বহুমুখি প্রতিভার তোরণ আব্বাসউদ্দীন আহমদ

Image result for আব্বাসউদ্দীন আহমদ মাহমুদ ইউসুফ

Mahmud Eusuf

বাংলা গানের ইতিহাসে এক রোমাঞ্চকর অধ্যায়ের জন্মদাতা আব্বাসউদ্দীন আহমদ। বাংলার শিল্প, সংস্কৃতি, তাহযিব, তমদ্দুনিক ইতিহাসে আব্বাসউদ্দীন এক অপরিহার্য নাম। যাঁর কণ্ঠনি:সৃত গানে একদা বাংলার মানুষ নেচে উঠেছিল, মুক্তির মূলমন্ত্র খুঁজে পেয়েছিল। জনগণ-রাজনীতিক এক কাতারে দাঁড়িয়েছিল আযাদি হাসিলের লক্ষ্যে; সেই মহান মহানায়ক হলেন আব্বাসউদ্দীন। বাংলার ইতিহাসের রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক বোদ্ধাদের মধ্যে যাঁর প্রতি জনগণ সবচেয়ে বেশ আকর্ষিত হয়েছিলেন তিনি হলেন সবার প্রিয় সংগীত তারকা আব্বাসউদ্দীন আহমদ। তিনি রাজা বাদশাহ ছিলেন না বটে, কিন্তু নামজাদা রাষ্ট্রনায়কদের চেয়েও ছিলেন খ্যাতিমান এবং খ্যাতির চেয়ারে তিনিই চেয়ারম্যান। তাই বাংলাদেশের ইতিহাসে গ্রহ-নক্ষত্রের মতোই সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল তারকায়িত অসামান্য প্রতিভাধর ব্যক্তি আব্বাসউদ্দীন।

সমসাময়িক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় স্থানিক, কালিক ও মানুষিক দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি ছিলেন সবার ঊর্ধ্বে। বাংলার জানা ইতিহাসে জনসমর্থন, জনপ্রিয়তা, লোকপ্রিয়তায় তিনিই শীর্ষে । শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক বলেছেন, ‘আমি যদি কাজি আর আব্বাসকে নিয়ে বাংলাদেশে বের হই তাহলে সারা বাংলা আমি জয় করতে পারি কদিনের ভেতরেই।’ (আব্বাসউদ্দীন আহমদ: আমার শিল্পী জীবনের কথা, পৃ ৬৯)

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, ‘বাংলার গ্রামে গ্রামে আব্বাসউদ্দিন সাহেব জনপ্রিয় ছিলেন। জনসাধারণ তাঁর গান শুনবার জন্য পাগল হয়ে যেত। তাঁর গান ছিল বাংলার জনগণের প্রাণের গান। বাংলার মাটির সাথে তাঁর ছিল নাড়ির সম্বন্ধ। … নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটি দিক অসম্পূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গান গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তাঁর গান শুনছে। তাঁরই শিষ্য সোহরাব হোসেন ও বেদারউদ্দিন তাঁর নাম কিছুটা রেখেছিলেন। আমি আব্বাসউদ্দিন সাহেবের একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম।’ (শেখ মুজিবুর রহমান: অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ ১১১) সকলের মুখে মুখে ছিলো শুধু তাঁর নাম, আর ছিলো তাঁর গান। তাঁর চিত্ত, অন্ত:করণ আর অন্তরিন্দ্রিয়ে ছিলো শুধুই গান আর গান। গানের গিরিঝর্ণায় তারঁ সমতুল্য তিনি নিজেই।

উদাস হাওয়ার মতোই ভাওয়াইয়ার সুরের গতি

তখন আজকের মতো প্রযুক্তিগত বিপ্লব ঘটেনি। দূরদর্শন, ইউটিউব, ইন্টারনেট ছিলো গরহাজির। গ্রামোফোন রেকর্ড, মঞ্চ বা উন্মুক্ত মাঠই ছিলো গান পরিবেশনের একমাত্র মাধ্যম। আব্বাসউদ্দীন প্রায় পাঁচ হাজার সভায় যোগদান করে সংগীত পরিবেশন করেন। মিটিং-মাহফিলে লাখ লাখ লোক হাজির হতো শুধুই তার গান শোনার জন্যে। স্কুল-কলেজের চ্যারিটি শো, দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপনের জন্য বিচিত্রানুষ্ঠান, সরস্বতীপূজার জলসা, মিলাদ মাহফিল, পুরস্কার বিতরণী সভা, উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক সমাবেশ এরকম হাজারো রকমের জনসমাগমে প্রধান আকর্ষণ থাকত আব্বাসউদ্দীন। বিশেষত: গ্রামোফোন রেকর্ডের কল্যাণে দেশের আনাচে কানাচে তাঁর সুনাম পৌঁছে যায়। অজস্র মানুষের কোলাহল, হৈ চৈ, কলরব, হট্টগোল, উচ্চবাচ্য, চিৎকার, চেঁচামেচি নিমিষেই উবে যেত তাঁর সুরের যাদুতে। তাঁর গানের সুরলহরীতে নীরব, নির্বাক, মৌনী হয়ে যেত জনতা। কলকোলাহলময় জনতাকে মুহূর্তে নিঝুমদ্বীপের বাসিন্দায় রূপান্তরিত করতে পারতেন তাঁর কণ্ঠসুধা দিয়ে। তাঁর গলার আওয়াজ থেকে দর্শক শ্রোতারা খুঁজে পেয়েছিল জীবনের দিশা, দেশাত্ববোধ, আত্মসচেতনা, বাঁচার অধিকার। তাদের অবচেতন মনে জিজ্ঞাসা, কৌতূহল, প্রেরণা, নির্দেশনা জাগিয়ে দেন আব্বাসউদ্দীন। শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে অসংখ্য সভায় পাকিস্তানের আযাদি আন্দোলনের সমর্থনে গান গেয়েছেন আব্বাসউদ্দীন। আযাদি উত্তরকালেও হাবিবুল্লাহ বাহারের সভাপতিত্বে অগণতি সভায় গান পরিবেশন করেছেন তিনি। গেয়েছেন সাহিত্য সভায় গান। এইভাবে সাধারণ মানুষের অন্তরে প্রবেশ করেছেন আব্বাসউদ্দীন। তাইতো সমকালীন সমাজ তাঁকে লুফে নিয়েছিল অপরিমেয় কলহাস্যে।

আব্বাসউদ্দীন মুলত সংগীত শিল্পী হলেও তিনি এক অসাধারণ সাহিত্যকর্ম রেখে গেছেন। ইহা তাঁর আত্মজৈবনিক কাহিনি। ‘আমার শিল্পী জীবনের কথা’ নামে এই জীবনালেখ্য প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালের এপ্রিল মাসে। কিতাবটিতে যথাক্রমে আমার গানের প্রেরণা, কলেজ জীবন, শিল্পীর আসনে, নব জাগরণে বাংলার মুসলমান, উত্তরকাল, বিদেশ ভ্রমণ, জীবন সায়াহ্নের স্মৃতি, আমার রেকর্ডের গানের তালিকা শীর্ষক মোট আটটি অধ্যায় রয়েছে। বইটি সম্পর্কে সৈয়দ মুজতবা আলী বলেন, ‘আব্বাসউদ্দীন সাহেবের আত্মজীবনী আমাদের নবগঠিত জাতির উত্থান-পর্যায়ের সনদ।’ কোলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার ১১ ডিসেম্বর ১৯৬০ তারিখে লিখে, ‘আত্মজীবনী পাঠের একটি বিশেষ আনন্দ আছে। বিশেষত: সে-জীবন যদি কোনও শিল্পীর হয়। এ যেন সেই প্রদীপ জলবার পিছনের সলতে পাকানোর ইতিহাস। কুড়ি থেকে ফুল হয়ে ওঠার কাহিনী … আলোচ্য গ্রন্থটি সেদিক থেকে অত্যন্তই আকর্ষণ সন্দেহ নেই।
প্রখ্যাত গায়ক আব্বাসউদ্দীনের নামের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের গ্রামীণ শোভা ও শ্রীর এক অনুপম অনুষঙ্গ জড়িয়ে আছে … সংগ্রামমুখর তাঁর আশ্চর্য জীবন কথা যেমন জন্দীপ্ত করে, তেমনি ব্যক্তি জীবনের অনেক টুকরো মনোরম ঘটনা- যা গল্পের চেয়েও সুন্দর- তাঁর শিল্পী সত্তাকে নতুন করে চিনতে সাহায্য করে। আব্বাসউদ্দীনের সরল অনাড়ম্বর ভাষার একটি দুর্বার আকর্ষণ পাঠকমাত্রেই অনুভব করবেন।’ (সূত্র: আব্বাসউদ্দীন আহমদ: আমার শিল্পী জীবনের কথা, পৃ ১৫৯-১৬০)

Image result for মাহমুদ ইউসুফ আব্বাসউদ্দীন আহমদ

মহুয়া সুন্দরী আব্বাসউদ্দীনের রেকর্ড করা একটি নাটক। নাটকটি রচনা করেন আবদুল করিম, অভিনয়ে আব্বাসউদ্দীন আহমদ অ্যান্ড পার্টি। হিজ মাস্টার্স ভয়েস ইহা রেকর্ড করে। চট্টগ্রামের অতি পুরাতন একটি সত্য ঘটনাকে এই নাটিকায় রূপ দিয়ে রেকর্ড করা হয়েছে। বাংলার অধিকাংশ স্থানে আজো এই মহুয়ার কাহিনি লোকের মুখে মুখে। ছেলে-মেয়ে-মুরব্বিরা রূপকথার মত আজো এই মহুয়াকে নিয়ে গল্প করে। আজো তাদের অন্তরে মহুয়া করুণ সুরজাল টেনে এনে হাসি-কান্না-ব্যথায় তাদের বুকখানি ভরে দিয়ে যায়। তাঁর রচিত কয়েকটি গান হলো: কোথা গেল হৃদয়ের প্রেম/কোথায় লুকানো আজি আঁখির মদিরা, সকল স্বপ্ন সফল করিয়া/কুটিল যেদিন ফল, কী যে মন চেয়েছিল একদিন/চাহিয়া কী যেন, মন পায়নি। (সেলিনা বাহার জামান: আব্বাসউদ্দীন আহমদ, পৃ ৪৬-৫৩) জীবনের কোনো এক সময়ে গল্প ও কবিতাও লিখতেন। কিন্তু সংগীতকেই জীবনের সাধনা হিসেবে গ্রহণ করায় ওদিকে আর অগ্রসর হননি।

আব্বাসউদ্দীন ছিলেন সুরজ্ঞ, সংগীতজ্ঞ, সুরশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, গণশিল্পী, সুরের দুলাল, সুরের যাদুকর, সুরের রাজা, গানের রাজা। সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তাফা কামাল (মহরহুমের জ্যেষ্ঠপুত্র) লিখেছেন, ‘তিনি যখন গান গাইতেন- কি বাসায়, কি বাইরে- মনে হত তাঁর শরীরটাকে মর্তে রেখে তিনি তাঁর কণ্ঠকে তুলে দিয়েছেন মহাকালের হাতে। গানের এই বিমূর্ত প্রকাশ ঘটে থাকে কিছুটা বিধিদত্ত প্রতিভা, কিছুটা সাধনা এবং অনেকটা আরাধনার ভেতর দিয়ে। তাঁর গানে বিশেষ করে ইসলামী গানে মরমী হৃদয়ের যে নিবেদিতচিত্ততা লক্ষ্য করি তা কোন আকস্মিক কণ্ঠগত কৌশল নয়। জন্মগত প্রতিভার সাথে ব্যাপক চর্চার মিশ্রণ ঘটিয়ে এসব গানে একটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির প্রয়াস নেই। এ-গানগুলো যাঁরা শুনেছেন তাঁদের হৃদয়ের গভীর অর্ন্তলোকে স্পন্দন এসেছে। তার কারণ, ভক্ত হৃদয়ের আকুতি ও উচ্ছ্বাস এইসব গানে ধরা পড়ে আছে।’ (আল মাহমুদ সম্পাদিত আব্বাসউদ্দীন, পৃ ৬৬-৬৭) আব্বাসউদ্দীনের সংগীত সাধনার বৈশিষ্ট্য ও তার কণ্ঠে গীত অজস্র গানের বিষয় ও পরিমাণ সম্পর্কে তথ্যসমৃদ্ধ নির্ভরযোগ্য কিতাব হচ্ছে মোস্তাফা কামাল ও অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সংকলিত ও সম্পাদিত গ্রন্থ ‘আব্বাসউদ্দনের গান।’ ১৯৬১ সালে প্রকাশিত কিতাবটিতে আব্বাসউদ্দীন গীত ২০৪টি গান স্থান পেয়েছে। তবে বাস্তবে গানের সংখ্যা বহু। বইটিতে তাঁর গানের বর্ণবৈভব ও ভাবৈশ্বর্যের ছটা আমরা দেখতে পাই। সঙ্কলিত গানগুলো ইসলামি, ভাওয়াইয়া, লোকসংগীত ও পল্লীগীতি এবং কাব্যগীতি- এ চারটি শ্রেণিতে বিন্যাস্ত। তন্মধ্যে ইসলামি গান ৮৪টি, ভাওয়াইয়া ৩১টি, লোকগান ৫৮টি ও কাব্যগীতি ৩১টি। (আল মাহমুদ সম্পাদিত আব্বাসউদ্দীন, পৃ ১১৪-১১৫)

Image result for আব্বাসউদ্দীন আহমদের ফটো

তাঁর কণ্ঠে ঝঙ্কৃত ইসলামি ও কওমি গানগুলো জাতির চেতনাহীন মনে নব চেতনার উন্মেষ জাগায়। তাঁর কণ্ঠ:নিসৃত দীনি গানের মধ্যে রয়েছে: ও মন রমযানের ঐ রোজার, আল্লাহ আমার প্রভু, মোদের নাবি কমলিওয়ালা, যাবার বেলা ছালাম লহ, ত্রিভুবনের প্রিয় মুহম্মদ, মোহাম্মদ নয়ন-মনি, ইয়া নবী সালাম আলায়কা, ওরে ও দরিয়ার মাাঝি, খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে, হে নামাজী আমার ঘরে, গুন গরিমায় আমাদের নারী, নৈরাশা হয়ো না, ফোরাতের পানিতে নেমে, খাতুনে জিন্নাত ফাতেমা জননী, ওগো মা ফাতেমা ছুটে আয়, ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এল নবীন সওদাগর, সেই রবিয়ল আউয়ালেরি, ত্রান কর মওলা মদিনার, মোহররমের চাঁদ এল ঐ, ভেসে যায় হৃদয় আমার, খয়বর জয়ী আলী হাইদার, বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম, ওয়াজ মাহফিল, চলবে কাবার জেয়ারতে, নাই হল মা বসন-ভূষণ, মোহাম্মদের নাম জপেছিলি, আল্লাহতে যার পূর্ণ ইমান, আল্লাহ নামের বীজ বুনেছি, তুমি কোথায়, আমার যখন পথ ফুরাবে, জাগ মুসাফির রাত পোহাল, তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের, তৌহিদেরি বান ডেকেছে, খোদা এই গরিবের শোনো, রোজ হাশরে আল্লা আমার, ঈদ মোবারক, নামাজের এই পাঁচ পিয়ালা, কারো মনে তুমি দিওনা আঘাত, দুঃখের দিনের দরদি মোর, দিকে দিকে পুন:জ্বলিয়া উঠিছে দীন ইসলামি লাল মশাল প্রভৃতি।


হারিয়ে যাওয়া পল্লীর কথা, পল্লীর গাঁথা, পল্লীর সুর, পল্লীর গান, পল্লীর কিংবদন্তী কাহিনিকাব্য গানে গানে তুলে ধরেছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। তাঁর গাওয়া লোকগানসমূহের মধ্যে রয়েছে নদীর নাম সই অঞ্জনা, ও কি গাড়ীয়াল ভাই, তোরষা নদীর ধারে ধারে, ঐ যে ভরা নদীর বাঁকে, আমার গহীন গাঙের নাইয়া, ঠগ্ মিনসে মুখপোড়া, কী মোর জঞ্জাল হইল রে, আগে জানলে তোর ভাঙা, তোরা কে কে যাবি লো জল, আমার হাড় কালা করলাম রে, আমায় এত রাতে কেনে ডাক দিলি, আজি নদী না যাইও যে, পতিধন প্রাণ বাঁচে না, আমায় ভাসাইলি রে, মনই যদি নিবিরে বন্ধু, থাকতে পারঘাটাতে তুমি, প্রেম জানে না রসিক, তুমি মোরে নিদয়ার কালিমা, আগা নাওয়ে ডুবুডুব, সোনা বন্ধুরে কোন দোষেতে, ও কন্যা হস্তে কদমের ফুল, নদীর কূল নাই কিনার নাই, বন্ধু আজো মনে রে পড়ে, যামো যামো যামো কন্যা হে, ও মোর চান্দরে মোর সোনা, আল্লা মেঘ দে পানি দে, নাও ছাড়িয়া দে, দিনার দিন দিন ফুরাইল, হাত ধরিয়া কঁও যে কথা, আরে ও ভাটিয়াল গাঙের, আগো না দাড়ীটা মরিয়া, নাও ছাড়িয়া দে, বাজান চল যাই চল, পরের অধীন কইর‌্যাছে আমায়, হারে আমার আকুল প্রাণের আশা, আমার কার জন্য প্রাণ এমন করে, ও সুখের ময়না রে, ও শহরবানু কান্দে, তোমার লাগিয়া রে কালা, ওই না মাধবী বনেতে বন্ধু ছিল, ঐ না রূপে নয়ন দিয়ে, গুরুর পদে প্রেমভক্তি, দাওয়ায় করছে মেঘ মেঘালি, ওরে ও পরানের মাঝি, শোন নলিতে ও বিশাখে, কি ওরে বাবার দেশের ওড়ে কুড়ুয়া, মুখ কোনা তোর জিবা ডিবোও, কোন বনে ডাকিলু কোকিল, ছাড়বে মন ভবের খেলা, আমায় দাগের মত দাগ, সে যেন কি করল রে আমায়, বাওকুমটা বাতাস যেমন, ও ভাই মোর গাঁওয়ালিয়া রে, গাও তোলো গাও তোলো কন্যাহে, কাগাতুয়া বলোং মুই ঠোঁটকরি প্রভৃতি।
পালাগান: রূপধন কন্যা, মরুচমতি কন্যা, হলদি-শানাই, দেশের গান: সকল দেশের চেয়ে পিয়ারা, উড়াও উড়াও আজি, আল্লা আল্লা বলরে ভাই প্রভৃতি। উর্দু গান: য়্যায় চাদে স্যবা গুজরেযো, ইয়া মোহাম্মাদ আপসা মহবুবে, যবসে দেখি হ্যায় কালামউল্লাহ, আল্লাহ ভি হ্যায় খুদ শেকত্যয়ে, মোহাম্মদকে কদমো পর কোরবান প্রভৃতি। স্বদেশি গান: ভারতের দুই নয়ন তারা, নম নম নম বাংলা দেশ মন। আধুনিক গান: বেণুকার বনে কাঁদে বাতাস বিধূর, ফিরে চাও বারেক ফিরে চাও, আর কিগো ফিরে আসিবে না, বরষ বরষ দিবস যামিনী, সাধ জাগে মনে পরজীবনে, বসিয়া নদীকূলে এলোচুলে।

Related image
বিবিধ: বিরহের গুলবাগ মোর ভুল করে, অনেক ছিলো বলার, আসিছেন হাবিবে খোদা, আজি কোথায় তখতে তাউস, দিকে দিকে পুনঃজ¦লিয়া উঠিছে, এই সুন্দর ফল সুন্দর ফুল, জরীন হরফে লেখা রূপালী হরফে, জাগে না সে জোশ লয়ে, তওফিক দাও খোদা ইসলামে, লীগ বিজয় না দিগ্বিজয়, মসজিদে ঐ শোন্রে আজান, হে নামাজি আমার ঘরে, উত্তল হল শান্ত আকাশ, আসিবে জানি তুমি প্রিয়, হারে পাগল দিলে মুষে, মিলন-পাত্র পূর্ণ করিয়া, ফুল পুছিনু বল কোথা পেলি, কোন বিরহীর নয়ন জলে, স্মরণ পারের ওগো প্রিয়, তোমার মাঝেই আপন হারা, উঠরে চাষি জগতবাসী ধর কষে লাঙ্গল, বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা শির উঁচু কর মুসলমান, আজি ক্যানে কাঁন্দেন তোমরা চন্দন বৃক্ষের ডালে, কুল মখলুকে আঝ ধ্বনি উঠে, কে এল ঐ- কালেমা শাহাদাতের বাণী, প্রাণ সখিরে ঐ শোন কদম্ব তলায় বংশী বাজায় কে, আজ শরতের রূপ দিপালী, হিন্দু আর মুসলমান মোরা দুই সহোদর ভাই, ওরে ভাই আমরা ছিলাম পরম সুখী, আজ জাগরে কৃষাণ সবতো গেছে, ঘোর-ঘোররে আমার সাধের চরকা ঘোর, স্নিগ্ধ শ্যামবাণী বর্ণা প্রভৃতিসব কালজয়ী গান। (সেলিনা বাহার জামান: আব্বাসউদ্দীন আহমদ, পৃ ৬৫-৭৫)

এই বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব ১৯৫৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর তিন মাস পূর্বে ২৬শে সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ তারিখে তিনি তাঁর জীবনেতিবৃত্তে লিখেন,

দুদিন পর আমি যখন এ-ধরার আনন্দ কোলাহল থেকে চিরদিনের মতো চলে যাব তখন তো দুনিয়াই আমাকে ভুলে যাবে। চিরকাল জেগে আছে এবং থাকবে শুধু আকাশের ঐ চন্দ্রসূর্য অগণিত তারকা সজাগ প্রহরীর মত। চলমান হয়ে থাকবে আলো-বাতাস, দখিনা হাওয়া, পাখীর কলতান, কুলুকুলুনাদিনী স্রোতস্বতী- আমার, এর, তার বাগানের হাসনাহেনা, যুঁই, চামেলী। এরা ফুটবে-ঝরবে-আর ফুটবে। আমি ফুটেছিলাম- দিন কয়েক হেসেছিলাম- এবার ঝরার পথে- ঝরব। কিন্তু আর ফুটব না।’ (আব্বাসউদ্দীন আহমদ: আমার শিল্পী জীবনের কথা, পৃ ১৪০-১৪১)

আব্বাসউদ্দীনকে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছিল
আব্বাসউদ্দীন তখন কলকাতা ডিপিআই অফিসে চাকরিরত। একদিন এক অফিস কলিগ তাঁকে ধরলেন গান গাইতে যেতে হবে তাদের গ্রামে। নতুন চাকরি, বন্ধুটিও নতুন, আব্বাসউদ্দীন আর না করতে পারলেন না। খঞ্জনপুর গ্রামে জমিদারের একটি খাসমহল আছে। একদিন এই জমিদার অফিসের কয়েকজন মুসলিম কর্মচারী এসে আব্বাসউদ্দীনকে একরকম জোর করেই নিয়ে গেলেন। সাথে অফিসের সেই বন্ধুটি।

সন্ধ্যার দিকে আব্বাসউদ্দীন সেখানে পৌঁছে দেখলেন মহাবিপদ। যাত্রাগানের আসরের মতো চারদিকে লোক বসানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাঝখানে গায়কের আসন। আব্বাসউদ্দীন জমিদারের ম্যানেজারের খোঁজ করলেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর আসলেন বাবুসাব। কোনো ভূমিকা না করেই বললেন, আপনি আব্বাসউদ্দীন সাহেব তো? কোলকাতা থেকে এসছেন? তা গান আরম্ভ করুন গিয়ে!
– কিভাবে গান গাইব? এতো লোক হাজির হবে জেনেও মাইকের ব্যবস্থা করেন নি কেন?
– প্রতিবার এখানে যাত্রা গান হয়। এতো লোক তো কখনো হয় না। আপনি আসবেন বলে হয়তো বা ছোটলোক প্রজা মুসলমানরা এসেছে গান শুনতে, আপনাকে দেখতে।

‘ছোট লোক প্রজা মুসলমান’ কথাটা মনে বেশ লাগলো। ম্যানেজার বাবুর সাথে কথা না বাড়িয়ে তিনি সোজা স্টেজে উঠলেন। ১০-১২ হাজার জনতা একেবারে শান্তরূপ ধারণ করল। পিনপতন নীরবতা। কাজী নজরুল ইসলামের গান দিয়েই আব্বাসউদ্দীন শুরু করলেন, ‘ও ভাই হিন্দু মুসলমান, ভুল পথে চলি দোঁহারে দুজন কোরো নাকো অপমান।’ গানের মধ্যেই কতিপয় যুবক হট্টগোল শুরু করলো। ওরা ম্যানেজার বাবুর নিয়োগকৃত হিন্দু সন্ত্রাসী!

খাসমহলে বরাবর যাত্রা, কীর্তন ও বাইজি নৃত্যের আসর জমে। এখানকার অধিবাসীরা বেশিরভাগ মুসলমান। হিন্দুধর্মীয় এসব অনুষ্ঠানে মুসলিমরা অংশগ্রহণ করে না। তাই তারা আব্বাসউদ্দীনের গান শোনার দাবি জানায়। হিন্দু জমিদারের ম্যানেজার সাহেব এতে নাখোশ হয়ে আব্বাসউদ্দীনকে হত্যার চক্রান্ত করে। আব্বাসউদ্দীনকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার এ খুনের কুটকৌশল সম্পর্কে জানতে পারে স্থানীয় কিছু মুসলিম তরুণ। তারা পরিকল্পিতভাবে আব্বাসউদ্দীনকে ম থেকে বাইরে এনে কাঁধে করে রাতের আঁধারে দ্রুত ট্রেন স্টেশনে নিয়ে যান। কলকাতাগামী রেলে তিনি বাসায় ফিরেন গভীর রাতে। (জহুরুল আলম সিদ্দিকী: ছোটদের সংগীতশিল্পী আব্বাসউদ্দীন, পৃ ৫১-৫৩) এছাড়া ১৯৪৬ সনের কলকাতা দাঙ্গার সময় তাঁকে খুন করার চক্রান্ত করে বর্ণহিন্দু সন্ত্রাসীরা।  কী জঘন্য কর্ম! একজন নামিদামি বিশ্ববরেণ্য সংগীতশিল্পীকে হত্যার ষড়যন্ত্র! এটাই আব্বাসউদ্দীনের মহাজীবনের ট্রাজেডি, একটি বিয়োগান্তক অধ্যায়।

Image result for আব্বাসউদ্দীন আহমদের ফটো

উপেক্ষিত আব্বাসউদ্দীন আহমদ
আব্বাসউদ্দীন একসময় জাতীয় জীবনে ঝড় তুলেছিলেন। গানের বিচিত্র ভাবপ্রবাহের তুফান প্লাবনে গণজাগরণ পয়দা হয়েছিল উপমহাদেশে। দেশকে, দেশের মানুষকে জাগিয়েছেন, আযাদি আন্দোলনের সৈনিক গড়েছেন। কিন্তু ইদানিংকালে স্থানীয় ও জাতীয় ক্ষেত্রে চরমভাবে উপেক্ষিত আব্বাসউদ্দীন। জন্ম-মৃত্যু তারিখ নীরবে আসে নিভৃতে চলে যায়। বেতার-টেলিভিশন-খবরের কাগজ চেপে যায় এই বহুমুখি প্রতিভার তোরণকে। অবহেলা, অনাদর, অবজ্ঞাই যেন নিয়তি! পাঠ্যপুস্তকে নেই, সভা-সেমিনারে নেই, আলোচনা-পর্যালোচনায় নেই। একসময় প্রাথমিক পাঠ্যসূচিতে আব্বাসউদ্দীন ও আবদুল আলিমের জীবনী অন্তর্ভুক্ত ছিলো। শিশু বয়সেই শিক্ষার্থীদের মনে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করত সেই সিলেবাস। অথচ সাম্প্রতিককালে পাঠ্যপুস্তক থেকে তাদের জীবনী তুলে নেয়া হয়েছে। এতে বিশেষ কারও স্বার্থ উদ্ধার হতে পারে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে দেশ ও দশের জন্য অমঙ্গলজনক।

Image result for আব্বাসউদ্দীন আহমদের ফটো

দেশের বিভিন্ন নগর, শহর, বন্দর, গ্রামে অপরিচিত, অজানা, অচেনা, অখ্যাত, কুখ্যাত লোকের নামেও রয়েছে নানাবিধ স্থাপনা। অথচ ইতিহাসের মহান শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদের নামে নেই কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম। সড়ক, এভিনিউ, সংগীত একাডেমি, স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের নামকরণ তাঁর নামে হতে পারত। দুঃখের বিষয় হলেও সত্য, কর্তৃপক্ষ এক্ষেত্রে চরম উদাসীন। এই অবিমৃষ্যকারিতা, অকৃতজ্ঞতা, অনুদারতা, বিবেচনাহীনতার অবসান হোক।

হদিস :
১। সেলিনা বাহার জামান: আব্বাসউদ্দীন আহমদ, বাংলা একাডেমি ঢাকা ১০০০, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮
২। আব্বাসউদ্দীন আহমদ: আমার শিল্পী জীবনের কথা, হাসি প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ৩৪ নর্থব্রুক হল রোড, ঢাকা-১১০০, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারি ২০০২
৩। শেখ মুজিবুর রহমান: অসমাপ্ত আত্মজীবনী, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, রেড ক্রিসেন্ট হাউস, মতিঝিল ঢাকা ১০০০, প্রথম সুলভ সংস্করণ সেপ্টেম্বর ২০১৪
৪। এম রুহুল আমিন: ছোটদের আব্বাসউদ্দীন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, দ্বিতীয় সংস্করণ, নভেম্বর ২০০০
৫। অতীত দিনের স্মৃতি; আবুল কালাম শামসুদ্দীন রচনাবলী দ্বিতীয় খ-, মোহাম্মদ মাহ্ফুজ উল্লাহ সম্পাদিত, বাংলা একাডেমী ঢাকা ১০০০, প্রথম প্রকাশ জুন ১৯৯৪
৬।। জহুরুল আলম সিদ্দিকী: ছোটদের সংগীতশিশল্পী আব্বাসউদ্দীন, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ সোসাইটি, মতিঝিল ঢাকা-১০০০, প্রথম মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারি ২০০১

৭। আল মাহমুদ সম্পাদিত আব্বাসউদ্দীন, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, সেগুনবাগিচা ঢাকা ২, প্রকাশ: জুন ১৯৭৯

৮। ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *