নজরুল সাহিত্য চর্চা কেন অপরিহার্য ?

আযাদ আলাউদ্দীন ।।

কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) একটি নাম। একটি অধ্যায়। একটি নবযুগের সূচনাকারী। যার অগ্নিবীণায় অনুরণিত হয়েছে বিদ্রোহের সুর। সে সুরের মূর্ছনায় প্রাণের আবেগে জেগে উঠেছে বাঙালিরা। তিনি আমাদের রেনেসাঁর অগ্রদূত। বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের রূপকার। নজরুল না জন্মালে অবহেলিত শোষিত বাঙালির আত্মদর্শন সম্ভব হতো কিনা সন্দেহ। নজরুল ভোরের নকিব হয়ে আহ্বান জানিয়ে বললেন-
‘কোথা সে আযাদ কোথা সে পূর্ণ মুক্ত মুসলমান/ আল্লাহ ছাড়া করেনা কারেও ভয় কোথা সেই প্রাণ?

কাজী নজরুল ইসলাম সময়ের এক সাহসী সন্তান। কবি বিদ্রোহ করেছেন সকল অজ্ঞতা, অন্ধত্ব, ভীরুতা, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। তিনি ভেঙে দিতে চেয়েছেন সকল অচলায়তন। নজরুল সম্পর্কে আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন-‘এটা অবারিত সত্য যে, কবি নজরুল জন্মগ্রহণ না করলে বাংলাভাষী মুসলমান সমাজ আজিকার জয় যাত্রার অগ্রগতি থেকে অন্তত এক শতাব্দী পিছিয়ে থাকতে বাধ্য হতো’।
সত্যিই তো নজরুল বিহনে আর কে শোনাতো সেই জাগরণের গান-
‘বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা / শির উচু করি মুসলমান/
দাওয়াত এসেছে নয়া জামানার / ভাঙা কেল্লায় ওড়ে নিশান।’

তাঁর দৃষ্টিতে সকল মানুষ সমান। তিনি কাউকে প্রভু আর কাউকে ভৃত্য মানতে নারাজ। কারো উপর অন্যায় করা হলে কিংবা কাউকে অন্যায়ভাবে বন্দী করা হলে নজরুল উচ্চারণ করেছেন-
‘লাথি মার ভাঙরে তালা/ যত সব বন্দীশালায় আগুন জ্বালা / আগুন জ্বালা, ফেল উপাড়ি’

দেশপ্রেমিক কবি ব্রিটিশদের খপ্পর থেকে জাতিকে মুক্ত করতে ছিলেন বদ্ধ পরিকর। এজন্য তিনি জেল-জুলুম হাসিমুখে সহ্য করেছেন। তবু ঘুমন্ত জাতিকে অলসতার ঘুম থেকে জেগে ওঠার আহ্বান জানিয়েছেন। আর সতর্ক থাকতে বলেছেন জাতির শীর্ষ নেতৃত্বসহ সকলকে। তাঁর সাহসী উচ্চারণ-
‘কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর/ বাঙালির খুনে লাল হলো যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!
সচেতন মানুষ অন্যায় দেখে চুপ করে বসে থাকবে, মুখ বুজে সবকিছু সহ্য করবে এটা কোনভাবে মেনে নিতে পারেননি নজরুল। তার মধ্যে গতি থাকা চাই, তা না হলে তো জড় বস্তু আর মানুষে কোন পার্থক্য থাকছেনা। মানুষ তার পরিচয় জানতে পারলেই সে অলসতার ঘুম থেকে জেগে উঠবে। নজরুল আমাদের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে- ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম, মোরা ঝর্ণার মতো চঞ্চল/ মোরা বিধাতার মতো নির্ভয়, মোরা প্রকৃতির মতো স্বচ্ছ’

নজরুল যে শুধু জাগতিক সংগ্রাম করেছেন তাই নয়; কিংবা জাগতিক সংগ্রামই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিলনা। মানুষকে ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে তাঁর লেখনীর জুড়ি নেই। তাঁর অনেক কবিতা-গান, প্রবন্ধের মধ্যে আমরা ধর্মীয় চেতনাবোধ লক্ষ্য করি। তিনি খোদার কাছে মিলিত হবার জন্যে মোনাজাত করেছেন-
‘ইয়া মোহাম্মাদ বেহেশত হতে খোদারে পাওয়ার পথ দেখাও/এই দুনিয়ার দু:খ হতে এবার আমায় নাজাত দাও’
১৯৩১ সালে তিনি আব্বাস উদ্দীনকে দিয়ে গাওয়ালেন বিখ্যাত গান ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ’।
ঈদ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে যে দুটি মাত্র নাটক রচিত হয়েছে সে দুটির রচয়িতাও কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর কাব্যে-গানে মুসলিম ঐতিহ্যবাহী ‘জুলফিকার’ ‘খয়বর’ ‘মদিনা’ ‘বাগদাদ’ ‘হামজা’ ‘বেলাল’ ‘ওলিদ’ ‘ওমর’ ‘সালাহউদ্দিন’ ‘রুমী’ ‘সাদী’ ‘হাফিজ’ ‘জামী’ ‘খৈয়াম’ ‘খাদিজা’ ‘ফাতেমা’ ‘আয়েশা’ ‘আবে জমজম’ ‘ফোরাত’ ‘ইমাম মেহেদী’ ‘আদম’ ‘নূহ’ ‘ইবরাহীম’ ‘দাউদ’ ‘সোলায়মান’ ‘মূসা’ ‘ইউনুস’ ‘ইউসুফ’ জোলায়খা’ ‘আলিফ লায়লা’ ‘জিবরাইল’ ‘মিকাঈল’ ‘আজরাইল’ ‘ই¯পাহান’ প্রভৃতি নামগুলোর সাথে আমাদের যে সম্পর্ক তৈরী করেছিলেন তার উপমা সেদিনও যেমন ছিলনা আজও তেমনি নেই।
কাজী নজরুল আমাদের জাতিসত্ত্বার সাথে প্রথিত। স্বাধীনতার পথিকৃৎ, সামনে চলার প্রেরণা। তিনি তো জাতির আত্মার স্পন্দন, শরীরের তাগত মনের শক্তি। কবির অসংখ্য গান, কবিতা, প্রবন্ধ, ভাষণ-অভিভাষণ বৃটিশ শাসন ও শোষণের সময় জাতিকে যেভাবে উজ্জীবিত করেছে, আজও সেই গান ও কবিতাই জাতির জন্য শক্তি ও সাহসের আকর। কবি যখন বলেন-
‘দিকে দিকে পুন: জ্বলিয়া উঠেছে/ দীন-ই-ইলাহী লাল মশাল/
ওরে বেখবর তুইও ওঠ জেগে/ তুইও তোর প্রাণ প্রদীপ জ্বাল’

শিক্ষা যদি মানুষকে আলোকিত না করে দাসত্ব করতে শিখায় নজরুল প্রত্যাখ্যান করেছেন সে শিক্ষাকে। তার মতে শিক্ষার মাধ্যমে আত্ম উন্নয়ন ও আত্মোপলব্ধি জাগ্রত হতে হবে। তরুনদের লক্ষ্য করে নজরুল আক্ষেপ করে বলেছেন-
‘আমাদের মুসলমান তরুনদের লেখাপড়া জ্ঞান অর্জনের জন্য নয়, চাকুরি অর্জনের জন্য। বি এ, এম এ পাশ করিয়া কিছু যদি না হই অন্তত সাব-রেজিস্টার বা দারোগা হইবই হইব। এই যাহাদের লক্ষ্য এত স্বল্প যাহাদের আশা, এত নিচে যাহাদের গতি তাহাদের কি আর মুক্তি আছে? এইভূত সরিয়ে না গেলে আমরা যে তিমিরে সে তিমিরেই থাকিয়া যাইব।’ (তরুনের সাধনা)
আমাদের ধর্মীয় নেতাদের নিয়ে নজরুলের আক্ষেপ কম কিছু নয়। তারা আর কিছু না হোক উন্নয়নকে ফতোয়ার জালে বন্দী করতে পারেন। বর্তমানকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার ইচ্ছাই তাদের নাই, ভবিষ্যতের দূরদর্শী চিন্তা তো অনেক পরের ব্যাপার। নজরুল আক্ষেপ করে বলেছেন-
‘মৌলানা-মৌলবী সাহেবকে সওয়া যায়, মোল্লাও চক্ষু বুজিয়া সহিতে পারি, কিন্তু কাঠমোল্লার অত্যাচার অসহ্য হইয়া উঠিয়াছে। ইহারা প্রায় প্রত্যেকেই ‘মনে মনে শাহ ফরীদ, বগল মে ইট’ ।
তাই সময় এসেছে নজরুলের নির্দেশনা মেনে চলার। তিনি কুসংস্কার, গোড়ামি, ধর্মান্ধতা, থেকে বেরিয়ে এসে সত্যিকার মুমিন হয়ে খোদার ধরায় তার নির্দেশনা বাস্তবায়নের কাজে নেমে পড়ার আহবান জানিয়েছেন। নজরুল যেমনটি বলেছেন-
‘আমরা চাই সিদ্দিকের সাচ্চা ঈমান, ওমরের শৌর্য ও মহানুভবতা, আলীর জুলফিকার, হাসান -হোসেনের ত্যাগ ও সহনশীলতা। আমরা চাই খালেদ-মুসা তারেকের তরবারী, বেলালের প্রেম। এইসব গুণ যদি আমরা অর্জণ করতে পারি, তবে জগতে যাহারা আজ অপরাজেয় তাহাদের সহিত আমাদের নামও সসম্মানে উচ্চারিত হইবে।’ (তরুনের সাধনা)

আজ আবার বাঙালি মুসলমানদের জীবনে খরা নেমে এসেছে, সামনে পিছনে ডাইনে বামে যখন হতাশার অন্ধকার ঘিরে ধরেছে। আমাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য চেতনা, যখন ঘোলাপানির প্লাবনে তলিয়ে যেতে বসেছে তখন নজরুলকে আমাদের বড় বেশি প্রয়োজন। সমাজ বিনির্মাণে নজরুল চর্চা ও নজরুলের নির্দেশনা অনুসরণ আমাদের জন্য অপরিহার্য। নাট্যকার আরিফুল হক বলেছিলেন – ‘বাঙালি মুসলমানদের ‘বেসিক নীড’ পাঁচটি নয় ছয়টি হওয়া উচিত। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার সাথে অনিবার্যভাবে যুক্ত হওয়া উচিত নজরুল চর্চা।’
আমরাও তাই মনে করি। এ জড়াগ্রস্থ জাতিকে নজরুলের কথার চাবুকেই জাগ্রত করা সম্ভব। ##

আযাদ আলাউদ্দীন
পরিচালক, বরিশাল সংস্কৃতিকেন্দ্র
মোবাইল: ০১৭১২-১৮৯৩৩৮

২ comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *