মো. জিল্লুর রহমান ।।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক পরিচালিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ইসলামী ব্যাংক। ব্যাংকটি ১৯৮৩ সালের ১৩ই মার্চ কোম্পানি আইন, ১৯১৩-এর অধীনে একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত হয় এবং ৩০ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে। ইসলামী ব্যাংক বর্তমানে ৩৯৪টি শাখা, ২২৯টি উপশাখা, প্রায় ২৭০০টি এজেন্ট আউটলেট, ২৫০০টি এটিএম/সিআরএম বুথের মাধ্যমে গ্রাহকদের সেবা প্রদান করছে। ৪০ বছর ধরে নানা চ্যালেঞ্জ, অপপ্রচার ও চড়াই-উতরাই পার করে বর্তমানে দেশের অন্যতম শীর্ষ ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আনা ব্যাংকটির আজকের এই অবস্থানে আসার পেছনে রয়েছে গ্রাহকদের বিপুল আস্থা, ভালবাসা ও সমর্থন।ব্যাংকটি মূলত বিশ্বস্ত আমানতদারিতা এবং কল্যাণমূলক সেবায় গ্রাহকদের এই আস্থা অর্জন করেছে।
.
দেশের শিল্পায়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আর্থ সামাজিক উন্নয়নে বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান যে ভূমিকা রাখতে পারে তা ৮০ দশকের আগে কল্পনাও করা যেত না। কিন্তু এ কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে দেশে প্রথমবারের মতো প্রতিষ্ঠিত হয় নতুন একটি ধারার ব্যাংক বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। শুরুটা হয়েছিল ১৯৮৩ সালে। যার অনুসরণ করে আজ তিন ডজন পূর্ণাঙ্গ ও আংশিক ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এর মধ্যে ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংক, ১১টি প্রচলিত ব্যাংকের সাথে ইসলামী ব্যাংকের শাখা এবং ১৪টি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং উইনডোর মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিং প্রসার ঘটিয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের লোকবল এখন দেশে কার্যত তিন ডজন ইসলামী ও আংশিক ইসলামী ব্যাংকের নেতৃত্ব দিচ্ছেন কখনো সামনের দিকে থেকে, কখনো বা পরামর্শ দিয়ে, কখনো বা উৎসাহ দিয়ে। আর ব্যাংকটি একাই সর্বোচ্চ পর্যায়ে শিল্পে বিনিয়োগ করেছে, সবচেয়ে বেশি আমদানি রফতানি বাণিজ্য পরিচালনা করছে। কৃষিতে সর্বোচ্চ অবদান রয়েছে এই ব্যাংকের। এসএমইতে বিনিয়োগ এবং রেমিট্যান্স আহরণে শীর্ষে থেকে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে এই ব্যাংকটি।
.
২০২২ সালে ইসলামী ব্যাংক আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্য এবং রেমিট্যান্স আহরণ করেছে যথাক্রমে ৭৫,৪০৪ কোটি, প্রায় ৩৬,৯৬৩ কোটি এবং প্রায় ৪৫,৬৯৭ কোটি টাকা, যা সকল ব্যাংকের শীর্ষে। ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে গত ৪০ বছরে দেশে প্রবাসী রেমিট্যান্স এসেছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা, যা ব্যাংকিং ইতিহাসে একটি মাইলফলক। মধ্যপ্রাচ্য থেকে বৈধভাবে রেমিট্যান্স আহরণের অগ্রপথিকও ইসলামী ব্যাংক এবং এর শুরুটাও হয়েছিল এ ব্যাংকটির মাধ্যমে। ব্যাংকভিত্তিক রেমিট্যান্স প্রবাহের সর্বশেষ তথ্যমতে, গত বছর ব্যাংকটি প্রায় পৌনে ৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আহরণ করেছে এবং এর মধ্যে গত ডিসেম্বরেই সর্বোচ্চ ৫০ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স আহরণ করেছে, যা দেশের মোট রেমিট্যান্সের ৩০ শতাংশ। বর্তমানে ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ ১ লক্ষ ৪২ হাজার কোটি টাকার বেশি। সঞ্চয়ের মানসিকতা, উদ্যোক্তা তৈরি ও কর্মমূখী জীবনের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের প্রতিটি পরিবারের প্রয়োজন পূরণে কাজ করছে এই ব্যাংক। ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সব মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের অনন্য প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক। বর্তমানে ব্যাংকের গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ২ কোটি। এই ব্যাংকের ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবা ব্যবহারকারীর সংখ্যা দেশের ব্যাংকিং খাতের শীর্ষে।
.
শিল্পায়নের দিকে তাকালে দেখা যায়, শুরু থেকেই উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে ইসলামী ব্যাংক। উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও তহবিল জোগানের মাধ্যমে সবধরনের শিল্প কারখানায় অবদান রাখছে ব্যাংকটি। এ ব্যাংকটির মাধ্যমে দেশে তৈরি পোশাকের ভিত্তি রচিত হয়েছে এবং এক্ষেত্রে বর্তমানেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। হালকা ও ভারী সব ধরনের শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানিতে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করেছে এ ব্যাংক।ইসলামী ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, শিল্পে বিনিয়োগের মাধ্যমে ৮৫ লাখ মানুষের সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। শুধু হালকা ও ভারী শিল্পেই নয়, ইসলামী ব্যাংক সর্বোচ্চ এসএমই বিনিয়োগকারী ব্যাংক। এ ব্যাংকের অর্থায়নে ৬ হাজারের বেশি শিল্প কারখানা পরিচালিত হচ্ছে। আর আবাসন খাতে বিনিয়োগের দিক থেকেও সবার আগে রয়েছে ব্যাংকটি। এ পর্যন্ত ১২ লাখ পরিবারকে আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
জাহাজ নির্মাণসহ দেশের আকাশ, স্থল এবং নৌপরিবহন খাতে ইসলামী ব্যাংকের রয়েছে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ রয়েছে। দারিদ্র্য দূরীকরণ ও নারীর ক্ষমতায়নে ৩০ হাজার গ্রামের ১৫ লক্ষাধিক প্রান্তিক পরিবারের মাঝে ক্ষুদ্র বিনিয়োগ প্রদান করেছে এ ব্যাংক। যার সদস্যদের ৯৪ শতাংশই নারি। ইসলামী ব্যাংক সর্বোচ্চ কর প্রদানকারী ব্যাংক। এক যুগ ধরে বিশ্বসেরা ১ হাজার ব্যাংকের তালিকায় বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক। সম্প্রতি এ ব্যাংক বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী ইসলামী রিটেইল ব্যাংক এবং বাংলাদেশরে সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যাংক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। দেশের আবাসন বিনিয়োগে ইসলামী ব্যাংকের মার্কেট শেয়ার ১০% এর বেশি এবং পরিবহন খাতের মোট বিনিয়োগের প্রায় ১৮% মার্কেট শেয়ার ইসলামী ব্যাংকের। ব্যাংকের বিনিয়োগকৃত রেজিস্টার্ড যানবাহনের সংখ্যা বর্তমানে অর্ধ লক্ষাধিক। নৌপরিবহনে রয়েছে ৪২১টি। এছাড়া উড়োজাহাজ রয়েছে ৫টি।
.
বর্তমানে কৃষি ও পল্লী ঋণে বিনিয়োগ ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে সারাদেশের ইসলামী ব্যাংকের পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের প্রায় ৩ হাজার মাঠকর্মী নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া ইসলামী ব্যাংকের অর্থায়নে গড়ে উঠেছে দুই হাজারের বেশি কৃষিভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান। ব্যাংকের অর্থায়নে ২৬টি পাটকল পরিচালিত হচ্ছে। দেশে উৎপাদিত পাটজাত পণ্যের ১৭%-এর বেশি উৎপাদিত হয় ইসলামী ব্যাংকের অর্থায়নে। পচনশীল কৃষিপণ্য সংরক্ষণের জন্য অর্ধশতাধিক কোল্ড স্টোরেজে অর্থায়ন করেছে। ইসলামী ব্যাংকের অর্থায়নে স্থাপিত হয়েছে ৮৫২টি অটো রাইস মিল। দেশের প্রথম অটো রাইস মিল ও ব্রান অয়েল মিল (ধানের তুষ থেকে ভোজ্য তেল কারখানা) স্থাপনে প্রথম অর্থায়ন করেছে ইসলামী ব্যাংক।
.
ইসলামী ব্যাংক ১৯৯৫ সালে পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প (আরডিএস) চালু করে। এ প্রকল্পের আওতায় গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি, দক্ষতা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ, সঞ্চয় গঠন, বিভিন্ন আয়-উৎসারী কর্মকান্ডে বিনিয়োগ কার্যক্রম রয়েছে। শহর এলাকার বস্তিবাসীসহ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ২০১২ সাল থেকে ‘নগর দরিদ্র উন্নয়ন প্রকল্প’ কাজ করছে। ৩২ হাজার গ্রামে বিস্তৃত এ প্রকল্পের সদস্য ১৬ লক্ষ, যার ৯৪ শতাংশই নারী। দেশের মোট স্টুডেন্ট হিসাবের ২১% এখন ইসলামী ব্যাংকের। হজ সঞ্চয় অ্যাকাউন্ট, ক্যাশ ওয়াক্ফ অ্যাকাউন্ট, কারখানা শ্রমিক হিসাবসহ নানা সঞ্চয় হিসাবের মাধ্যমে সমাজের সকল স্তরের মানুষকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় এনেছে ইসলামী ব্যাংক।
.
সবচেয়ে কৃতিত্বের বিষয় ইসলামী ব্যাংকের সম্পূর্ণ কার্যক্রম নিজস্ব সফ্টওয়্যারের মাধ্যমে পরিচালিত। ব্যাংকের কোর ই-আইবিএস সফটওয়্যার এই ব্যাংকের তরুণ প্রকৌশলীদের দ্বারা নির্মিত। ইসলামী ব্যাংক তার গ্রাহকদের জন্য ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, বিকল্প ব্যাংকিং চ্যানেল, ই-কমার্স ইত্যাদি প্রযুক্তিনির্ভর সেবা দিচ্ছে। এছাড়া ইসলামী ব্যাংকের সেলফিন অ্যাপ ব্যবহার করে খুব সহজেই গ্রাহকগণ সকল লেনদেন করতে পারেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের জন্য প্রযুক্তিসমৃদ্ধ আর্থিক সেবার দ্বার উন্মুক্ত করেছে। পরিপূর্ণ প্রয়োগ ঘটেছে ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী বায়োমেট্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করে লেনদেন সুবিধা প্রদান করছে ইসলামী ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং। যা গ্রাহকের আমানতের সুরক্ষা দিচ্ছে এবং সরকার ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ভূমিকা রাখছে।
.
ইসলামী ব্যাংকিং মূলত একটি সামাজিক দায়বদ্ধ উদ্যোগ এবং কল্যাণমূখী ব্যাংকিং ধারার প্রবর্তক। গরিব, দুস্থ, অসহায় মানুষের কল্যাণে ১৯৮৪ সালে ‘সাদাকাহ ফান্ড’ গঠিত হয়। পরে ব্যাপকভিত্তিক কাজের জন্য ‘ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। যার অধীনে ১৯টি হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নার্সিং ইনস্টিটিউট সহ নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জাতীয় নীতিমালার অংশ হিসেবে প্রণোদনা প্যাকেজের সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে ইসলামী ব্যাংক। এর মাধ্যমে কৃষি ও কৃষিভিত্তিক শিল্প, পোশাক খাত সহ অন্যান্য শ্রমঘন প্রতিষ্ঠান নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা পেয়েছে।
.
যুক্তরাজ্যের ব্যাংকিং বিষয়ক বিখ্যাত ম্যাগাজিন ‘দি ব্যাংকার’-এর মূল্যায়নে ইসলামী ব্যাংক ২০১২ সালে বিশ্বের শীর্ষ ১০০০ ব্যাংকের তালিকায় বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাংকরূপে স্থান পেয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় টানা ১২ বার ইসলামী ব্যাংক বিশ্বের শীর্ষ ব্যাংকের তালিকায় রয়েছে। বর্তমানে এ তালিকায় ব্যাংকের অবস্থান ৮৮২তম। বিশ্বসেরা ইসলামিক ব্যাংক সিবাফি অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে ইসলামী ব্যাংক। ট্যাক্স কার্ড সম্মাননা ২০২২, আইসিএসবি গোল্ড অ্যাওয়ার্ড, আইসিএমএবি বেস্ট কর্পোরেট গোল্ড অ্যাওয়ার্ডসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা স্বীকৃতি অর্জন করেছে ইসলামী ব্যাংক।
.
গেল বছরব্যাপী ডলার সঙ্কট ছিল। এর পরেও ব্যাংকটি জাতীয় অগ্রাধিকারভুক্ত সার আমদানিতে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করেছে। ২০২২ সালে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে ৭৩ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের সার আমদানি হয়েছে যা দেশের বেসরকারি খাতে আমদানির ৬৫ শতাংশ। এর ফলে দেশের কৃষি খাত এগিয়ে যাচ্ছে, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশ এগিয়ে চলছে সমৃদ্ধির পথে। এভাবেই আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক হয়ে ইসলামী ব্যাংক দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আর সম্মিলিত শক্তিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রা।
.
মো. জিল্লুর রহমান
ব্যাংকার ও লেখক,
সতিশ সরকার রোড,
গেন্ডারিয়া, ঢাকা।
মোবাইল- ০১৭১৬৭৩৩৭১৪