোরকাটিও ওই টিনের বাক্সে পাওয়া গেছে, আর এটির দৈর্ঘ্য কইতরীর বেগমের মাপ মতই, কারণ কইতরী ছিল গড়পড়তা মেয়েদের উচ্চতার চেয়ে অনেক লম্বা।
পুলিশ এল, গয়নাগুলো নিয়ে চলে গেল, পারিবারিক সম্মানের কথা ভেবে ঘটনা সবাই চেপে গেল। এরকমই হয়, এই সমাজে পারিবারিক কারণে অনেক চোর, অনেক অপরাধীর দোষ ঢেকে রাখা হয়, বিচার হয় না। তবে বিধাতার বিচার ঠিকই অপেক্ষা করে এই চোরগুলোর জন্য।