বিস্ময়কর সৃষ্টি মানুষের মন

সাকী মাহবুব ।।
.
মন এক বিমূর্ত বাস্তবতা। এটি এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। এর কোন দৃশ্যমান রুপ আমাদের সামনে নেই। থাকেও না। কারণ মনের শুরু কোথায় আর শেষ কোথায় তা কেউ জানে না। ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। কিন্তু আমরা সব সময়, জীবনের প্রতিক্ষণে, প্রতি মুহুর্তে এর তীব্রতা উপস্থিতি উপলব্ধি করি।
.
বাস্তবিকই, আমাদের সকল রুটিন, কাজ কর্ম,বিলকুল আচার আচরণ,সকল অনুভূতি এ মনকে কেন্দ্র করেই।আমাদের সুখ -দু:খ, হাসি -কান্না, ব্যথা -বেদনা সব কিছুই অনুভবের, উপলব্ধির কেন্দ্র হলো দুই অক্ষরের ছোট্র একটি শব্দ মন। কারো মন পাথরের মত, কারো মন নরম মাটির মত। কারো মন ধিরস্থির শান্ত নদীর মত, কারো মন পাখির মত চঞ্চল। কেউ শরীরে আঘাত পেলে কাঁদেন, কেউ বা কাঁদেন মনে আঘাত পেলে।
মন ভালো থাকলে আমরা ভালো থাকি। মন খুশি হলে আমরা খুশি হই, আনন্দে আত্নহারা হই। আবার মন দু:খে ককিয়ে উঠলে বেদনায় ভারাক্রান্ত হলে আমরা ভারাক্রান্ত হই,ব্যথাতুর হই। এক সেকেন্ড পরিমাণ সময়ের জন্যও মন তার কাজ রেখে বসে থাকে না। বিশ্বসাহিত্যের পরিচিত মুখ কবি শেখ সাদী তাই বলেন-
“মানুষের মন, কুমারের চাক,
মিনিটে ঘুরে বাহাত্তর পাক।”
এখন প্রশ্ন হলো, মন কি? এর অবস্থান, গঠন ও প্রকৃতিইবা কী রকম, এ বিষয় নিয়ে মানুষের মনে বিস্তর প্রশ্ন রয়েছে। যুগ যুগ ধরে দার্শনিকগণ যেমন এ প্রশ্নের  উত্তর খুঁজ ছেন, ঠিক তেমনি তাদের পাশাপাশি বিজ্ঞানীরাও মনের অবস্থান, এর গঠন, অবস্থান নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেছেন। কিন্তু মন, তার রুপ প্রকৃতি ও অবস্থান নিয়ে মানুষের জ্ঞানের দীনতা কাটেনি। এ গবেষণা আজও চালু রয়েছে বহতা নদীর মতো।
মন বলতে সাধারণত বুদ্ধি ও বিবেক বোধের এক সমষ্টিগত রুপকে বোঝায়। যা চিন্তা, অনুভূতি, আবেগ, ইচ্ছা ও কল্পনার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। মন কি এবং কিভাবে কাজ করে, সে সম্পর্কে অনেক রকম তত্ত্ব প্রচলিত আছে। এ সব তত্ত্ব নিয়ে চিন্তা ভাবনা মানবজাতির আদিকাল থেকে।
.
জড়বাদী দার্শনিকরা মনে করেন, মানুষের মন ও প্রবৃত্তির কোনো কিছুই শরীর থেকে ভিন্ন নয়, বরং মানুষের মস্তিষ্ক থেকে উদ্ভূত শারীরবৃত্তিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে মন গড়ে ওঠে।
একবিংশ মতাব্দীর প্রযুক্তি নির্ভর ডিজিটাল সংস্কৃতির এ যুগে মনের পরিচয় দিতে গিয়ে একজন পশ্চিমা গবেষক ও প্রখ্যাত বিজ্ঞানী স্যাম হ্যারিস একটি উদ্বৃতি উল্লেখ করেছেন এভাবে: the mind is the software of the brain. অর্থাৎ মন হলো ব্রেইনের সফটওয়ার।
.
আধুনিক যুগের ছেলেমেয়েদের কাছে তথা যারা আধুনিক প্রযুক্তি, কম্পিউটারের কার্যক্রম, তার উৎপত্তি, উপাদান ও ব্যবহারের সাথে সম্যক পরিচিত ;তাদের কাছে মনের রুপক সংজ্ঞা অত্যন্ত সহজ বলেই প্রতীয়মান হতে পারে। কিন্ত প্রযুক্তির জ্ঞানের ক্ষেত্রে যাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তাদের কাছে এ রুপক বর্ণনার  কোন আবেদন না থাকারই কথা।
.
আমরা মন বলে যে জিনিসটকে চিনি বা জানি বা অভিহিত করে থাকি,সেটা কোথায়?  তার পরিচয়ই বা কী?উত্তর হলো, মন বা অন্তর এবং নফস এটা এক। অন্তর বলতে বাংলা ভাষায় অনেক সময় আমরা হার্ট বা কলব কেও বুঝি। তবে মন বা অন্তর এবং নফস ও গুলো যে এক, তার প্রমাণ আমরা পাই বিজ্ঞানময় কুরআনুল কারীমের একটি সূরায়। ইরশাদ হচ্ছে “যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের কলব প্রশান্ত হয়, জেনে রাখ,আল্লাহর স্মরণেই কলব প্রশান্ত হয়। পবিত্র কুরআনে ১৩২ আয়াতে বিভিন্ন প্রসঙ্গে কলব শব্দটি এসেছে।আর ৪৯টি আয়াতে অন্তর, মন বা নফস এর কথা বলা হয়েছে। একে বিশেষ কোনো সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা অসম্ভব হলেও প্রিয় নবী (সা:) মানবদেহের একটি অঙ্গকে কলব বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর সেই অঙ্গটি হলো হৃৎপিন্ড। রাসূল (সা:) ইরশাদ করেন, জেনে রেখো, শরীরের মধ্যে একটি গোশতের টুকরা আছে, তা যখন ঠিক হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন ঠিক হয়ে যায়। আর তা যখন খারাপ হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন খারাপ হয়ে যায়। জেনে রেখ, সেই গোশতের টুকরাটি হলো কলব বা অন্তর। (বোখারী শরীফ হাদিস নং৫২)
কলব বা হার্ট শব্দটি সর্বপ্রথম উল্লেখিত হয়েছে সূরা আল বাকারার সাত নম্বর আয়াতে। এখানে কলব শব্দ দিয়ে হৃদয় বুঝানো হয়েছে। আর নফস শব্দটি সর্বপ্রথম এসেছে সূরা বাকারার নয় নম্বর আয়াতে। এখানে মহান আল্লাহ নফস দিয়ে মানুষের সত্তাকে বুঝিয়েছেন।
মরক্কোর প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ও মনোচিকিৎসক ডা:মেহেদি বিন আবুদ তাঁর point on the concept man and his spiritual powers in Islam নামক প্রবন্ধে ইসলামি শিক্ষা ও দর্শনের আলোকে মানুষের মন ও মানবিক সত্তাকে  the body, al -nafs (the soul)  the mind, the heart, arruh (the sprit) মোট এই পাঁচটি বিষয়ের সমন্বিত সত্তা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ:) বলেছেন “কলব সকল কিছুর মূল”।
প্রতিটি দেশের যেমন রাজধানী রয়েছে, তেমনি মানবদেহের রাজধানী হলো কলব। দেশের রাজধানী সুস্থ রাখা যেমন জরুরী, দেহের জন্য কলব সুস্থ রাখা তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি জরুরী।
প্রকৃত পক্ষে মনের সঠিক সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয়। তবে বলা যেতে পারে, মন হলো এমন কিছু, যা নিজের অবস্থা ও কাজকর্ম সমপর্কে সচেতন। বিজ্ঞানময় কুরআনুল কারীমে মানুষের মন সমপর্কে সংজ্ঞায়ন করতে গিয়ে তিন ধরণের মনের কথা বলা হয়েছে।যথা
১.নফসে মুতমায়িন্না- প্রশান্ত মন
২.নফসে লাওয়ামা- অপরাধে অনুতপ্ত মন
৩.নফসে আম্মারা- দুষ্টু মন।
এই তিন ধরণের মনের মধ্যে স্রষ্টার কাছে সর্বোৎকৃষ্ট মন হলো প্রশান্ত মন।
প্রশান্ত মনের পরিচয় ঃ 
 প্রশান্ত মন হলো, স্রষ্টার কথা শুনলে যে মন তৃপ্তি পায়।স্রষ্টা ছাড়া আর কিছুতেই মিষ্টি অনুভব হয় না, সবকিছু তিক্ত লাগে। এমন মন হলো প্রশান্ত বা পরিতৃপ্ত। কোরআনের ত্রিশতম পারায় সূরা ফজরে এই নফসে মুতমায়িন্না সমপর্কে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে -কিয়ামতের দিন প্রশান্ত মনকে বলা হবে, হে প্রশান্ত মন।তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট ফিরে এসো  সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে অত:পর প্রবেশ কর আমার বান্দাদের মধ্যে। এবং প্রবেশ কর আমার জান্নাতে। (সূরা ফজর, আয়াত নং ২৭-৩০)
ইমাম মুজাহিদ (রহ) বলেন- সেই মন প্রশান্ত, যে মহান আল্লাহকে প্রতিপালক বলে বিশ্বাস করেছে এবং আল্লাহর হুকুমের সামনে নিজেকে নত করে দিয়েছে।
অনুতপ্ত মনের পরিচয়ঃ
পবিত্র কুরআনে এসেছে নফসে লাওয়ামা-বা কৃত অপরাধে অনুতপ্ত মনের ব্যাপারে। সেখানে বলা হয়েছে, আমি কসম করছি কিয়ামত দিবসের। আর কসম করছি (সেই মনের, যে নিজেকে তিরস্কার করে) নফসে লাওয়ামার। (সূরা কিয়ামু১-২)অর্থাৎ তিরস্কারকারী অনুতপ্ত মন হলো নফসে লাওয়ামা।
মুফতি মুহাম্মদ শফী (রহ:) তাফসীরে মাআরেফুল কুরআনে লিখেছেন- লাওয়ামা-অর্থ তিরস্কার বা ধিক্কার দেয়া। নাফসে লাওয়ামা-বলতে এমন নাফসকে বোঝানো হয়েছে যে নিজেকে কাজ কর্মের হিসাব নিয়ে নিজেকে ধিক্কার দেয়।
কেউ কেউ বলেন – এটা এক অবস্থার উপর স্থির থাকে না। এপাশ ও পাশ করে।সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। প্রতি মুহুর্তে রং বদলায়। কখনও আল্লাহর স্মরণ কখনও গাফিল। আবার কখনও শয়তানের ধোকায় পড়ে মন্দ কাজও করে। এটা হচ্ছে দুষ্টু মনের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ লড়াই। এ জন্য রাসূল (সা:) বলেছেন –কুপ্রবৃত্তির সঙ্গে যুদ্ধ হলো শ্রেষ্ঠ জিহাদ।
দুষ্টু মনের পরিচয় ঃ
নাফসে আম্মারা সেই নাফস যা মানুষকে যাবতীয় অসৎ কর্মের প্রতি প্ররোচিত করে এটাই তার প্রকৃতি। এ ব্যাপারে কুরআনে এসেছে –নিশ্চয়ই নাফসে আম্মারা বদ কাজ করায়, তবে আল্লাহ যাদের ওপর রহম করেন।অবশ্যই আমার মালিক ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। (সূরা ইউসুফ -৫৩)
দুষ্টু মন মূলত মানুষকে খারাপ কাজের প্রতি প্রলুব্ধ করে, কুমন্ত্রণা জাগায়।তাই দুষ্টুচারিতা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া ইবাদতকামী মনের জন্য একান্ত কাম্য।
হযরত লোকমান হাকিমকে জিজ্ঞাসা করা হয়, পৃথিবীতে সবচেয়ে নিকৃষ্ট বস্তু কী? তিনি বলেছিলেন মানুষের” হৃদয়”। আর সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু কী? তিনি বলেছিলেন মানুষের “হৃদয় “। জিজ্ঞাসা করা হয় কেন? তিনি উত্তর দেন, এ হৃদয় মাঝে ভালো ও খারাপ চিন্তার উদয় হয় এর ফলেই মানুষ ভাল মন্দ কাজ করে। যার পরিণতিতে সে মানুষ অথবা পশুতে পরিণত হয়।
হৃদয় বড় অমূল্য সম্পদ। আল্লাহ বলেন, তাদের চক্ষু অন্ধ নহে, বরং তাদের হৃদয়ই অন্ধ যা তাদের বুকের ভেতর অবস্থিত। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরো বলেন, যাদের অন্তর আছে এবং শ্রবণ করার মতো হৃদয় আছে তাদের জন্য এতে (কুরআনে) উপদেশ রয়েছে।
রাসূল (সা:) বলেছেন, কলব বা অন্তর চার প্রকার। প্রথম প্রকার উজ্জ্বল অন্তর, যার ফলে সমস্ত অন্তর জগৎ আলোকিত থাকে। শয়তান সেখানে বাসা বাঁধতে পারে না। এটি হল মুমিনের কলব।দ্বিতীয় প্রকার হলো কালিমাযুক্ত অন্তর। যার মধ্যে কোনো আলো নেই।শয়তান সেখানে স্থায়ীভাবে ঘাঁটি তৈরি করে নিয়েছে। তারা কাফিরের আত্না। তৃতীয় প্রকার অন্তর যার মধ্যে নানা আবরণ, যথা লোভ, মোহ,স্বার্থ ইত্যাদি আবরণে অপরিচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। এটি হল মুনাফিকের অন্তর। চতুর্থ প্রকার হল মিশ্রিত অন্তর। যার মধ্যে ঈমান ও আছে এবং মুনাফিকীও আছে।
রাসূল (সা:) বলেছেন, “বনি আদমের অন্তর যদি শয়তান আকড়ে না রাখতো তাহলে তারা আলমে মালাকুত বা উর্ধ্ব জগতের অনেক রহস্যাবলী স্বচক্ষে দেখতে সামর্থ হতো। আল্লাহ বলেন সফল সেই ব্যক্তি যে তার অন্তরকে পবিত্র করে আর ব্যর্থ সেই ব্যক্তি, যে তার অন্তরকে  কলুষিত করে। (সূরা শামস আয়াত৯-১০)
ভারতের সাবেক শিক্ষা মন্ত্রী মাওলানা আবুল কালাম আজাদ দু:খ করে বলেছিলেন আমার ভয় হয় যে, হে জীবন্ত হৃদয় তোমার মৃত্যু না ঘটে; কেননা হৃদয়ের জীবনই সত্যিকারের জীবন।
মহান আল্লাহ বলেন -কিয়ামতের দিন কোনো অর্থ সম্পদ এবং সন্তান সন্ততি কারো কোনো উপকারে আসবে না। একমাত্র সে ব্যক্তি মুক্তি পাবে, যে সুস্থ কলব নিয়ে আল্লাহর কাছে পৌঁছবে। (সূরা শুআরা-৮৮-৮৯)
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন
             “বন্ধু বলিনি ঝুট,
এইখানে এসে লুটাইয়া পড়ে সকল রাজ মুকুট।
এই হৃদয় সেই নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন –
বুদ্ধ -গয়া-এ, জেরুজালেম এ,মদীনা,কাবা ভবন;
মসজিদ এই,মন্দির এই ; গীর্জা এই হৃদয়-
এই খানে বসে ঈসা-মুসা পেল সত্যের পরিচয়।
এই হৃদয়ের ধ্যান গুহা মাঝে বসিয়া  শাক্য মুনি
ত্যাজিল -রাজ্য, মানবের মহাবেদনার ডাকশুনি।
এই কন্দরে আরব দুলাল শুনিতেন আহবান,
এইখানে বসি গাহিলেন তিনি কোরানের সাম্য-গান,
মিথ্যা শুনিনি ভাই;
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির- কাবা নাই।”
সাকী মাহবুব, শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, গবেষক, পাংশা, রাজবাড়ী। মোবাইল :০১৭২৪ ৪৯৩৫৭২
তথ্যসূত্র :
১. মানবদেহের বিস্মযকর রহস্য
  কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক।
২. প্রকৃত মানুষ
সাইয্যেদ এইচ এম শহীদুল ইসলাম
৩. মন ও মানসিক স্বাস্থ্য 
  জিয়াউল হক
৪. যুক্তির নিরিখে স্রষ্টার অস্তিত্ব
সফিকুল ইসলাম ভুইজ্ঞা
৫. মাসিক অগ্রপথিক, আগস্ট ২০০৫
৬. দৈনিক কালের কন্ঠ ৬ জুলাই ২০১৯
৭. দৈনিক নয়াদিগন্ত ১৯ অক্টোবর ২০২০
দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ ৪এপ্রিল২০১৮
৯. স্টাডি সার্কেল, অধ্যাপক গোলাম আযম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *