গল্প : চেষ্টার সফলতা

দিল আফরোজ রিমা ।।

ছোট ছোট সুন্দর মুরগীর বাচ্চাগুলো দেখতে বেশ লাগছে। রুবাইয়া ভাবে কোথায় ওদের মা বাবা, কোথায় আছে ওরা। মানুষের জন্য ওদের কত বড় সেক্রিফাইস। ওরা আমাদের জন্য জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ওদের জীবনটা কিভাবে বিলিয়ে দেয়। রহস্যভরা আল্লাহ তায়ালা আর রহস্যময় তার সৃষ্টি বৈচিত্র। সকল প্রশংসা তারই জন্য।
রুবাইয়ার মনে পড়ল, বাবাকে ঔষধ খাওয়ানো হয়নি। সে ভাবে, জমিলার মা এলেই ওকে খামারের কাজে লাগিয়ে দিয়ে বাড়িতে যেতে হবে। বাবাকে ঔষধ খাওয়াতে হবে। মা মারা যাওয়ার পর বাবা কেমন যেন হয়ে গেছে। খাবার খেতে চায়না। ঔষধ খেতে চায়না , শিশুর মত কাঁদে।
অসুস্থ বাবা ছাড়া সংসারে রুবাইয়ার আর কেউ নেই।
একা হাতে খামারের সমস্ত দায়িত্ব পালন করে। বাইরের কাজ, খামারের বাচ্চা আনা, বাচ্চা বড় হওয়া পর্যন্ত তাদের খাবারের ব্যবস্থা করা, ভ্যাকসিন দেওয়া। বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে বাচ্চাগুলোকে বড় করে তোলা একটি চ্যালেঞ্জ। জমিলার মা অনেক কাজ করে দেয়। তবে রুবাইয়া যা করে তা একজন পুরুষ মানুষের কাজ। বাচ্চা বড় হলে বিক্রির ঝামেলাতো আরো বড়। এক কথায় কাজগুলো করতে তার খুব কষ্ট হয়। এদিকে খামারের টাকা দিয়েই সংসার চলে। আর কোন আয় রোজগার নেই। তবে দরকারও নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স মাস্টার্স করা মেয়ে রুবাইয়া । পশুপালন নিয়েই পড়াশোনা করেছে। সেসব নিয়ে সে এখন গবেষনা করছে। তার ইচ্ছে গরুর খামার করার। এখন সাহস পাচ্ছে না ।
মা জোহরা খাতুন মারা যাওয়ার আগে ভাবতেন, মেয়ের বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। একটি ভাল ছেলে দেখে বিয়ে দিতে পারলে শান্তি পেতাম। মেয়ের একটি বড় ভাই বোন কিছু নেই। বাবা বৃদ্ধ। কে দেখবে ওকে। মেয়েকে এভাবে একা রেখে চলে যেতে চাননি জোহরা বেগম।
জীবনঘাতি ক্যান্সার তাকে মৃত্যুর দোরগোরায় পৌছে দিল। অসুস্থ অবস্থায় শরীর এবং মনের কষ্টে ছটফট করেছেন তিনি। মেয়েটা বড় একা হয়ে যাবে এই কথা ভেবে সারাক্ষণ চোখের পারি ফেলতেন । রুবাইয়াকে বলতেন- মা তোকে একা রেখে আমি মরতে চাইনা। তোর জন্য কিছুই করে যেতে পারলাম নারে মা।
-রুবাইয়া মাকে সান্তনা দিয়ে বলত, মা আমি একা কোথায় ? আল্লাহ আছেন তো। তার উপর ভরসা কর। তিনি সব ভেবে রেখেছেন। আমাদের সব সময় আল্লাহর ফায়সালা মেনে নেওয়া উচিত। সেটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
-মাগো, দিন কাল ভালনা। যখন তখন যাচ্ছেতাই হচ্ছে। তোকে কে আগলে রাখবে। তোর জীবনের কোন নিরাপত্তাই রইল না।
-মা, কে বলেছে আমার জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই। আল্লাহ আছেন। আমি তার দেওয়া নিয়ম মেনে চলি। তারই কাছে আমার সকল চাওয়া। তার উপর আমার আন্তরিক ভরসা। আমার নিরাপত্তাতো তিনিই দিবেন। তাছাড়া আমি মেয়ে, কিন্তু অবলা নই। আমি আত্মরক্ষার কৌশল জানি। আর আমি জানি আল্লাহ সব সময় আমার পাশে আছেন। তুমি এখনই মরে যাবে একথা ভাবছো কেন? আমি তোমার নেক হায়াত চেয়েছি আল্লাহর কাছে। তিনি বান্দার প্রার্থনা কবুল করে থাকেন।
জোহরা খাতুন সময়মত তার গন্তব্যে একদিন চলে গেলেন।
একদিন রুবাইয়া তার অফিস রুমে চেয়ারে বসে খামারের টাকা পয়সার হিসেব করছে এবং খাতায় লিখছে। এমন সময় এক যুবক এসে-‘হেলপ মি’, বলে তার অফিস রুমে ঢুকে তার পায়ের কাছে পড়ে যায়। তার পিছনে অনেক লোকজন। এরা রুবাইয়ার গ্রামের লোক। এদের কারো হাতে ঝাড়ু, কারো হাতে লাঠি। সবাই ছেলেটাকে মারার জন্য অফিস রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। কেউ কেউ ঢুকার চেষ্টা করে। রুবাইয়া দু-হাত উচু করে ওদের থামিয়ে দেয়। সে বলে- আপনারা থামুন। একজন মানুষ আমার কাছে সাহায্য চেয়েছে। আপনাদের কাছে মাফ চাইছি ওকে আর মারবেন না।
-সবাই একসাথে বলল- ছেলেটিকে তুমি বের করে দাও। ও খুব খারাপ। তোমার ক্ষতি করতে পারে।
রুবাইয়া খেয়াল করে দেখল, ছেলেটির শরীর রক্তে ভেজা। বিভিন্ন জায়গায় কেটে গেছে। ঠোটের কোনে, কপালের পাশে রক্ত ঝড়ছে। সে অজ্ঞান হয়ে গেছে।
গ্রামের মানুষগুলো রুবাইয়াকে খুব ভালবাসে। তার কথা শুনে। সে সবাইকে বলল, ছেলেটা যতই খারাপ হোক, মানুষতো। ও এখন খুব অসহায়। আমার কাছে সাহায্য চেয়েছে। আমি ওকে বিপদে ঠেলে দিতে পারিনা। তাছাড়া আল্লাহ আছেন। আপনারাতো আছেনই । আমি নিজেও আত্মরক্ষার কৌশল জানি। চিন্তা করবেন না। আমার কোন ক্ষতি ও করতে পারবে না। বরং আমরা ভাল ব্যবহার করি ও ভালও হয়ে যেতে পারে। ওর চিকিৎসার দরকার। আমার অফিসের ভিতরের রুমটিতে একটি ছোট খাটিয়া আছে। আপনারা দু-জন এসে ওকে ধরে ওখানে শুইয়ে দিন। ডাক্তার ডাকতে হবে। আপনারা কেউ যান, ডাক্তার ডেকে আনুন। জমিলার মা আছে। ওকে সেবা করে সারিয়ে তুলবে।
গ্রামের কিছু মানুষ রুবাইয়ার দিকে খারাপ ইঙ্গিত করে চলে গেল। অন্য সবাই বলল, ঠিক আছে মা আমরা তোমাকে সাহায্য করছি।
দু’জন ছেলেটিকে ধরে অফিস রুমের খাটিয়ায় শুইয়ে দিল। একজন ডাক্তার ডেকে আনল। ততক্ষণে ছেলেটির জ্ঞান ফিরে এসেছে। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। আর বলছে আপা আমাকে বাঁচান। আমাকে আপনারা জানে মারবেন না। আমায় মাফ করে দিন। আমি ভাল হতে চাই বিশ্বাস করুন আপনারা। রুবাইয়া বলল, আপনি শুয়ে থাকুন। কোন ভয় নেই। ডাক্তার এসেছেন আপনাকে দেখবেন। চুপচাপ শুয়ে থাকুন।
ডাক্তার ছেলেটিকে দেখে শরীরের বেশ কয়েকটি জায়গায় ব্যান্ডেজ করে দিলেন। পায়ে গুলি লেগেছিল তবে ভয়ের কিছু নেই । গুলি বেরিয়ে গেছে। ডাক্তার ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন। কিছু ঔষধ লিখে দিলেন। একজন ঔষধ কিনে আনল। জমিলার মা ওকে এক গ্লাস গরম দুধ খাইয়ে ঔষধ খাওয়াল। আর বলল- চিন্তা করোনা ব্যাটা আমি আছি। আমি তোমার মায়ের মত।
জমিলার মার কথা শুনে ছেলেটি চোখের জলে ভাসল। বলল, আপনারা এত ভাল মানুষ। একটি খারাপ মানুষের জন্য এত কিছু করছেন।
জমিলার মা বলল- আর কথা নয়, চুপ করে শুয়ে থাকো বাছা।
জমিলার মার কথামত ছেলেটি চুপ করে শুয়ে রইল। গ্রামের একজন রুবাইয়াকে বলল, মা ভয় পেয়োনা। আমরা তোমার সাথে আছি। রাতে তোমার অফিস রুমে আমরা একজন থাকবো, তুমি নিশ্চিন্তে বাড়িতে গিয়ে ঘুমাতে পার।
রুবাইয়া খুব খুশী হল। বলল- আপনারা আমাকে এত ভালবাসেন চাচা? অনেক অনেক শুকরিয়া।
-তোমাকে ভাল বাসবো না কেন মা, তুমি গ্রামের গরীব মানুষদের নিয়ে এত চিন্তা করো। গ্রামের সব মানুষকে তুমিওযে খুব ভালবাসো।
চাচা দেশের অনেক কিশোর কিশোরী যুবক এবং যুবতী মেয়েরাও সঠিক গাইডলাইনের অভাবে, বেশি টাকার প্রভাব, আর্থিক অনটন, বাবা মায়ের অবহেলা এবং ভালবাসার অভাব ও বিভিন্ন পরিস্থিতির কারনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নষ্ট করছে সমাজও। সমাজের মানুষের বিপদের কারন হয়ে দাড়াচ্ছে ওরা। আমি জানি না ছেলেটি ভাল না খারাপ। আর খারাপ হলেও কি কারনে তাও জানিনা। তবে আমি ওকে ভাল হওয়ার সুযোগ করে দেব। যেহেতু আমার কাছে সাহায্য চেয়ে হাত পেতেছে। আপনারা আমার পাশে থাকলে আমি সব পারবো । ইনশা আল্লাহ। আমি জানি আল্লাহ আমার পাশেই আছেন।
জমিলার মা গরম পানিতে কাপড় ভিজিয়ে ছেলেটির রক্তমাখা গা পরিস্কার করে ক্ষত জায়গাগুলোতে ঔষধ লাগিয়ে দিল। রুবাইয়ার বাবার আগের রেখে দেওয়া শার্ট প্যান্ট ছেলেটাকে পড়তে দিল। ছেলেটা মনে মনে ভাবল, এমন যত্ন আমাকে কেউ কোনদিন করেছে বলে আমার মনে পড়ে না। দুদিন কেটে গেল। ছেলেটা মোটামুটি সুস্থ। গ্রামের মানুষগুলো রুবাইয়াকে বলে- ও এখন চলে যাক।
এমন সময় ছেলেটি জমিলার মাকে বলল- আমি একটু আপার সাথে কথা বলতে চাই। কথাগুলো বলে আমি চলে যবো।

রুবাইয়া অফিস রুমে গিয়ে বসে। ছেলেটি অপেক্ষা করছিল কথা বলার জন্য। রুবাইয়া ওকে অন্য একটি চেয়ারে বসতে বলল। তারপর জিজ্ঞাসা করে- আপনার নাম কি?
-ছেলেটি উত্তর দেয়- সোহান চৌধুরী।
– বাসা কোথায়?
-ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায়।
-বাবার নাম ?
-ঢাকা শহরের বিশিষ্ট শিল্পপতি আরমান চৌধুরী আমার বাবা।
-আপনি এখানে অন্য একটি জেলায় একটি প্রত্যন্ত গ্রামে কেন এসেছেন?
-সেটাইতো এক বিরাট গল্প। আপনি শুনবেন আমার জীবনের কথা? কেউ কখনো শুনেনি। আপনি শুনবেন? আপনিতো খুব ভাল।
-বলুন।
-আমি যখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। সেই সময় একদিন আমার মা আমাকে স্কুলে দিয়ে বাসায় ফেরার সময় রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। তখন থেকে কাজের বুয়া রাবেয়া খালার কাছেই আমার সবকিছু। খাওয়া গোসল আবদার সব কিছুই। বাবা তার ব্যবসা নিয়ে ভিষণ ব্যস্ত । আমাকে কখনো সময় দেয়নি। দিয়েছে টাকা। অঢেল টাকা। ধীরে ধীরে বড় হলাম মা বাবাকে কাছে না পাওয়ার ভিষণ কষ্ট নিয়ে। মনের কষ্টে দিন কাটত আমার। মনে হতো আমার মত অনাথ এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই।
এক সময় খারাপ কিছু সঙ্গী জুটে গেল আমার জীবনে। তারা আমার টাকা দিয়ে নানারকম মজা করত। যা ইচ্ছে তাই করত। আর আমাকেও ওদের পথে টেনে নিল। আমিও মনের কথা বলার মানুষ আর দুঃখ ভুলার উপায় খুজে পেলাম। মদ, গাজা সবই খেয়েছি। অনেক খারাপ কাজ করেছি। ওদের কিছুই হয়নি। আমিই জেল খেটেছি। বাবা আমাকে ছাড়িয়ে এনেছে আর বলেছে, ভাল হতে পারলে আমার পরিচয়ে আমার ছেলে হয়ে থেকো। তা না পারলে আমার আঙিনা হতে দুর হয়ে যেও। ভাল হওয়ার চেষ্টা করি। রাবেয়া খালাকে বলি, খালা আমি ভাল হতে চাই। আমাকে আর খারাপ হতে দিওনা তুমি। মা মারা যাওয়ার পর তুমি ছাড়া আর কেউ আমাকে ভালোবাসেনি। তুমি তোমার কাছে আমাকে আগলে রেখো।
তখন আমার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা সামনে। আমি বাবাকে বললাম, অনেক দিন কলেজে যাইনি। তুমি আমার সাথে একবার কলেজে চল। আমার পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থাতো করতে হবে।
-বাবা বলল- তোমার মত কুলাঙ্গারের সাথে আমি কলেজে যাব ? তুমি ভাবলে কি করে ? কলেজের শিক্ষকদের সাথে তুমি আমার মান সন্মান বিকিয়ে দাওনি? সেখানে আমি যাব ? কখনো না। পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছে থাকলে নিজেই ব্যবস্থা করে নাও। চেকটা নাও প্রয়োজনমত টাকার অংক বসিয়ে নিও। আমার সাইন করা আছে অসুবিধা হবে না।
আমি কলেজে যাচ্ছি । চেকটা আমার পকেটেই ছিল। কলেজে বেশ কয়েক মাসের বেতন বাকী পড়ে আছে। তাছাড়া ফরম ফিলআপ এর ব্যাপার আছে। তাই আগেই ব্যাংকে না গিয়ে কলেজে যাচ্ছিলাম সব কিছু জানার জন্য। রাস্তায় আমার সাথীদের সাথে দেখা হয়ে গেল। আমার গাড়ী থামিয়ে ওরা উঠে বসল আমার গাড়ীতে। আমার হাত পা বেঁধে ফেলল। ড্রাইভারের মাথায় বন্ধুক ঠেকিয়ে ওদের ইচ্ছে মত অন্য জায়গায় গাড়ীটা নিয়ে গেল। আমাকে একটি ঘরে নিয়ে গিয়ে অনেক মারল। আমিও প্রথম ওদের সাথে কিছুক্ষণ লড়েছিলাম। তারপর আর পারলাম না। অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকি। রাতের অন্ধকারে আমার জ্ঞান ফিরলো। বুঝতে পারলাম একটি অন্ধকার ঘরে আমি পড়ে আছি। উঠার চেষ্টা করলাম। পারলাম না।
সেই অন্ধকার গলিতে মদ গাজা খেয়ে খারাপ সঙ্গীদের সাথে খারাপ কাজে লিপ্ত হয়ে কেটে গেল অনেক গুলো বছর। এমন জীবন আমার আর ভাল লাগছিল না। অন্ধকার জীবন থেকে আলোর পথে আসার জন্য আমার মন ব্যাকুল হয়ে উঠল। এক সকালে সুযোগ বুঝে বের হলাম। দৌড়াতে থাকলাম। দৌড় আর দৌড়। ভাবলাম মরি আর বাঁচি আমি আর ওখানে ফিরে যাব না। দৌড়াতে দৌড়াতে একটি গুলি এসে লাগল আমার পায়ে। গুলিটা আবার অন্য দিক দিয়ে বের হয়ে গেল। ঐ অবস্থায় ট্রেনে উঠলাম। প্রচুর রক্ত ঝড়ছিল পায়ে। কিছুদুর যাওয়ার পর ট্রেনের টিকেট চাইলে দিতে পারলাম না। ভাড়া বাবদ কোন টাকাই দিতে পারলাম না। পকেটে কোন টাকা ছিল না। তাছারা পায়ের রক্ত দেখে আমার জন্য কোন মায়া দেখায়নি বরং আমি খারাপ ভেবে তাড়াতাড়ি ট্রেন থেকে আমাকে আপনাদের এই ষ্টেশনে নামিয়ে দিল। নেমে ক্ষুধায় অস্থির হয়ে এক দোকানির কাছে কিছু খাবার চাইলাম। টাকা ছাড়া কোন খাবার দিল না। তাই আমি জোর করেই দোকানের রুটি তরকারি নিজে হাতে নিয়ে খাচ্ছিলাম। আসলে আমিতো একজন খারাপ মানুষ এর চেয়ে অনেক খারাপ কাজ করার আমার অভ্যাস আছে। যাহোক দোকানদার ততক্ষণে অনেক মানুষ জড়ো করে ফেলেছে। তারা আমাকে অনেক মেরেছে। প্রাণটা হাতে নিয়ে পাগলের মত দৌড়াচ্ছিলাম। তারপর এখানে এসে আশ্রয় পাই আপনার পায়ের কাছে। আমি বাঁচতে চাই। আমাকে আপনারা তাড়িয়ে দিবেন না। আমি মানুষ হতে চাই। একজন ভাল মানুষ। আর কিছু নয়। আমি যে কোন কাজ করতে রাজি। আমি আর অন্ধকার জীবনে ফিরে যেতে চাইনা। চাইনা বড়লোক বাবার বিগড়ে যাওয়া ছেলে হতে।
মাতো সেই ছোট বেলায় চলে গেছে। আর আছে একজন। যাকে কখনো ভুলতে পারি না। সে হলো রাবেয়া খালা।
আপা সব খারাপ ছেলেরা ইচ্ছে করে খারাপ হয় না। আমি খুব খারাপ। ভয়ংকর খারাপ। আমাকে ঠাই দেওয়া সহজ নয়।
-আপনি যেহেতু ভাল হওয়ার জন্য এত চেষ্টা করছেন আর আমি একজন মানুষ হয়ে আর একজন মানুষকে ভাল হতে সাহায্য করবো না এ হতে পারে না। আমি আপনাকে ভাল হওয়ার সুযোগ করে দেব। আর আল্লাহকে ডাকুন। ইসলামেই আছে সকল কিছুর সমাধান আর সুন্দর করে বেঁচে থাকার মূলমন্ত্র। আপনি যদি সত্যিই ভাল হতে চান আমি আপনাকে সঠিক গাইডলাইন দিয়ে সাহায্য করতে পারি। আমার গ্রামের কিছু মুরব্বী আছেন আমি তাদের সাথে আলাপ করে দেখি। আপনাকে আমি খামারের কাজ দিতে পারি। জমিলার মা যে কাজগুলো করে সেই কাজগুলোই আপনাকে করতে হবে। জমিলার মা কি কি করে, দেখেছেন নিশ্চয়ই। তবে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিশ্রম করে সৎ উপার্জনের দুটি টাকার দাম অনেক বেশি। এতে বিবেকের কাঠগড়ায় নিজেকে আসামী মনে হবে না। বরং মাথা উচু করে চলার ব্যবস্থা হবে। সৎ ভাবে কাজ করলে জগতে কোন কাজই ছোট নয়।
-আপা আমার কোন অসুবিধা নেই। আমি এই কাজই করব।

গ্রামের চেয়ারম্যানের বাড়িতে সোহানের থাকার জায়গা হলো। সেখানেই তার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। ভোরে উঠেই সে চেয়ারম্যান বাড়ির কিছু কাজ করে নাস্তা খেয়ে খামারে চলে আসে। সন্ধার পরে তার কাজ শেষ হয়। চলে যায় চেয়ারম্যান বাড়িতে। সেখানে তার জন্য কিছু কাজ জমে থাকে।
এত বড় একজন শিল্পপতির ছেলে ভাল হওয়ার জন্য সৎ ভাবে জীবন চালানোর জন্য একজন দিনমজুরের জীবন বেছে নিয়েছে। এই ব্যপারটা দেখে রুবাইয়া মুগ্ধ হয়। সোুহানের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করে। তাকে নামাজ পড়া, কোরান পড়ার জন্য একজন মাদ্রাসার শিক্ষকের ব্যবস্থা করে দেয়। সুহান রুবাইয়ার সব কথা শুনে চলে। সে ধীরে ধীরে একজন সৎ মানুষে পরিনত হয়।
কেটে যায় দুটি বছর। রুবাইয়ার বাবা মারা যান। সোহানের সহযোগীতায় মুরগীর খামার আরো বড় হয়েছে। সাথে গরুর খামারের ব্যবস্থা হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তিতে গরু পালন হচ্ছে। রুবাইয়ার মুরগী এবং গরুর খামারে গ্রামের দুস্থ কিছু মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও হয়েছে। সোহান মজুর থেকে ম্যানেজারের পদ পেয়েছে। ইতিমধে সে বি.এ পাশ করেছে। এম. এ পড়ছে। রুবাইয়ার গবেষনা শেষ হয়েছে। পুরাদমে চলছে মুরগীর খামার। খামারে নতুন নতুন প্রজাতির মুরগী পালন হচ্ছে। ধীরে ধীরে মুরগী এবং গরু ছাগলের খামার বেড়েই চলছে। আর সেখানে গ্রামের বহু অসহায় মানুষ সংযুক্ত হয়েছে। এটাই ছিল রুবাইয়ার স্বপ্ন।
সোহান নিজেকে শুদ্ধ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। সাহায্য করেছে রুবাইয়া। এক সময় সেও রুবাইয়ার মত একজন ঈমানদার মানুষে পরিনত হয়েছে। এতটা দিন চলে যাওয়ার পরেও সে পর্দার আড়ালে ঢাকা রুবাইয়ার মুখটি কখনো দেখার লোভ করেনি। বরং সে রুবাইয়াকে সম্মান করেছে।
দুজনেরই বয়স হয়েছে। দুজনের বয়স প্রায় একই। তাই গ্রামের চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন মুরুব্বী মিলে সোহানের সাথেই রুবাইয়ার বিয়ে দেয়। ওরা সুখী হয়। দুজন মিলে গ্রামের মানুষদের পাশে নিয়ে আগামী দিনের জন্য নতুন স্বপ্ন দেখে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *