জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের ইতিবৃত্ত

পর্ব – ৩

 

মহানবি হযরত মুহাম্মাদ স. কে ইসলাম প্রতিষ্ঠা ও আইনের শাসন কায়েমের জন্য ২৩ বছরের নবুওয়াতি জীবনে ৬৪টি যুদ্ধের সম্মুখীন হতে হয় ।১  এই অর্ধশতাধিক যুদ্ধ ঘটনায় দুই পক্ষের নিহত হয় ৯১৮ জন। এরমধ্যে মুজাহিদ ৪৫৯ জন, মুশরিক ও কাফির ৪৫৯ জন ।২

ইহুদি, খ্রিস্টান, ব্রাহ্মণ্যবাদী এবং তাদের গণমাধ্যমে মুসলমান মাত্রই জঙ্গি, সন্ত্রাসী, ধর্মান্ধ, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িক, উগ্র। তাদের সাথে সংযুক্ত ধর্মনিরপেক্ষবাদী এবং কমিউনিজমে বিশ্বাসী মানুষেরা। ঔপনিবেশিক আমল থেকেই তারা সুনির্দিষ্ট উৎস বা তথ্য ছাড়াই মুসলমানদের বর্বর, মানবতাবিরোধী, ফ্যাসিস্ট বা প্রতিক্রিয়াশীল জাতি হিসেবে চিত্রায়িত করছে। কিন্তু ইতিহাস বলে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড যাচাই করলে দেখা যাবে অমুসলিমরাই সভ্যতা বহির্ভূত হিংস্র জনবিরোধী কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত। এখানে দুনিয়ার বড় বড় হত্যাকান্ড ও যুদ্ধবিগ্রহের একটি সংক্ষিপ্ত পরিসংখ্যান তুলে ধরা হলো।

দেবরাজ ইন্দ্রের জঙ্গি-সন্ত্রাস

দেবরাজ ইন্দ্র পঞ্চাশ সহস্র কৃষ্ণবর্ণ শত্র“কে বিনাশ করেছিলেন এবং শম্বরের নগরসমূহ ধ্বংস করেছিলেন। ইন্দ্র শম্বরের ৯৯টি পুরী (শহর) ধ্বংস করেছিলেন এবং দিবোদাসকে শততম পুরী বাসের জন্য দিয়েছিলেন। সেইজন্যই বোধ হয় ইন্দ্রের আর এক নাম পুরন্দর।৩ যারা নগর, বন্দর, শহর ধ্বংস করে তাদেরকে পুরন্দর বলা হয়। ইন্দ্র যাদের হত্যা করে তারা সবাই ছিলো ভারতবর্ষের অনার্য সম্প্রদায়ের নাগরিক। মহাভারতে বর্ণিত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আজও প্রবাদ হিসেবে মানুষের মুখে মুখে। এই যুদ্ধ এতই নৃশংস ছিলো যে যুদ্ধশেষে মাত্র ১১ জন যোদ্ধা জীবিত ছিলো। সৌপ্তিকপর্বের শেষে দেখা যায়, অশ্বত্থামা মুমূর্ষ দুর্যোধনকে বলেছেন যে, উভয় পক্ষের সকল যোদ্ধা নিহত হয়েছে; অবশিষ্ট আছে শুধু কৌরব পক্ষের তিনজন- কৃপাচার্য, কৃতবর্মা ও স্বয়ং অশ্বত্থামা। অপর পক্ষে পাণ্ডবদের ভিতর অবশিষ্ট আছে সাতজন, পঞ্চপাণ্ডব, সাত্যকি ও কৃষ্ণ।৪ বাকি সমস্ত সৈনিক ও যোদ্ধারা লাশ হয়ে পড়ে থাকে ময়দানে। এছাড়া ঋগে¦দের যুগে আর্য ও অনার্য, বিশেষত সনাতনী আর্যদের সহিত ইন্দ্র আর্য বিরোধী সভ্য আর্য ও অসভ্য, পার্বত্য, দস্যু আর্যদের যুুদ্ধ লেগেই থাকতো। দুবিতি ও কুমুরির মধ্যে এক যুদ্ধেই ৬০ হাজার লোক নিহত হয়। এতদ্ব্যতীত অনেকেই বন্দী ও দাস হতো।৫

অশোকের সন্ত্রাস

খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় অব্দে ভারতের শাসক ছিলেন অশোক। ভারতবর্ষ জুড়ে তার আধিপত্য বিস্তার হয়েছিলো। উড়িষ্যা বা কলিঙ্গ বিজয় ছিলো তাঁর বড় কীর্তি ! তাঁর নিজ বয়ান অনুযায়ী কলিঙ্গের যুদ্ধে দেড় লাখ লোক মগধের হাতে বন্দী ও নিহত হয় এক লাখের বেশি মানুষ।৬ পুণ্ড্রবর্ধন নগরীর জৈনগণ মহাবীরের চরণতলে পতিত বুদ্ধদেবের চিত্র অঙ্কিত করেছে শুনে অশোক পাটলিপুত্রের সমস্ত জৈনগণকে হত্যা করেছিলেন। [দিব্যাবদান, উদ্ধৃতি-শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদার: বাংলা দেশের ইতিহাস ১ম খণ্ড, পৃ ১৬০]

Related image

ছবি : অশোক [মরদ না মাদী; বোঝা বড় দায়]

মিহিরকুলের জঙ্গি তৎপরতা

প্রাচীন ভারতে আর এক জন রাজা ছিলেন মিহির কুল। তিনি প্রথমে টক্ক রাজ্যের শাসক ছিলেন। এ সময় তিনি ভারতবর্ষের সমস্ত অঞ্চল থেকে বৌদ্ধধর্ম উঠিয়ে দেয়ার জন্য একটি নির্দেশ জারি করেন।৭ পরবর্তীসময়ে ভ্রাতৃদ্বন্দ্বে ভাগ্যবিড়ম্বিত হয়ে কাশ্মির রাজার আশ্রয় লাভ করে মিহির কুল। কিন্তু বিশ্বাসঘাকতা করে ক্রমে ক্রমে শক্তি বৃদ্ধি করেন তিনি। সুযোগ পেয়ে একসময় কাশ্মির রাজকে হত্যা করে নিজেই রাজপ্রধান হয়ে বসলেন। অত:পর ছদ্মবেশী কিছু সেনা পাঠিয়ে পার্শ্ববর্তী গান্ধার রাজাকে হত্যা করেন। পুরো রাজপরিবারটিকেই নিশ্চিহ্ন করে দিলেন তিনি। প্রায় ১ হাজার ৬০০ এর মতো সংঘারাম ও ¯তূপ ভেঙ্গে মাটির সাথে মিশিয়ে দিলেন। সেনাবাহিনী কর্তৃক বহু লোক নিহত হবার পরেও মিহির কুল আরও ৯ লাখ মানুষ হত্যার পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। তখন গান্ধার রাজ্যের প্রধান অমাত্য ও মন্ত্রিগণ তাদের নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে প্রজাদের প্রাণ রক্ষার আবেদন জানালেন। কিন্তু জঙ্গিবাদী সাম্প্রদায়িক মিহির কুল তাদের অনুরোধ গ্রাহ্য করলেন না।

মিহির কুল প্রায় ৩ লাখের মতো প্রথম শ্রেণির নাগরিক সিন্দু নদীর তীরে হত্যা করলো। আরও ৩ লাখ লোককে হত্যা করলো নদীর জলে ডুবিয়ে। আরও ৩ লাখ লোককে তার সেনাবাহিনীর মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে দিলেন। এরপর দেশের সমস্ত সম্পদ লুট করে দেশে ফিরে গেলেন মিহির কুল। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়। তাঁর জন্য করুণা প্রকাশ করে ঋষিরা বললেন, বহু মানুষ ও বৌদ্ধধর্মকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য এবার সে গভীর নরকে পতিত হলো। অনন্তকাল ধরে সে এই গভীর নরকে পাকখেয়ে ঘুরে বেড়াবে। ৮

হদিস :
১. এ.এফ.এম. আবদুল মজিদ রুশদী, রাসুলুল্লাহ (সা) এর সৈনিক জীবন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, পঞ্চম সংস্করণ, মে ২০০৯, পৃ ১৬
২. এশিয়া ডাইজেস্ট, ঢাকা, বর্ষ ১৩, সংখ্যা ৮, জুন ১৫-জুলাই ১৫, ২০০৬, পৃষ্ঠা ৬৫
৩. ঋগে¦দ-সংহিতা (প্রথম খণ্ড), হরফ প্রকাশনী, এ-১২৬ কলেজ স্ট্রীট মার্কেট, কলকাতা ৭০০০০৭, পৃ ৪৭
৪. প্রমথ চৌধুরী, মহাভারত ও গীতা শীর্ষক প্রবন্ধ, প্রবন্ধসংগ্রহ, বিশ্বসাহিত্য ভবন, ৩৮/৪ বাংলাবাজার, ঢাকা-১০০০, পৃ ১৯০
৫. ড. এম আবদুল কাদের, নানা ধর্মে নারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, জানুয়ারি ২০০৯, পৃ ৯
৬. ভারতবর্ষের ইতিহাস, কোকা আন্তোনভা, গ্রিগোরি বোন্গার্দ-লেভিন, গ্রিগেরি ততোভ্স্কি, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, অনুবাদ-মঙ্গলাচরণ চট্টপাধ্যায়, প্রগতি প্রকাশ ১৯৮২, পৃ ৮৯-৯০
৭. হিউয়েন সাঙ ভ্রমণ কাহিনী, ভাষান্তর-খুররম হোসাইন, শব্দগুচ্ছ, ঢাকা, বইমেলা ২০০৩, পৃ ৩১
৮. হিউয়েন সাঙ ভ্রমণ কাহিনী, ভাষান্তর-খুররম হোসাইন, শব্দগুচ্ছ, ঢাকা, বইমেলা ২০০৩, পৃ ৩২

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *