মুক্তবুলি ডেস্ক ॥
১৯৭১ সালে ত্রিশলক্ষ আত্মবলিদানকারী সাহসী বীরদের একজন হলেন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। ১৯৪৯ সালে বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ থানার আগরপুর ইউনিয়নের রহিমগঞ্জ গ্রামে মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর জম্ন গ্রহণ করেন। পিতা মোতালেব হাওলাদার ও মাতা সাফিয়া বেগম গৃহিণী ছিলেন।
জাহাঙ্গীররা তিন ভাই, তিন বোন। পিতা একজন বাউলশিল্পী হওয়ায় সাংসারিক কাজকর্মেও তেমন মন ছিল না। জাহাঙ্গী’র লেখাপড়া বা তাঁর মানুষ হবার বিষয়েও পিতার ছিল গা ছাড়া ভাব। এই বিষয়টি লক্ষ করে জাহাঙ্গীর’র বড় মামা-মামি এগিয়ে এলেন ছোট্ট শিশুকে মানুষ করতে। তার নানা বাড়ী ছিলো মুলাদী উপজেলায়। ১৯৫৩ সালে সাড়েতিন বছর বয়সে মুলাদী উপজেলার পাতারচর গ্রামে পাতারচর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বড়মামা-মামি তাঁর লেখাপড়ার দেখভালও করতে থাকেন। জাহাঙ্গীর অংকে পারদর্শিতা লাভ করেন মামা-মামির হাত ধরেই। ফলে এই বালকটি সারা স্কুলে সবচেয়ে ভালো ছাত্র হিসেবে পরিচিতি পায়। মুলাদী মাহমুদজান পাইলট হাইস্কুলে মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ক্লাস সিক্সে ভর্তি হলেন। তিনি দুইবার সেই স্কুল থেকে বৃত্তি লাভ করেন। সেই স্কুল থেকেই সাফল্যের সাথে ম্যাট্রিকুলেশন (বর্তমান এসএসসি) পাশ করেন। মুলাদীতে তেমন ভালো কলেজ না থাকায় এরপর তিনি বরিশাল শহরে তাঁর মেজমামার বাড়িতে থেকে ব্রজমোহন কলেজে ভর্তি হলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি সেখান থেকেই এইসএসসি পাশ করেন।
এইচএসসি পাশ করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হলেন। তখন আবার তাঁর বড়মামা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন। চাকরিজনিত কারণে বড়মামা থাকতেন ফার্মগেটে। জাহাঙ্গীর ফার্মগেট থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা যাওয়া করেন। একদিন তিনি দেখলেন সেনাবাহিনিতে লোক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি। আবেদন করলেন এবং তাঁর স্বপ্ন সফল হলো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায়ই তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনিতে যোগ দেন। ১৫তম শর্টসার্ভিস কোরের প্রশিক্ষণার্থী ক্যাডেট অফিসার হিসেবে মনোনীত হলেন তিনি। ১৯৬৭ সালের ৩ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ না করেই তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি ‘কাকুল’এর উদ্দেশে রওয়ানা হন। সেনাবাহিনিতে তাঁর নম্বর ছিল পিএসএস-১০৪৩৯। দীর্ঘ আট মাসের প্রশিক্ষণের মধ্যে চারমাস শীতকাল এবং তখন বৃষ্টির মতো বরফ পড়ে। বরফের মধ্যেই চলে কঠিন প্রশিক্ষণ। ২ জুন ১৯৬৮ তিনি সোনাবাহিনির ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট পদে কমিশনপ্রাপ্ত হন। এরপর দীর্ঘ এক মাসের ছুটি মেলে। ছুটিতে বাড়ি এসে তাঁর যেন আর সয় না। পাকিস্তানের পশ্চিম অংশ কী চমৎকার টিপটপ অবস্থায় আছে। সবকিছুতেই আধুনিকতার ছোঁয়া, আধুনিক সব অট্টালিকা, শিক্ষা-দীক্ষা, প্রযুক্তিগত দিক, যোগাযোগ ব্যবস্থা সবকিছুতে উন্নত হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তান। আর আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের করুণ অবস্থা।সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে আছে বাংলা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করা (যদিও অসমাপ্ত) ছাত্র মহিউদ্দিনকে এই বিষয়গুলো খুব পীড়া দিতে থাকে। এর মধ্যে তাঁর এক মাসের ছুটি শেষ হয়ে গেল। তিনি বৈষম্যের গ্লানি-ক্ষোভ ও হতাশা নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে গেলেন।
১৯৬৮ সালের ৩ ডিসেম্বরে তাঁকে লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। আরও উন্নত প্রশিক্ষণের পর ১৯৭০এর ৩০ আগস্ট তিনি ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। কিন্তু তাঁর এই পদোন্নতিতে তিনি খুশি নন। তিনি দেখেছেন বাঙালিকে পাকিস্তানিরা কীভাবে দাবিয়ে রাখতে চায়। সামরিক বাহিনির ব্যারাকেও অন্যান্য পশ্চিমা সহকর্মীরা বাঙালি সৈনিকদের অবহেলার চোখে দেখত।
এর মধ্যে ২৫ মার্চ কালো রাত্রে পিশাচের দল নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হামলে পড়ে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য স্থানে পৈশাচিক কায়দায় হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। একরাতে তাঁরা একলাখ নিরস্ত্র মানুষকে মেরে ফেলে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে বাঙালি পুলিশ সদস্যদের অনেকে শহিদ হন এবং বাকিরা বীরদর্পে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি মর্নিং হেরাল্ড পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী শুধুমাত্র ২৫ মার্চ একরাতেই বাংলাদেশে প্রায় একলক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, যা গণহত্যার ইতিহাসে এক ভয়াবহতম ঘটনা।
২৫ মার্চ রাতের গণহত্যার খবর শুনে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ভীষণভাবে বিদ্রোহী হয়ে উঠেন। তখন তিনি পাকিস্তানের কারাকোরাম এলাকায় ১৭৩ ইঞ্জিনিয়ার্স ব্যাটেলিয়নে কর্মরত ছিলেন। চেষ্টা করতে লাগলেন কী করে পালানো যায়। জাহাঙ্গীরএর বন্ধু ক্যাপ্টেন হামিদ এর সহযোগিতায় আরও তিনজন অফিসারের সাথে যোগাযোগ হলো। এঁরাও পালাতে চান। তাঁরা হলেন ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন, মেজর শাহরিয়ার ও লে. কর্নেল আনাম। এদের মধ্যে ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন পরবর্তীতে যুদ্ধে শহিদ হন এবং বীরউত্তম খেতাবপ্রাপ্ত হন। জাহাঙ্গীর এর সাথে আগে অন্য তিনজনের পরিচয় ছিল না। হলে কী হবে, তাদের শরীরে যে বইছে একই বাংলা মায়ের রক্ত।
এদিকে চারজন বাঙালি সামরিক অফিসার সুদূর পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছে দেশের মুক্তি সংগ্রামে যোগ দেয়ার জন্য, এই খবর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং লক্ষ লক্ষ বাঙালি এতে অনুপ্রাণিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের চিফ কমান্ডার কর্নেল এমএজি ওসমানী যুদ্ধক্ষেত্র থেকে এই বীরদেরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য কলকাতায় চলে এলেন।
কলকাতা থেকে চারজন যোদ্ধাকে বিভিন্ন সেক্টরে পাঠানো হয়। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরকে পাঠানো হয় সবচেয়ে বেশি যুদ্ধবিক্ষুব্ধ ৭নং সেক্টরে, মেহেদীপুর ক্যাম্পে। ছাড়াছাড়ি হবার সময় জাহাঙ্গীর বলেছিলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা অংশ নেয়, তাদের মধ্যে খুব কম লোকই বেঁচে থাকে। অনেকেই স্বাধীনতার ফল ভোগ করে যেতে পারে না, যারা পারে তারা ভাগ্যবান। আমার সৌভাগ্য না-ও হতে পারে। কিন্তু তাকে কিছু আসবে যাবে না। যদি বাঁচি আবার দেখা হবে।
৭নং সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন লে. কর্নেল নুরুজ্জামান। মহিউদ্দিনকে একটি সাবসেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি তাঁর সাবসেক্টরকে নিজের মতো করে তৈরি করে নেন। মেহেদিপুরের সবচেয়ে কাছের শত্রু ঘাঁটি কানসাট। তিনি কানসাট অপারেশন সফলভাবে পারিচালনা করেন। এরপরের অপারেশন ছিল পাকিস্তানিদের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি শাহপুর। সেই ঘাঁটিও মহিউদ্দিন সফলভাবে দখল করতে সক্ষম হন। এভাবে একের পর এক যুদ্ধে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর বীরত্বের প্রমাণ দিয়ে শত্রুপক্ষকে নাস্তানাবুদ করতে থাকেন এবং শত্রুঘাঁটি দখলমুক্ত করতে থাকেন।
এদিকে পাকসেনারা চাঁপাইনবাবগঞ্জ দখল করে বসে আছে। শান্তিকামী নিরস্ত্র জনগণের ওপর নির্যাতন চালিয়ে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় করে দিচ্ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পুনরুদ্ধারের উদ্দেশে সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল নুরুজ্জামান এর নেতৃত্বে তিনটি দল গঠিত হয়। প্রথম দলের নেতৃত্বে মেজর গিয়াস, দ্বিতীয় দলের নেতৃত্বে মেজর রশীদ, তৃতীয় দলের নেতৃত্বে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। প্রথম দলের ওপর দায়িত্ব দেয়া হলো সড়ক অবরোধ করে চাঁপাইনবাগঞ্জকে রাজশাহী থেকে বিচ্ছিন্ন করা। সবচেয়ে কঠিন এবং দুঃসাহসী কাজটি দেয়া হলো তৃতীয় দল, ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরকে, চাঁপাই নবাবগঞ্জ দখল করা। ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১, ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর, লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম, লেফটেন্যান্ট আউয়ালসহ প্রায় ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা চাঁপাইনবাবগঞ্জের বারঘরিয়ায় অবস্থান নেন। পরিকল্পনা হলো, ভারতীয় অফিসার বিগ্রেডিয়ার প্রেম সিং এর নেতৃত্বে ১১ ডিসেম্বর বারঘরিয়ার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মহানন্দা নদীর ওপারে উঁচু বাঁধের ওপর শত্রুঘাঁটিতে আর্টিলাটির গোলা নিক্ষেপ করবে। এতে শত্রু সেনারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়বে এবং দুর্বল হয়ে যাবে। সাথে সাথে ক্যাপ্টন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর বীরদর্পে আক্রমণ চালিয়ে সেই ঘাঁটি দখল করবে। কিন্তু অজানা কারণে সেইদিন ভারতীয় বাহিনি শত্রুসেনাদের ওপর গোলা বর্ষণ করেনি। মহিউদ্দিন ১২ এবং ১৩ ডিসেম্বর অনেক চেষ্টা করেও ভারতীয় বাহিনির সাথে ওয়ারলেস যোগাযোগ করতে পারেননি। তিনি এতদূরে এসে আক্রমণ না করে ফিরে যাবার পক্ষপাতী ছিলেন না। সিদ্ধান্ত নিলেন ভারতীয় বাহিনির আর্টিলারি কাভার ছাড়াই আক্রমণ করে ফেলবেন। ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, ২০ জনের মতো সহযোদ্ধা নিয়ে সকাল ৮ টার দিকে রেহাইচর এলাকা দিয়ে ৩-৪টি নৌকায় করে মহানন্দা নদী পার হলেন মহিউদ্দিন ও তাঁর দল। এরপর শত্রুদের সাথে হাতাহাতি ও সম্মুখযুদ্ধ শুরু হলো। ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হলো সেই যুদ্ধ। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন উত্তরদিক থেকে শত্রু হনন করতে করতে দক্ষিণ দিকে যেতে লাগলেন।
কিন্তু কাজটা তত সহজ ছিল না। শত্রুরা ছিল সুরক্ষিত বাংকারের ভিতরে। সেখান থেকে তারা মুক্তিসেনাদের ওপর কামানের গোলা নিক্ষেপ করছিল। মহিউদ্দিন বাংকার ধ্বংসের কথা ভাবছেন। এর মধ্যে দেখেন এক কিশোর যোদ্ধা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংকারের ওপর দুটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। এতে করে মহিউদ্দিন তার বাহিনি নিয়ে শত্রু বাহিনির দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন।
শত্রুসেনারা অনেকগুলো বাংকার তৈরি করে রেখেছিল। দুটো ধ্বংস হলেও অন্যগুলো থেকে তারা বৃষ্টির মতো গোলা বর্ষণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের হতাহত করছিল। কয়েকজন সহযোদ্ধা তাঁর চোখের সামনেই মৃত্যুবরণ করেন। মহিউদ্দিন একটি গ্রেনেড শত্রুর বাংকারে ছুঁড়ে সেটি ধ্বংস করে দেন এবং সরে পড়তে চেষ্টা করেন। এমন সময় হঠাৎ করে সাইপারের একটি বুলেট তাঁর একেবারে কপালে এসে লাগে। সাথে সাথে তিনি বাংলা মায়ের কোলে লুটিয়ে পড়েন। সামনা সামনি যুদ্ধে বীরের মতো লড়তে লড়তে প্রাণ ত্যাগ করেন এই যোদ্ধা। ২-৩ জন যোদ্ধা নদী সাঁতরে এসে তাঁর মৃত্যুসংবাদ দেয়। সেই খবরে মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই আরও তীব্র করেন এবং পাকবাহিনি সেই ঘাঁটি থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পরের দিন মহিউদ্দিনের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। যুদ্ধকালীন মহিউদ্দিনের সাংকেতিক নাম ছিল টাইগার। টাইগারের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী পূর্ববর্তী সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুল হকের সমাধির পাশে সোনা মসজিদ প্রাঙ্গণে তাঁকে দাফন করা হয়। সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল নুরুজ্জামান দাফনক্রিয়ার সময় সশরীরে উপস্থিত ছিলেন।
বীরদের রক্তেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। শহিদদের আত্মবলিদানে বাংলার সাত কোটি মানুষ নিজেদের মানচিত্র ও পতাকা পেয়েছে। এঁদের ঋণ শোধ হবার নয়। বাঙালি সবসময় কৃতজ্ঞচিত্তে তাঁকে স্মরণ করবে।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক: