খোকন আহম্মেদ হীরা
ব্রিটিশ শসনামলে বাংলার মানুষের রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে যেসব মনীষী সংগ্রাম করে গেছেন তাদের মধ্যে হাশেম আলী খানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অবিভক্ত বাংলার কৃষি, শিক্ষা, সমবায় ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী খান বাহাদুর হাশেম আলী খানের নাম বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই জানেন না।
তবে বরিশাল তথা দক্ষিণ বাংলার প্রবীণ ব্যক্তিদের কাছে খান বাহাদুর হাশেম আলী খান এখনও সর্বজনপ্রিয় একটি নাম। স্মৃতির সরোবরে চির অম্লান শ্বেত শতদল মানুষের মানস গগনে চির উজ্জল জ্যোতিস্ক। বাংলার কৃষক প্রজা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ও মহাননেতা ক্ষণজন্মা পুরুষ হাশেম আলী খান ১৮৮৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বরিশাল জেলার স্বরূপকাঠি থানার সেহাঙ্গল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মৌলভী আরমান আলী খান ও মা পেয়ারা বানু।
হাশেম আলী খানের পূর্বপুরুষ ইব্রাহিম লোদীর বংশধর ছিলেন। ১৫২৬ খৃষ্টাব্দে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে সম্রাট বাবরের কাছে ইব্রাহিম লোদীর পরাজয়ের পর লোদী বংশের অনেক সদস্য পূর্ববাংলায় আশ্রয় নেয় এবং পরবতীকালে বাধ্য হয়ে মোগলদের অধীনে চাকরি গ্রহণ করে। আদিতে তারা পাঠান বংশোদ্ভূত হলেও বাংলার মাটি, আলো, বাতাস ও ভাষা সংস্কৃতির সাথে মিশে গিয়ে তারা খাঁটি বাঙালি পরিবারে পরিণত হয়।
হাশেম আলী খান গ্রাম্য পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর ১৯০৬ সালে দক্ষিণ বাংলার প্রসিদ্ধ বিদ্যাপীঠ বরিশাল জিলা স্কুলে ভর্তি হন এবং বেল ইসলামিয়া হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতে থাকেন। বরিশাল জেলার অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব খান বাহাদুর হেয়ামেয়ত উদ্দিন বেল ইসলামিয়া হোস্টেল প্রতিষ্ঠা করেন। ছাত্রজীবনেই হাশেম আলী রাজনীতিবিদ ও শিক্ষা সংস্কারক হেমায়েত উদ্দিন ছাড়াও বরিশালের অন্যতম জননেতা শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এবং অশ্বিনী কুমার দত্তের সান্নিধ্যে আসেন এবং তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হন। হাশেম আলী খান যখন এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেন সে সময় ভারববর্ষে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে।
এসময় ব্রিটিশ সরকারের দমন নীতির বিরুদ্ধে বরিশালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের ডাক দেয়া হয়। তখনকার বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ব্যারিস্টার আব্দুর রসুল, আব্দুল হালিম. গজনবী, মতিলাল ঘোষ, বিপিন চন্দ্র পাল, অরবিন্দু ঘোষ, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন।
ব্রিটিশদের কঠোর দমননীতির কারণে বরিশালে প্রাদেশিক সম্মেলন ব্যর্থ হয় কিন্তু এ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সমগ্র ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বিরোধী রাজনৈতিক উত্তাপ বৃদ্ধি পায়। একইসাথে বরিশাল স্বদেশী আন্দোলনের দুর্গে পরিণত হয়। অশ্বিনী কুমারের নেতৃত্বে তখন বরিশাল থেকেই আন্দোলনের ডাক আসে। হাশেম আলী খানসহ বরিশালের ছাত্রসমাজ এ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
ওই সময় বরিশাল অঞ্চলে ‘স্বদেশ বান্ধব সমিতি’ গঠিত হয় এবং ক্রমশ এ সমিতির প্রভাব সমগ্র বরিশাল অঞ্চলে ছড়িয়ে পরে। বরিশাল এলাকায় এর ২৫০টি শাখা গঠিত হয়। চারণ কবি মুকুন্দ দাসের দেশগান এ আন্দোলনকে আরও চাঙ্গা করে তোলে। এ আন্দলোনে যোগদান করে হাশেম আলী খান অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার ব্যাপারে উৎসাহিত হন। ১৯১৪ সালে দেশসেবার ব্রত নিয়ে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, অশ্বিনী কুমার দত্ত ও স্যার আশুতোষ মুখার্জির উৎসাহে হাশেম আলী কলিকাতার শিক্ষা জীবন শেষে বরিশালে আসেন এবং এ কে ফজলুল হকের পরামর্শে ১৯১৫ সালে প্রজা সমিতি গঠন করেন।
বরিশাল বারে যোগদান করার পর কিছুদিনের মধ্যে আইনজীবী হিসেবে হাশেম আলী খানের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পরে। তিনি বরিশালের কংগ্রেস রাজনীতির সাথে যুক্ত হন এবং অল্পদিনের মধ্যে তিনি বরিশাল কংগ্রেসের অন্যতম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এ সময় সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ‘স্বামী প্রজ্ঞানান্দ’ নাম ধারণ করে বরিশালে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী আন্দোলন শুরু করেন। ঢাকার বিক্রমপুরের পরেই বরিশাল বিপ্লবী কর্মকান্ডের শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয়। এছাড়া দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ, ফেগুরায়, গোপালকৃষ্ণ ও সঙ্গীন সেন প্রমুখ ব্রিটিশ বিরোধী এ বিপ্লবী কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত হন। তারা গ্রেফতার হলে প্রণোদিত হয়ে হাশেম আলী খান তাদের মুক্ত করার জন্য আইনি সহায়তা যুগিয়েছেন।
খেলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনে হাশেম আলী বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। বরিশালে আশ্বিনী কুমার দত্ত অসুস্থ হয়ে পরলে খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের দায়িত্ব পরে জননেতা হাশেম আলী খান ও শরৎকুমার ঘোষের উপর। হাশেম আলী খান গ্রাম-গঞ্জে গিয়ে অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে জনসাধারণকে সম্পৃক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তার সক্রিয় ভূমিকা পালনের ফলে এসব আন্দোলন বরিশাল অঞ্চলের জনগনের মাঝে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। তাছাড়া বরিশালে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রক্ষার ক্ষেত্রে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন। হাশেম আলী খানের কর্মতৎপরতা ও প্রজ্ঞাশীলতায় মহাত্মা গান্ধী মুগ্ধ হন এবং ১৯২৫ সালে গান্ধী যখন দ্বিতীয়বারের মতো বরিশালে আসেন তখন তিনি হাশেম আলী খানের বাসায় উঠেন। উভয় নেতার মধ্যে দেশের সাম্প্রদায়িক সম্পর্কোন্নয়নে আলোচনা হয়।
১৯২০ সালের মধ্যে হাশেম আলী খান বরিশালের সেরা উকিল হন। সারাযুক্ত বাংলায় মহাআলোড়ন সৃষ্টিকারী বরিশালের আমজেদ-অরুনাবালা এবং মহী-শোভনার দুইটি মোকদ্দমা পরিচালনায় খান বাহাদুর হাশেম আলীর গৌরব বাংলার দিকে দিকে ছড়িয়ে পরে। তিনি যেখানে যখন যে আদালতে মোকদ্দমা পরিচালনা করতেন সেখানেই সৃষ্টি হতো জনারণ্য। সবাই আদালত ভবনে তার মামলা পরিচালনা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন।
খান বাহাদুর হাশেম আলী খানের নাতী প্রবন্ধ লেখক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বাংলাদেশ-জাপান ফ্রেন্ডশীপ অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান আমিরুর ইসলাম খান বুলবুলের লেখা থেকে জানা গেছে, হাশেম আলী খান ১৯০৬ সালে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে এন্ট্রান্স পাশ করেন। তিনি ১৯০৮ সালে কলিকাতা মাদ্রাসা থেকে এফএ এবং ১৯১০ সালে বিএ পাশ করেন। ১৯১৩ সালে তিনি রিপন কলেজ থেকে বিএল পাশ করে কলকাতা আলীপুর কোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯১৪ সালে বরিশাল বারে যোগ দিয়ে প্রজা আন্দোলন শুরু করেন। তিনি বাকেরগঞ্জ জেলা কৃষক প্রজা সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
১৯২০ সালে তিনি জেলা খেলাফত কমিটির সম্পাদক হিসেবে খেলাফত আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের নেতৃত্বে তিনি ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করেন। ১৯২১ সালে আগৈলঝাড়ায় কৃষক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন খান বাহাদুর হাশেম আলী খান।
১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে বরিশালে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯২১ সালে অশ্বিনী কুমার দত্তকে সভাপতি করে প্রথম জেলা কমিটি গঠন করা হয়। হাশেম আলী খান ওই কমিটির প্রচার ও সাংগঠনিক সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯২১ সালের ২ সেপ্টেম্বর মহাত্মা গান্ধীর হিন্দী ও মওলানা মোহাম্মদ আলীর উর্দু বক্তব্য বাংলায় অনুবাদ করে জনসভায় শুনান খান বাহাদুর হাশেম আলী খান। ১৯২৭ সালের ২ মার্চ ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার কুলকাঠি গ্রামের একটি মসজিদের সামনে ২৫ জন মুসলমানকে হত্যার ঘটনায় তিনি দায়ের করা মামলা পরিচালনা করেন।
১৯২৭ সালের মে মাসে বরিশালে অনুষ্ঠিত মুসলিম কনফারেন্সের অভ্যর্থনা কমিটির সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯২৮ সালে তার নেতৃত্বে বরিশালে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়। এতে উভয় সস্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ হ্রাস পায়। তখন খান বাহাদুর হাশেম আলী খানকে হিন্দু-মুসলমানের মিলনের অগ্রদূত বলা হতো। ১৯৩০ সালে তিনি বরগুনা জেলার গৌরিচন্না গ্রামে অনুষ্ঠিত প্রজা সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯৩৪ সালে তিনি বরিশালের প্রতাপশালী জমিদার চৌধুরী মোহাম্মদ ইসমাইল খানকে পরাজিত করে বরিশাল থেকে বঙ্গীয় আইন সভার এমএলসি নির্বাচিত হন।
১৯৩৫ সালে গভর্নর জেনারেল ওয়েলিংটনের কাছ থেকে খান বাহাদুর উপাধী লাভ করেন। ১৯৩৬ সালে তিনি বাকেরগঞ্জ জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কৃষক প্রজা পার্টির প্রার্থী হিসেবে মুসলিম লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ আরিফ চৌধুরীকে (ধনুমিয়া) পরাজিত করে এমএএ নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৩৭ সালে তিনি বরিশাল জেলা মুসলিম লীগ কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। একইসাথে তিনি জেলা কৃষক প্রজা পার্টির সভাপতি ছিলেন। তখন থেকেই বরিশালের তথা দক্ষিণ বাংলার জনপ্রিয় নেতা হিসেবে সবার কাছে গণ্য হতে থাকেন খান বাহাদুর হাশেম আলী খান।
১৯৩৯ সালে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের জন্য গঠিত ফ্লাউড কমিশনের সদস্য নিযুক্ত হয়ে পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ ও যুক্ত বাংলার কয়েকটি জেলা পরিদর্শন করেন। খান বাহাদুর হাশেম আলী খান ফ্লাউড কমিশনের রিপোর্ট প্রণয়নে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। কমিশন জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের সুপারিশ করে এবং তার উপর ভিত্তি করে ১৯৫০ সালে জমিদারী উচ্ছেদ আইন পাশ হয়। ১৯৪১ সালে ভোলার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থদের পুনর্বাসনের জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং নিজে ওই অঞ্চলে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমের তদারকি করেন। ১৯৪১ সালে খান বাহাদুর হাশেম আলী খান দৈনিক নবযুগ পত্রিকার ম্যানেজিং ডিরেক্টর নিযুক্ত হন। যার সম্পাদক ছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯৪২ সালে তার পৃষ্ঠপোষকতায় মাসিক গুলিস্তাঁ কলিকাতা হতে প্রকাশিত হয়।
১৯৪১ সালের ১৭ ডিসেম্বর তিনি একে ফজলুল হকের দ্বিতীয় মন্ত্রী সভায় সমবায়, কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী নিযুক্ত হন। খান বাহাদুর হাশেম আলী খান শিক্ষা মন্ত্রীর সাময়িক দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি আইন সভার ভেতরে ও বাহিরে থেকে ১৯৩৮ সালে ভূমি সংস্কার আইন, ১৯৪০ সালে মহাজনী আইন, ১৯৩৯ সালে কৃষি খাতক আইনের প্রথম সংশোধন এবং ১৯৪২ সালের দ্বিতীয় সংশোধন প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
১৯২০ সালে খান বাহাদুর হাশেম আলী খান যখন সরাজ খেলাফতের অসহযোগ আন্দোলনে ঝাপিয়ে পরেন তখন তার বজ্রনিনাদী কন্ঠস্বরে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়েছে দক্ষিণ বাংলা, স্তিমিত হয়েছে লাখ লাখ জনতা, শংকিত হয়েছে বৃটিশ সরকার। তেজস্বী পুরুষ হাশেম আলী খান তোষণ বা পদলেহনের মাধ্যমে খেতাব লাভ করেননি। ১৯৩২ সালের এপ্রিল মাসে মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন থামিয়ে দেবার পর বৃটিশ সরকার তেজস্বী পুরুষ হাশেম আলী খানকে “খান বাহাদুর” উপাধিতে ভূষিত করে রাজ ভক্তদের দলে ভিড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। তার খেতাবকে রাজভক্তির পুরস্কার বলা যায় না।
কৃষক প্রজা আন্দোলনে খান বাহাদুরের অবদান ছিল অপরিসীম। মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মাওলানা আকরম খান, মাওলানা আহাম্মদ আলী, মাওলানা শামসুল হুদা, মৌলভী ইদ্রিস আহম্মদ, সৈয়দ নওশের আলী, মৌলভী সামসুদ্দিন আহাম্মদ, খান বাহাদুর মাহাতাব উদ্দিন, খান বাহাদুর ওয়াছিমুদ্দিন আব্দুল হাকিম বিক্রমপুরী, মৌলভী আব্দুল হাকিম কৃষক নেতাদের সাথেই শেরে বাংলার নেতৃত্বে যারা যুক্ত বাংলার দিকে কৃষক প্রজা আন্দোলনের ঝড় তুলেছিলেন তাদের মধ্যে খান বাহাদুর হাশেম আলী খান ছিলেন অন্যতম।
১৯২৭ সালে সতীন্দ্রনাথ সেন বরিশালের কুলকাঠির মসজিদের সম্মুখ দিয়ে বাদ্য বাজনাসহ শোভাযাত্রা পরিচালনার দাবী করায় উদ্ভুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সেখানে সেনা নিয়ে হাজির হয় জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মিঃ ই এন ব্লান্ড এবং তার নির্দেশেই গুলিতে সেদিন ২৫ জন মুসলমান শহীদ হয়। শহীদদের আত্মীয়-স্বজন আবার দাঙ্গার মামলায় অভিযুক্ত হয়। শেরে বাংলার সাথে সেই মামলা পরিচালনা করেন খান বাহাদুর হাশেম আলী খান। অতঃপর ১৯২৭ সালের মাঝামাঝি কুলকাঠি কারবালার প্রতিবাদে বরিশালে অনুষ্ঠিত হয় নিখিল বঙ্গ মুসলিম সম্মেলন। তার সভাপতি ছিলেন স্যার আব্দুর রহিম। প্রধান বক্তা ছিলেন বঙ্গ শার্দুল এ কে ফজলুল হক। অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি ছিলেন খান বাহাদুর হেমায়েত উদ্দিন আহম্মদ, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন কর্মবীর খান বাহাদুর হাশেম আলী খান।
কৃষক প্রজা তথা মুসলিম জাগরণের অন্যতম অগ্রনায়ক খান বাহাদুর হাশেম আলী খান যুক্ত বাংলায় দ্বিতীয় হক মন্ত্রী মন্ডলে ছিলেন একজন সুযোগ্য সদস্য। জমিদারী উৎখাতের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা ফ্যানসিস ফ্লাউডের নেতৃত্বে যে কমিশন গঠণ করেন খান বাহাদুর হাশেম আলী ছিলেন সেই কমিশনের সদস্য। সেই কমিশনের সুপারিশ মোতাবেকই তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকারের আমলেই জমিদারী উৎখাতের শুরু হয়। পরবর্তী মূখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের সময়ে তার পরিসমাপ্তি হয়। অবিভক্ত বাংলার মন্ত্রী হয়ে তিনি চাষী খাতক আইনের দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে ঋণ সালিসী বোর্ডের আয়ু বৃদ্ধি করেন। ফলে লাখ লাখ কৃষক ঋণমুক্ত হওয়ার সুযোগ লাভ করে।
সমবায় আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ খান বাহাদুর ওই আন্দোলনকে সুসংহত করে ঋণগ্রস্থ কৃষককে মহাজনের শোষণ হতে রক্ষা করার চেষ্টা করেন। হাশেম আলী খান বরিশালের তথা দক্ষিণ বাংলার একান্ত আপনজন ছিলেন। তিনি জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান, বরিশাল পৌরসভার চেয়ারম্যান, অবিভক্ত বাংলার মন্ত্রী এবং দীর্ঘ বারো বছর বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য হিসেবে নিজ জেলার সামাজিক ও শিক্ষা বিস্তারে বিশেষ অবদান রাখেন। তিনি কৃষক সমাজের উন্নতির জন্য যে অবদান রেখেছেন তা আজও প্রশংসার দাবিদার। তিনি শেষ জীবনে কৃষক সম্মেলন করে কৃষকদের অর্থনৈতিক মুক্তির উপায় নির্দেশ করে যান। তার রাজনৈতিক দর্শন ছিল কৃষককে সংগ্রাম করে বাঁচতে হবে।
১৯৬২ সালে তিনি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে যোগদান করেন এবং সেই সাথে আইয়ুব বিরোধী দলগুলোর সমর্থনে বাকেরগঞ্জ ৫নং আসনে প্রার্থী হয়েছিলেন। ওই বছরের ১৭ এপ্রিল সন্ধ্যার পর নির্বাচনী সফরে বাবুগঞ্জ উপজেলার বাহেরচর নদীতে ঝড়ের কবলে নৌকা ডুবিতে খান বাহাদুর হাশেম আলী খান শাহাদাত বরণ করেন। বরিশালের বুকে ওঠে শোকের মাতম। অশ্রুসিক্ত নয়নে বরিশালবাসীর মধ্যে অমানিশার ঘোরে অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। খান বাহাদুর হাশেম আলী খান বরিশালের অন্যতম কীর্তিমান পুরুষ। মানুষ মরে যায় কিন্তু তার কীর্তিই তাকে চিরঞ্জীব করে রাখে।
মরমী মানুষ প্রেমিক মানুষ, দরদী মানুষ, কীর্তিমান মানুষ, স্নেহময়ী মানুষ খান বাহাদুর হাশেম আলী খানকে তার অমর কীর্তিই চিরস্মরণীয় এবং চিরঞ্জীব করে রেখেছে।
খান বাহাদুর হাশেম আলী খানের পরিবার রাজনীতির ক্ষেত্রে নিবেদিত পরিবার। তার দুইপুত্র নুরুল ইসলাম খান ও ফখরুল ইসলাম খান দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। ফখরুল ইসলামের সহধর্মীনি সৈয়দ সাকিনা ইসলাম দু’বার সংসদ সদস্য ছিলেন। সাকিনা ইসলাম উপ-মহাদেশের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ ভারত লোকসভার প্রবীণ সদস্য বগ্মি, কলিকাতা কর্পোরেশনের মেয়র সৈয়দ বদরুদ্দোজার কন্যা। ফখরুল ইসলাম খানের পুত্র আমিরুল ইসলাম খান বুলবুল বিশিষ্ট চলচিত্র প্রযোজক, সাংস্কৃতিক সংগঠক ও বাংলাদেশ সরকারের সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তিনি (বুলবুল) বাংলাদেশ ও জাপান ফ্রেন্ডশীপ অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ কোরিয়া অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ লোকসংগীত অ্যাসোসিয়েশন ও নাট্য এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
এছাড়া আমিরুল ইসলাম খান বুলবুলের আপ্রাণ প্রচেষ্টায় বরিশাল তথা দক্ষিণ বাংলার জন্য জাপান সরকার ও জাইকার মাধ্যমে ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তারই (বুলবুল) চেষ্টায় জাপানের রাষ্ট্রদূত জাইকা প্রকল্পের মাধ্যমে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনকে ১৪০ কোটি টাকা প্রদান করেছেন। ##
তথ্যসূত্র: সংবাদ সপ্তাহ ডটকম
লেখক
খোকন আহম্মেদ হীরা
স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক জনকণ্ঠ
বরিশাল।