আযাদ আলাউদ্দীন
বরিশালের বিশিষ্ট কবি এ কে জয়নুল আবেদীনের ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী ০৯ ডিসেম্বর। ১৯৮০ সালের এই দিনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। দীর্ঘ প্রায় অর্ধশতক পরে কবির কতিপয় ভক্ত, হিতার্থী ও আপনজনের উদ্যোগে তাঁর পৈতৃক নিবাস বরিশালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত কবি ‘এ.কে জয়নুল আবেদীন ফাউন্ডেশন’ এর উদ্যোগে মরহুমের ৪০ তম মৃত্যু বার্ষিকী উদযাপনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।
জন্ম ও শিক্ষা লাভঃ গৌরনদী উপজেলার সাকোকাঠী গ্রামে ১৯২০ সালের পয়লা আগস্ট কবি এ কে জয়নুল আবেদীন জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সৈয়দ হোসেন উদ্দিন ইবনে লস্কর উদ্দিন ও মাতা মেহেরুন নেছা বিনতে হেলাল উদ্দিন খলিফা। স্বীয় গ্রামের পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর জয়নুল আবেদীন পাশ্ববর্তী চন্দ্রহার হাই স্কুলে পড়াশুনা করেন। তৎকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৯৩৫ সালে তিনি গৌরনদী থানাধীন ঐতিহ্যবাহী পালরদী মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অতঃপর ১৯৩৭ সালের ইন্টারমিডিয়েট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৯৩৯ সনে বি.এ পাস পূর্বক একান্ত পারিবারিক প্রয়োজনে কর্মসংস্থানের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
কর্মজীবন ও সাহিত্যচর্চাঃ ১৯৪০ সালে ২৩ অক্টোবর অবিভক্ত বাংলার অবিসংবাদিত জননেতা শের ই বাংলা একে ফজলুল হক (১৮৭৩-১৯৬২) পেশকৃত লাহোরে ঐতিহাসিক পাকিস্তান প্রস্তাব পাশ হবার পরে কবি এ.কে. জয়নুল আবেদীন এতদঅঞ্চলের লাখো জনতার সাথে একাত্ম হয়ে স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠেন। সাথে সাথে নিজের ভবিষৎ কর্মজীবন তথা কর্মসংস্থানের জন্য সমকালীন আর ১০ জন মুসলিম যুবকের ন্যায় জনাব জয়নাল আবেদীন জনদরদী হক সাহেবের সাথে তার তৎকালীন নিবাস কোলকাতার কড়োয়া রোডে সাক্ষাৎ গ্রহণের প্রয়াস পান। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ সালের মধ্যে বরিশালে হদুয়া মাদ্রাসায় বাংলা ও ইংরেজির সহকারি শিক্ষক ও বুখাইনগর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কয়েক মাস চাকুরী করেন। ১৯৪৪ সালে কোলকাতায় রেশনিং ডিপার্টমেন্টে তিনি সরকারি চাকুরীতে প্রবিষ্ট হন এবং ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান লাভের পরে তিনি বরিশাল কালেক্টরেটে উচ্চমান সহকারি হিসেবে বদলি হয়ে অবসর পর্যন্ত এ দপ্তরে বিভিন্ন দায়িত্ব যথেষ্ট সুনামের সাথে পালন করেন। বরিশাল সরকারি কলেজ (১৯৬৬), বরিশাল এ.কে. স্কুল (১৯১৮), বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরি (১৮৫৪), চন্দ্রহার মাধ্যমিক বিদ্যালয় সহ বহু মসজিদ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় মরহুমের অবদান অসামান্য।
ছাত্রজীবন থেকেই সাহিত্যচর্চার ঝোঁক ছিল বিধায় শিক্ষকতা ও সরকারি চাকুরীর ফাঁকে ফাঁকে কবি এ.কে জয়নুল আবেদীনের লেখালেখি চলতে থাকে। ১৯৪১ সালে তিনি অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শের-ই-বাংলা এ.কে ফজলূল হকের সহানুভুতিসুলভ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। ইতিপূর্বে এ.কে ফজলুল হকের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) সম্পাদনায় কোলকাতা থেকে ২য় পর্যায়ে প্রকাশিত দৈনিক নবযুগ পত্রিকায় ‘আতশবাজ’ ছদ্দনামে ‘আগুনের ফুলকি’ শীর্ষক শিশু বিভাগ পরিচালনার মাধ্যমে অল্পদিনের মধ্যেই কবি এ.কে জয়নুল আবেদীন বেশ সুনাম অর্জন করেন। ১৯৪২ সালে দৈনিক নবযুগের প্রধান সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলাম দূরারোগ্য ব্যাধিতে অসুস্থ হয়ে পরলে প্রখ্যাত সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯) নজরুলের স্থলাভিষিক্ত হন। এই সময় সন্ধিক্ষণে দৈনিক নবযুগের শিশু বিভাগ ছাড়াও কিছুদিনের জন্য মূল পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন কবি এ কে জয়নুল আবেদীন। এসময় তিক্ত অভিজ্ঞতা কবির বিরচিত ‘সম্পাদকের সংকট’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি ব্যঙ্গ রসাতœক কবিতা, তৎকালীন পাঠক মহলে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে।
১৯৩৯ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত প্রায় ৪০ বছর কবি এ কে জয়নুল আবেদীন এর সাহিত্য ও সাংবাদিক জীবন। এই দীর্ঘ সময়ে কবির রচিত রকমারি ছড়া ও কবিতা সমুহ সমকালীন আজাদ, ইত্তেফাক, আনন্দবাজার, হিন্দুস্থান টাইমস, পয়গাম, সংগ্রাম, মিল্লাত, যুগের দাবী, নকীব,. খাদেম, পাক সমাচার, পাকিস্তানি খবর, মাসিক মোহাম্মদী মাহেনও, গুলিস্তান, সবুজপাতা, খেলাঘর, রঙধনু, বসুমতি, কিশোর এশিয়া, তৌহিদ (১৯৫১ সালে খুলনা থেকে প্রকাশিত) ইত্যাদি দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত কবির অসংখ্য লেখা সংরক্ষণের অভাবে বর্তমান প্রজন্মের ধরাছোয়ার বাইরে থেকে গেল।
রচনাবলি ও প্রকাশনাঃ কাল পরিক্রমা ও বিভিন্ন অনিবার্য কারণবশত কবি এ.কে জয়নুল আবেদীন বিরচিত রচনাবলি কবির মৃত্যুর ৪০ বছর পরে সংগ্রহ করা তো দুরের কথা, তার সঠিক পরিমাপ কিংবা পরিসংখ্যান করাও আমাদের পক্ষে সম্ভপর হবে বলে মনে হয় না। এ প্রসঙ্গে একটি আশাব্যঞ্জক দিক এই যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারে সংস্থাপন মন্ত্রানালয় সম্ভবত আশির দশকের শুরুর দিকে মেজর জেনারেল (অবঃ) এম.এ লতিফের সম্পাদনায় প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটিয়াার বাকেরগঞ্জের দশম অধ্যায়ের তথ্যানুযায়ী বরিশালের কবি এ.কে জয়নুল আবেদীন প্রণীত বইয়ের তালিকা
১. কিশোর মঞ্জুরী (১৯৫১), ২. ছোটদের এ কে ফজলুল হক (১৯৬৩), ৩. ফুল বাগিচা (শিশুকাব্য), ৪. রসমালাই (কৌতুক রচনা), ৫. হাদিসের বাণী (কাব্যাকারে), ৬. শের-ই-বাংলা (অপ্রকাশিত) ইত্যাদি।
স্বাধীনতার অব্যবয়িত পরেই সরকারি চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ পূর্বক কবি তাঁর প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত রচনাসমূহ সংগ্রহ ও সংকলন পূর্বক প্রকাশনার উদ্যোগ নেন। উল্লেখ্য কোলকাতার জীবনে টিপু সুলতান রোডে ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি। বরিশালেও ভাড়াটে বাড়িতে সীমিত ও বিধিবদ্ধ স্থানে বসবাস করে কবি হাপিয়ে ওঠেন এবং তাঁর অনেক লেখা তাঁর জীবদ্দশায় হাতছাড়া হয়ে যায়। ১৯৭৭ সালে বরিশাল নবগ্রাম রোডে মুনসুর কোয়াটারে ১৫ শতক জমিতে বাসভবন নির্মান পূর্বক কবি তাঁর অসমাপ্ত কাজ সম্পাদনের মহতি উদ্যোগ নেন। কিন্তু মারাত্মক ব্যাধি মাত্র তিন বছরের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু ঘটায় এইসব প্রত্যাশা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
কবির সর্বশেষ রচনা ও শ্রেষ্ঠ প্রকাশনাঃ কবি এ.কে জয়নুল আবেদীন তার প্রিয় নেতা শেরে-ই-বাংলা এ.কে ফজলুল হকের পূর্নাঙ্গ জীবনীর পান্ডুলিপি শিকোয়ে রেখে মরহুম জননায়কের অমর গ্রন্থ ‘বেঙ্গলটুডে’ শীর্ষক পুস্তিকাসহ ঐতিহাসিক ভাষণ সমুহ সংকলন পূর্বক মেমোরেবল ইস্পিসেস অব শেরে-ই-বাংলা নামাঙ্কিত ইংরেজি গ্রন্থটি নিজস্ব আল হেলাল পাবলিশিং হাউজের নামে বরিশাল থেকে ১৯৭৮ সালে প্রকাশ করেন। দীর্ঘ ৪০ বছর পরে প্রায় এক যুগের (২০০৮-১৯) প্রচেষ্টায় উক্ত ঐতিহাসিক গ্রন্থটি বিশিষ্ট শেরে-ই-বাংলা গবেষক প্রফেসর মোঃ মোসলেম উদ্দিন শিকদার কর্তৃক অনূদিত হয়। শেরে-ই-বাংলার অবিস্মরণীয় ভাষণ নামে ২০১৯ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত হয় (ই.ফা প্রকাশনা ৩৩৮)।
সম্মাননা প্রাপ্তিঃ ৫২’ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও আজীবন সাহিত্যচর্চার স্বীকৃতি স্বরুপ গৌড়বঙ্গ সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক ১৯৫২ সালের ১৪ এপ্রিল কবিকে ‘শিশু সাহিত্য বিশারদ’ উপাধি তথা সম্মাননা দ্বারা ভূষিত হন।
তথ্যসূত্র:
ইতিহাস অন্বেষা, ৫ম বর্ষ, ১-২ সংখ্যা, জানুয়ারি, ফ্রেব্রুয়ারি, ২০০৮, ঢাকা
মুক্তবুলি, আযাদ আলাউদ্দীন সম্পাদিত, ৬ষ্ঠ সংখ্যা, ফ্রেব্রুয়ারি- ২০১৯।