ফিচার ডেস্ক ||
নববর্ষ এলেই বাঙালি ব্যবসায়ীদের মধ্যে নতুন করে ব্যবসা সাজানোর হিড়িক পড়ে। একটা লাল খাতা আসে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। দোকান সাজানো হয় ফুল আর রঙিন কাগজ দিয়ে। খাতা হাতে সাজানো দোকান খোলেন ব্যবসায়ীরা। নতুন বছরের প্রথম দিনে অনেকে আবার ক্রেতাদের মিষ্টিমুখও করান। পুরোনো বছরের বাকি হিসাবের জের টেনে শুরু হয় নতুন খাতা লেখা। কেউ আগের বাকি মিটিয়ে দেন, কেউ নতুন জিনিসপত্র কেনাকাটা করেন – সবই তোলা হয় সেই খাতায়। এরই নাম ‘হালখাতা’।
আজ অবশ্য শুধু ব্যবসার সঙ্গেই এই হালখাতার সংস্কৃতি জড়িয়ে রয়েছে, অতীতে কিন্তু তা ছিল না। কৃষিভিত্তিক সমাজে হালখাতা ছিল সম্পূর্ণ কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত একটি প্রথা। হালের খাতাই ছিল হালখাতা – এই ‘হাল’ কথার মানে লাঙলের ফলা।
আদিম মানুষ ঠিক যে সময় থেকে চাষাবাদ শিখলো, সেই সময় চাষ করা ফসলের বিনিময় প্রথা শুরু করল তারা আর তার জন্যেই হিসাব রাখা হতো একটি খাতায়। সংস্কৃত শব্দ ‘হাল’ মানে লাঙল আর ফারসি ভাষায় ‘হাল’ কথার মানে নতুন। ভাষাবিদরা মনে করেন ‘হাল’ কথাটি সম্ভবত দুটি ভাষা থেকেই বাংলায় এসেছে।
এই রীতি বহাল রেখে ছিলেন মোগল সম্রাট আকবর। জমিদারি প্রথা তখনও বহাল রয়েছে বাংলায়। নিয়ম ছিল বছরের নির্দিষ্ট একটি দিনে জমিদারেরা তাদের সমস্ত বকেয়া খাজনা বা রাজস্ব জমা করবেন সম্রাটের ঘরে। সেই বিশেষ দিনে খাজনার হিসাব হালনাগাদ করা হতো। নবাব জমিদার সকলের মধ্যে আকবর এই দিনের জন্য চালু করেছিলেন ‘পুণ্যাহ’ প্রথা।
মৌসুমী ফসল বিক্রির টাকা পেতেন এই দিন কৃষকেরা আর তা দিয়ে তারা পুরো বছরের বকেয়া শোধ করতো বিভিন্ন দোকানদারের কাছে। ফলে দোকানদারদের খাতায় সেই হিসেব তুলে রাখা হতো। সেটাই ছিল হালখাতার রীতি।
একটা বিষয় উল্লেখ্য যে, পয়লা বৈশাখের দিন আমরা যে নববর্ষ পালন করি, হালখাতাও হয় সেদিনই। মোগল আমলের আগে কিন্তু এই দিনে নববর্ষ হতো না। বৈশাখ মাসের বদলে সে সময় নতুন বছর শুরু হতো অগ্রহায়ণ মাস থেকে। কৃষকের ঘরে ঘরে সে সময় নতুন ফসল উঠতো।
মোগল সম্রাট আকবর বাংলায় হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসারে খাজনা আদায় করতেন। এ বিষয়ে অনেক কৃষকদের সমস্যা হতো, জমিদাররাও অনেকে সমস্যায় পড়তেন। কারণ সেকালের বাংলায় সব কাজকর্ম করা হতো হিন্দু সৌরপঞ্জি মেনে। আর হিজরি বর্ষপঞ্জি তৈরি হয়েছিল চান্দ্রমাসকে কেন্দ্র করে। ফলে প্রজাদের অনুরোধে বিখ্যাত জ্যোতিষ আমির ফতেউল্লাহ সিরাজীকে ডেকে পাঠান আকবর। পরে হিজরি পঞ্জিকা আর হিন্দু সৌরপঞ্জি একত্রে বিশ্লেষণ করে চালু করা হয় নতুন বাংলা সাল। প্রথমে এই নতুন বর্ষপঞ্জির নাম ছিল ফসলি সন, পরে এর নাম হয় বঙ্গাব্দ।
সেই থেকেই জমিদারেরা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সমস্ত খাজনা ও রাজস্বের বকেয়া পরিশোধ করতেন। জমিদাররা এই দিনের মধ্যেই প্রজাদের থেকে সমস্ত খাজনা আদায় করতেন। ফলে বাংলা নববর্ষের সঙ্গে এই খাজনার হালনাগাদের খুব একটা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল না। পয়লা বৈশাখে হালখাতা হতো ঠিকই, কিন্তু তা নববর্ষ হিসেবে পালিত হতো না আগে। যদিও মোগল সম্রাট আকবরই এই নতুন বাংলা সাল তথা নববর্ষের প্রথা চালু করেছিলেন কিনা তা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে।