জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের ইতিবৃত্ত : পর্ব – ৪

 

সংঘাত, সন্ত্রাস, সহিংসতা, সমর নতুন কোনো ইস্যু নয়। পুরাকাল থেকেই পৈশাচিকতা ও দানবীয় প্রবৃত্তি প্রকাশিত খোদাদ্রোহী দুষ্টলোকদের থেকে। নরঘাতক নরপিশাচদের নৈরাজ্যে নীতিবান নর-নারীরা নিঃগৃহের শিকার হয়েছে বার বার। যুগে যুগে নাস্তিক, মুরতাদ, মুশরিকদের মিলন ঘটেছে আযাযিলের স্বপ্নরাজ্য বাস্তবায়নে। ইহুদি, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু ঐক্য সাধিত হয়েছে ইসলামি সাম্রাজ্যে ভাঙন সৃষ্টিতে। আধুনিক যুগেও আমরা দেখি বাম-রাম-ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা জোট বেঁধেছে অহির আদর্শের শিরোচ্ছেদে। পাশ্চাত্যশক্তি তো শয়তানেরই প্রতিচ্ছবি। ওদের আগ্রাসনে মানবতা ধুকছে নীরবে নিভৃতে।

রোম সম্রাটের জঙ্গিবাদ :

ইসায়ি প্রথম শতকে টিটাস ছিলেন স্বৈরাচারী রোম সম্রাট। তিনি ৭০ খ্রিষ্টাব্দে বলপ্রয়োগে জেরুজালেম জয় করেন। এ সময়ে গণহত্যায় ১ লাখ ৩৩ হাজার লোক নিহত হয়। ৭৬ হাজারকে বন্দি করে দাসে পরিণত করা হয়। হাজার হাজার লোককে বলপূর্বক মিসরীয় খনিতে কাজের জন্যে পাঠানো হয়। বিভিন্ন শহরে এম্পিথিয়েটার ও কারোসিয়ামে হিংস্র পশুদের মুখে ঠেলে দেয়ার জন্যে অথবা তরবারির খেলার শিকারে পরিণত করার জন্যে হাজার হাজার লোককে ব্যবহার করা হয়। দীর্ঘদেহী সুন্দরী বালিকাদেরকে বিজয়ীদের জন্যে বেছে নেয়া হয়। জেরুযালেম শহর ও হায়কাল ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়। তারপর ফিলিস্তিনে ইহুদি প্রভাব এমনভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায় যে দু’হাজার বছর ধরে তাদের আর মাথা তুলবার সুযোগ হয়নি। (আবুল আলা: সীরাতে সরওয়ারে আলম ২য় খণ্ড, পৃ ১৩)

রাজা শশাঙ্ক ও কুমারিল ভট্টের জঙ্গি-সন্ত্রাস :

গৌড়রাজ্যে আরেকজন জগদ্বিখ্যাত সন্ত্রাসী হলো ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসক রাজা শশাঙ্ক। তিনি তার পুরো শাসনামলে বৌদ্ধ নিধনে নিযুক্ত ছিলেন। নামজাদা ভাষাবিজ্ঞানী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন রায়বাহাদুর বলেন, ‘কর্ণসুবর্ণের রাজা শশাঙ্কের আদেশ ছিলো-সেতুবন্ধ হতে হিমগিরি পর্যন্ত যত বৌদ্ধ আছে বালক-বৃদ্ধ-নির্বিশেষে তাদেরকে হত্যা করবে, যে না করবে তার মৃত্যুদণ্ড হবে। অষ্টম শতাব্দিতে বৈদিকহিন্দুধর্মের অন্যতম পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা কুমারিল ভট্ট ‘বৌদ্ধ মাত্রই বধ্য’ এই মত প্রচার করেন; কিন্তু বৌদ্ধ ও জৈন সম্প্রদায়ের প্রতি হিন্দুদের যে কী ভীষণ আক্রোশ ছিলো, তা দাক্ষিণাত্যের ইতিহাসে বিশেষভাবে দৃষ্ট হবে। মাদুরার রাজা অষ্টম শতাব্দিতে কবি ও সাধু সম্বন্দরের সম্মতিক্রমে ৮ হাজার গোঁড়া জৈন পন্ডিতকে শূলে চড়িয়েছিলেন। (Eight thousand of the stuborn Jains with Sambandar’s consent were impaled alive’’-`Hymns of the Tamil Saivite saints’. by- F. Kingsbury) “শঙ্কর বিজয়ে উল্লিখিত আছে- রাজা সুধন্বা অসংখ্য জৈন ও বৌদ্ধ পন্ডিতের মস্তক উলূখলে নিক্ষেপ করে ঘোটনদণ্ডে নিষ্পেষণ পূর্বক তাদের দুষ্টমত চূর্ণ-বিচূর্ণ করেছিলেন। অষ্টম শতাব্দিতে গাড়োয়ালের হিন্দু রাজা- তিব্বত রাজা লাঃলামা ইয়োসী- হোতকে বৌদ্ধধর্ম ত্যাগ করাবার চেষ্টায় তাঁকে যেরূপ নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিলেন, তার বর্ণনা শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র দাস প্রণীত ‘Indian Pandits in the land of Snow’ নামক পুস্তকে পাওয়া যাবে।’ (শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন: প্রাচীন বাঙ্গলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান, পৃ ১২) তিনি আরও লিখেছেন, ‘বৌদ্ধধর্মকে পরাভূত করে হিন্দুরা যেভাবে বৌদ্ধ-ইতিহাস লোপ করেছিলেন, তা অকথ্য অত্যাচার-লাঞ্ছিত। হর প্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় লিখেছেন, ‘‘বৌদ্ধ পারিভাষিক শব্দগুলো জনসাধারণের ভাষা হতে অন্তর্হিত হয়েছে। যে জনপদে (পূর্ববঙ্গে) ১ কোটির অধিক বৌদ্ধ এবং ১১৫০০ ভিক্ষু বাস করত সেখানে একখানি বৌদ্ধগ্রন্থ ৩০ বছরের চেষ্টায় পাওয়া যায় নাই। যে পূর্বভারত বৌদ্ধধর্মের প্রধান লীলাক্ষেত্র ছিলো, তথায় বৌদ্ধধর্মের যে অস্তিত্ব ছিলো, তাও ইউরোপীয় প্রত্নতাত্ত্বিকগণের চেষ্টায় অধুনা আবিষ্কার করতে হয়েছে।’’ (Discoveries of living Buddhism in Bengal, P 1)  এদিকে শত শত ডোমাচার্য্য ও হাড়ি জাতীয় তান্ত্রিক বৌদ্ধশ্রমণকে হিন্দুরা চূড়ান্ত শাস্তি দিয়ে সমাজের অতি অধস্তন স্থানে নিপতিত করেছেন। … হিন্দুরা বৌদ্ধকীর্তি একেবারে লোপ করাবার জন্য যেখানে সেখানে তাদের প্রাচীন কীর্তি ছিলো, তা মহাভারতোক্ত পঞ্চ-পাণ্ডব অথবা আর কোনো হিন্দু রাজ-রাজড়ার সম্পর্কিত এরূপ পরিকল্পনার দ্বারা বৌদ্ধাধিকারের চিহ্নমাত্র লোপ করবার চেষ্টা পেয়েছিলেন। (ওই; পৃ ১২-১৩)

ক্রুসেড যুদ্ধে ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের সন্ত্রাস :

ক্রুসেডের যুদ্ধের নামে পশ্চিম ইউরোপের খৃস্টানরা বিশাল বাহিনী নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে গণহত্যা চালায়। ১০৯৭ সালে ৭ লাখ খৃস্টান সেলজুক তুর্কিদের রাজধানী নিসে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তা দখল করে ১০৯৮ সালে এন্টিয়ক দখল করল। সেখান থেকে সারাত উল নোমান শহর দখল করে ১ লাখ বেসামরিক মানুষকে হত্যা করল। ১০৯৯ সালে জেরুজালেম দখল করে মসজিদের ভেতরে ৭০ হাজার মানুষকে হত্যা করল আত্মসমর্পণের পরও। জেরুজালেমে ক্রুসেড কিংডম প্রতিষ্ঠিত হলো। (ড. মুহাম্মাদ সিদ্দিক: ক্রুসেডের গণহত্যা অতীত বর্তমান, পৃ ১৩০) এ প্রসঙ্গে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহর লাল নেহরু বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত ধর্মযোদ্ধাদের একটি দল নর্মান্ডিদেশের বুইলোটবাসী গডফ্রে নামক একজন সেনানায়কের নেতৃত্বে প্যালেস্টাইনে গিয়ে পৌঁছয়। তাদের আক্রমণ তুর্কিরা প্রতিরোধ করতে না পারায় জেরুজালেম খৃস্টান কবলিত হয়। তারপর এক সপ্তাহ ধরে চলে এক অতি বীভৎস হত্যাকাণ্ড। একজন ফরাসি প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, ‘‘মসজিদের সামনে রক্তের নদী বয়ে গিয়েছিল। রক্তের স্রোতে হাঁটু অবধি ডুবে যেতে লাগল। রক্তের নদী ঘোড়ার লাগাম অবধি উঠেছিল।’’ গডফ্রে জেরুজালেমের রাজা হয়ে বসলেন।’ (জওহর লাল নেহরু: বিশ্ব ইতিহাস প্রসঙ্গ, পৃ ১৭৮-১৭৯) তিনি আরও বলেন, ‘অবিরাম রক্তের স্রোতে ভেসে গিয়েছিল এশিয়া মাইনর ও প্যালেস্টাইন।’ (ওই; পৃ ১৭৭) ধর্মযুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য দলে দলে লোক এগিয়ে এল। তাদের ইতিহাস পড়লে দেখি এই ধর্মযোদ্ধাদের মধ্যে অনেকে এমন সব নীচ ও জঘন্য অপরাধ করেছে যার কথা শুনলেও কানে আঙুল দিতে হয়।  কেউ কেউ এমনভাবে লুটতরাজ ও অন্যান্য পাপকর্মে লিপ্ত ছিল যে তারা প্যালেস্টাইনের ধারে কাছেও পৌছতে পারে নাই। (ওই; পৃ ১৭৮)

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *