পুতিন : যেভাবে গোয়েন্দা থেকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট

মুক্তবুলি ডেস্ক

ক্রেমলিনের এক ডেপুটি চিফ অব স্টাফ দেশটির প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে তার মতামত জানিয়ে বলেছিলেন ‘যদি পুতিন না থাকে, তাহলে রাশিয়াও থাকবে না।’ এটি যেন আসলে রাশিয়ার কোটি কোটি মানুষের চিন্তারই প্রতিধ্বনি। গত কয়েক দশক ধরে এরা ভ্লাদিমির পুতিনকে ক্ষমতায় রাখার জন্য ভোট দিয়ে চলেছেন। কখনো প্রেসিডেন্ট পদে, কখনো প্রধানমন্ত্রীর পদে। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর আবারও বিশ্বব্যাপী আলোচনায় পুতিন।

ভ্লাদিমির পুতিন কে?

গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় দেশটির সবচেয়ে ক্ষমতাধর নেতা হচ্ছেন ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন। পুতিন লেনিনগ্রাদে জন্মগ্রহণকারী রুশ প্রজাতন্ত্র বা রাশিয়ার অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি ২য় মেয়াদে ৭ মে, ২০১২ তারিখ থেকে দেশটির রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতাসীন।

পুতিনের শৈশব

১৯৫২ সালের ৭ই অক্টোবর পুতিনের জন্ম। পুতিনের শৈশব কেটেছে এক কঠিন পরিবেশে। বর্তমানে সেন্ট পিটসবার্গ, যেটি এক সময় লেলিনগ্রাদ নামে পরিচিত ছিল, সেখানেই বেড়ে ওঠে পুতিন। তার বাবা একটি কারখানায় কাজ করতেন। তার দাদা ছিলেন একজন বাবুর্চি। তিনি যেখানে বেড়ে উঠেছেন, সেখানে ছোট বয়সে তার সঙ্গে স্থানীয় ছেলেদের সংঘাত শুরু হয়। সেজন্য পুতিন জুডো খেলা রপ্ত করেন।

পরিবার

২০১৩ সালে পুতিনের সাথে তার স্ত্রীর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। তাদের ৩০ বছরের দাম্পত্য জীবন ছিল। তার স্ত্রীর অভিযোগ ছিল, পুতিন শুধুই কাজের মধ্যে ডুবে থাকতেন। কাজই ছিল তার নেশা। তার ছোট মেয়ে মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রশাসনে উচ্চপদে চাকরি করেন। অন্যদিকে বড় মেয়ে একজন শিক্ষাবিদ। গুজব রয়েছে যে, সাবেক জিমন্যাস্ট আর রাজনৈতিক অ্যালিনা কাবেইভার সঙ্গে তিনি প্রেম করছেন। কিন্তু এই গুজব সত্যি কিনা, তার কোন ইঙ্গিত এখনো পাওয়া যায়নি।

গোয়েন্দা থেকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট

স্কুলের পড়ালেখা শেষ করার আগেই পুতিনের স্বপ্ন ছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবিতে কাজ করার। আইন শাস্ত্র পড়াশুনা করা পুতিন বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করেই তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবিতে যোগ দেন। স্নায়ু যুদ্ধের সময় তিনি তৎকালীন পূর্ব জার্মানিতে কেজিবির গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তীতে তার শাসনকালে সাবেক কেজিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উচ্চ পদে আসীন হয়েছেন।

১৯৯৭ সালে বরিস ইয়েলেৎসিন যখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট তখন ভ্লাদিমির পুতিন ক্রেমলিনে আসেন এবং তাকে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা সার্ভিসের প্রধান হিসেবে নিয়োগ করা করা হয়। ১৯৯৯ সালে নতুন বছরের প্রাক্কালে ইয়েলেৎসিন প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং ভ্লাদিমির পুতিনকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন।

রাজনীতি

২০০০ সালের মার্চ মাসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পুতিন অনায়াসে জয়লাভ করেন। ২০০৪ সালে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হিসেবে জয়লাভ করেন। কিন্তু রাশিয়ার সংবিধান অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি পরপর তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণের উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। তখন পুতিন প্রেসিডেন্ট পদে অংশগ্রহণ না করে প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচন করেন। ২০১২ সালে তিনি তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করেন।

পুতিন কতোটা ধনী?

রাশিয়ার নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়া তথ্য অনুযায়ী, পুতিনের বাৎসরিক বেতন এক লাখ ১২ হাজার ডলার। কিন্তু দুই বছর আগে মার্কিন ট্রেজারি দপ্তরের কর্মকর্তারা গণমাদ্যমকে জানিয়েছিলেন, ভ্লাদিমির পুতিন একজন দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি, যিনি তার সম্পদ অনেক বছর ধরে লুকিয়ে রেখেছেন। ২০০৭ সালের একটি সিআইএ নথিতে জানা যায়, তার ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার।

পুতিন কিভাবে এত অপরিহার্য হয়ে উঠলেন?

বিগত শতাব্দীতে বিশ্বে স্নায়ুযুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে ভ্লাদিমির পুতিনের উত্থানের শুরু। পূর্ব ইউরোপ জুড়ে কমিউনিষ্ট বিরোধী গণবিপ্লবের মুখে যখন বার্লিন প্রাচীর এবং কথিত ‘লৌহ যবনিকা’ ধসে পড়লো, তখন তিনি বেশ বেকায়দায় পড়েছিলেন। এই ঘটনা তার মনে দুটি গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে গেছে।

প্রথমতঃ গণঅভ্যুত্থানের প্রতি তার বিতৃষ্ণা। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর মস্কোতে ক্ষমতার শীর্ষে শূন্যতা দেখা দিল। পুতিন নিজে ক্ষমতার শীর্ষে এ ধরণের শূন্যতার একটি উদাহারণ দিয়েছেন।

১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে ড্রেসডেনে বিক্ষুব্ধ জনতা কেজিবির সদর দফতর ঘেরাও করেছিল। তখন তিনি সাহায্য চেয়ে মস্কোতে যোগাযোগ করেন। কিন্তু তৎকালীন সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ ছিলেন ‌‌একেবারে নীরব।

তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন কেজিবির দফতরে রাখা সব কাগজপত্র নষ্ট করে ফেলবেন। পরে একটি বইতে পুতিন এ ঘটনার স্মৃতিচারণ করেছেন, ‘আমরা এত কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলছিলাম যে এক পর্যায়ে চুল্লিটি বিস্ফোরিত হয়েছিল।’

পুতিনের জীবনী লেখক বরিস রেইটশুস্টার জার্মান নাগরিক। তার মতে, ‘পূর্ব জার্মানির সেই অভিজ্ঞতা যদি পুতিনের না থাকতো, তাহলে হয়তো আমরা ভিন্ন এক পুতিনকে দেখতাম।’

ক্রাইমিয়ায় শক্তি প্রদর্শন

২০১৪ সালে বিদ্যুৎ গতিতে অভিযান চালিয়ে রাশিয়া ক্রাইমিয়া দখল করে নিল। এটি ছিল প্রেসিডেন্ট পুতিনের এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় বিজয় আর পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য এক অবমাননাকর পরাজয়। একটি প্রতিবেশী দেশের একটা অঞ্চল দখল করে নিয়ে রাশিয়া তার শক্তি দেখিয়ে দিল, কিন্তু বিশ্ব রাশিয়াকে থামাতে কিছুই করতে পারলো না।

বহু বছর ধরে প্রেসিডেন্ট পুতিন একটা কৌশল নিয়ে আগাচ্ছিলেন, যার লক্ষ্য সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে স্বাধীন হওয়া দেশগুলোকে আবার রাশিয়ার রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ে নিয়ে আসা। রাশিয়া এসব দেশের ওপর কর্তৃত্ব ফলানো তাদের সহজাত অধিকার বলে গণ্য করে। ২০০৮ সালে জর্জিয়ার সংঘাতে রাশিয়া সেটা দেখিয়ে দিল।

রাশিয়ার নতুন জার

পুতিন তার শাসনামলে রাশিয়ায় একটা পুরনো ধারণার পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েছেন। এটিকে বলা হয় ‘কালেক্টর অব রাশিয়ান ল্যান্ডস‌’। এটি একটি সামন্ততান্ত্রিক ধারণা, যেটি রাশিয়ার সম্প্রসারণবাদী নীতি সমর্থন করে। এই ধারণার আলোকে এটা বোঝা সহজ, কেন ক্রাইমিয়া এবং অন্যান্য নিকট প্রতিবেশী রাশিয়ার কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ।

আর্কাডি অস্ত্রোভস্কির মতো কিছু রুশ পর্যবেক্ষক মনে করেন, এটি রাশিয়ায় আধুনিক কালের ‘জার‌’ প্রতিষ্ঠার পথ খুলে দিতে পারে। রুশ ইতিহাসে জারকে দলীয় রাজনীতির উর্ধ্বে বিবেচনা করা হয়। প্রেসিডেন্ট পুতিন যে সর্বশেষ নির্বাচনে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, সেটিতে যেন তারই ইঙ্গিত।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার বর্তমান চতুর্থ মেয়াদ যখন ২০২৪ সালে শেষ হয়ে যাবে। তারপর কি? ভবিষ্যতের কথা কেউ বলতে পারছেন না। কিন্তু ভ্লাদিমির পুতিন একটা পরিকল্পনা নিশ্চয়ই ঠিক করে রেখেছেন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *