প্রিয় আহমদ বাসির

আযাদ আলাউদ্দীন

একনিষ্ঠ একজন গভীর পাঠকের নাম কবি আহমদ বাসির। তিনি একাধারে লেখক, আবৃত্তিকার, সাহিত্য সংগঠক, গবেষক ও সম্পাদকসহ নানা বিশেষণে বিশেষায়িত- সবকিছুকে ছাপিয়ে তিনি উদার মনের একজন ভালো মানুষ।
কবি আহমদ বাসিরের নামটি ছাপার অক্ষরে প্রথম দেখি ১৯৯৮ সালের দিকে মাসিক কিশোর কণ্ঠ পত্রিকায়। এরপর ছাত্রসংবাদ, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা, দৈনিক সংগ্রামের সাহিত্য পাতায় তার অনেক লেখা পড়েছি।

২০০৭ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সের উদ্যোগে বাগেরহাট শিল্পকলা একাডেমিতে একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়। ওই সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের দায়িত্ব দেয়া হয় বাংলাদেশ সংস্কৃতিকেন্দ্রের তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক কবি মতিউর রহমান মল্লিক ভাইকে। তিনি ব্যস্ত মানুষ, সকল তথ্য কালেক্ট করে প্রবন্ধ লেখার সময় বের করতে পারছেন না। একদিন হঠাৎ করে আমাকে ফোন করে বললেন- আযাদ, তুমিতো সিডরের উপর অনেক ফিচার ও প্রতিবেদন করেছো। উপকূলীয় অঞ্চলে সিডরের কারণে জানমালের ক্ষয়ক্ষতিসহ যাবতীয় তথ্য নিয়ে তুমি ঢাকায় আসো। একটি সেমিনার পেপারস তৈরি করতে হবে। আমি সকল তথ্য নিয়ে একদিন পরেই ঢাকায় আসলাম।

ঢাকায় আসলেই আমাদের প্রিয় ঠিকানা ছিলো মল্লিক ভাইয়ের অফিস মানে ‘প্রত্যাশা প্রাঙ্গন’। সেই প্রত্যাশা প্রাঙ্গনে বসেই দেখা হলো কবি আহমদ বাসিরের সঙ্গে, মল্লিক ভাই আমাদের পরস্পরের পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি বললাম- আহমদ বাসিরের অনেক লেখা আমি পড়েছি। তিনি তখন দৈনিক আমার দেশের সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করছিলেন। আর আমি দৈনিক নয়া দিগন্তের বরিশাল ব্যুরো অফিসের স্টাফ রিপোর্টার। এরআগে সরাসরি পরিচয় না থাকলেও আমরা একে অপরের লেখার সাথে পরিচিত ছিলাম। দুজনেই সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত থাকার কারণে অল্প সময়েই আমরা পরস্পর ঘণিষ্ঠ বন্ধু হয়ে গেলাম। তাছাড়া আমাদের দুজনের বয়সও অনেকটা কাছাকাছি।

যাই হোক আমি আর মল্লিক ভাই প্রবন্ধ সাজানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সকালে লেখা শুরু করলাম আর প্রবন্ধ শেষ করতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। আমরা যখন প্রবন্ধ লিখছি সেই থেকে দেখলাম আহমদ বাসির লাইব্রেরি কক্ষে একনিষ্ঠভাবে বই পড়ছেন। যোহরের নামাজের পর দুপুরে আমি, মল্লিক ভাই, আহমদ বাসির, আফসার নিজাম ও মালিক আবদুল লতিফ মিলে সবাই একসাথে দুপুরের খাবার খেলাম। বিকেলে সেমিনারের জন্য প্রবন্ধ লেখা শেষ হওয়ার পর মল্লিক ভাই ফারইস্টের একজন কর্মকর্তা, আহমদ বাসির ও আমাকে বললেন ‘ডিজাইন বাজার’-এ গিয়ে প্রবন্ধটি বুকলেট আকারে ছাপানোর ব্যবস্থা করো। আহমদ বাসিরের মূল কাজ ছিলো প্রবন্ধটির ভালোভাবে প্রুপ দেখা, যাতে কোনো ভুল না থাকে। আমরা কল্যাণপুর থেকে পল্টন চলে এলাম ডিজাইন বাজারে। প্রবন্ধটি কম্পোজ হলো, ডিজাইন হলো আর প্রতিটি বিষয় খুটে খুটে তদারকি করলেন প্রিয় আহমদ বাসির। একদিনের কাজের মূল্যায়নেই আমি বুঝেছি- ‘আহমদ বাসির একটা জিনিয়াস’। কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমরা চা খেলাম আড্ডা দিলাম। এতে আমাদের সম্পর্ক আরো দৃঢ় হলো। সেই যে শুরু হয়েছিলো আমাদের বন্ধুত্ব- তা অব্যাহত ছিলো তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।

২০১৯ সালে সমন্বিত সাংস্কৃতিক সংসদের (সসাস) মুখপত্র ‘মনন’ জুলাই-সেপ্টেম্বর সংখ্যায় ‘মতিউর রহমান মল্লিক : সমুজ্জল স্মৃতির একাংশ’ লেখাটি পড়ে মুগ্ধ হয়ে লেখক আহমদ বাসিরকে ফোন করেছিলাম। মল্লিক ভাইকে নিয়ে প্রায় আধাঘন্টা কথা হলো আমাদের। বুঝলাম- লেখালেখির জগতে অগোছালো আমাদের প্রিয় মল্লিক ভাইকে গোছালো রাখার জন্য পেছন থেকে নিরন্তরভাবে কাজ করেছেন আহমদ বাসির। মল্লিক রচনাবলী প্রকাশের জন্য তাঁর কাছ থেকে অনেক লেখা পাওয়া গেছে। মল্লিক ভাইয়ের ছড়ানো-ছিটানো লেখা যেখানেই প্রকাশ হয়েছে তার কপি সংগ্রহ করে রাখতেন আহমদ বাসির। আমার কাছে খোঁজ নিতেন বরিশালের কোথাও মল্লিক ভাইয়ের লেখা ছাপা হয়েছে কিনা। আমি তাকে ১৯৯৮ ও ২০০৪ সালে হেরাররশ্মি শিল্পীগোষ্ঠীর পৃথক দুটি স্মারকে লেখা ছাপা হওয়ার তথ্য জানাই। তিনি আমাকে এগুলো সংগ্রহে রাখতে বলেন।

মল্লিক রচনাবলী প্রথম খন্ডের প্রথম সংস্করণে অনেক বানান ভুলের বিষয়ে তিনি আমার সাথে শেয়ার করেছেন। মল্লিক ভাইকে মনে প্রাণে ভালোবাসতেন বলেই তিনি এসব বানান ভুলের বিষয়টি মেনে নিতে পারেন নি। পরে অবশ্য দ্বিতীয় সংস্করণে সেসব ভুল বানান সংশোধন করা হয়েছে।
কয়েকদিন আগে মেসেঞ্জারে কথা হচ্ছিল তাঁর সাথে। এসময় তিনি তাঁর সম্পাদিত ‘মতিউর রহমান মল্লিকের সাক্ষাৎকার’ বইটির রিভিউ লেখার জন্য আমার কাছে অনুরোধ করেছিলেন। আমিও ওয়াদা দিয়েছিলাম তাকে। কিন্তু সেই ওয়াদার বাস্তবায়ন দেখে যেতে পারেননি তিনি।

কবি আবিদ আজমের ফেসবুক টাইমলাইনে আহমদ বাসিরের মৃত্যু সংবাদ শুনে শোকে স্তব্দ হয়ে গিয়েছি (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রজিউন)। ২০ নভেম্বর শুক্রবার অনলাইনে দেশীয় সাংস্কৃতিক সংসদ আয়োজিত ‘কবি আহমদ বাসির স্মরণসভায়’ আলোচকদের আলোচনা শুনে বুঝতে পারলাম সাহিত্য-সংস্কৃতিতে কতটা নিবেদিত ছিলেন আহমদ বাসির। তাঁর অধ্যয়নের গভীরতা ছিলো অনেক বেশি, যা তাঁর লেখা পড়লেই অনুধাবন করা যায় । পরকালে ভালো থাকুন প্রিয় আহমদ বাসির। এই দোয়া করে যাচ্ছি নিরন্তর।

আযাদ আলাউদ্দীন, বরিশাল ব্যুরো চিফ, দৈনিক নয়া দিগন্ত। 01712189338

One comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *