ভোলায় আমার সংস্কৃতি চর্চা

আযাদ আলাউদ্দীন

১৯৯২ সাল। তখন আমি সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। শিল্পী সাইফুল্লাহ মানছুরের কন্ঠে রেকর্ড প্লেয়ারে ফিতায় বাজানো ‘তুমি রহমান… তুমি মেহেরবান…গানটির মাধ্যমে প্রথম ইসলামী সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হই। এরপর বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার থেকে প্রকাশিত ইসলামী সংগীত সিরিজের অ্যালবামগুলো সংগ্রহ করি। ঢাকার সাইমুম ও চট্রগ্রামের পাঞ্জেরি শিল্পীগোষ্ঠীর অ্যালবামগুলো প্রকাশ করে স্পন্দন অডিও ভিজ্যুয়াল সেন্টার। সিএইচপি ব্রান্ডের এই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে ইসলামী সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারে সবচেয়ে বেশি এবং প্রধান ভূমিকা পালন করে। এসব গান শোনার পর পর্যায়ক্রমে ইসলামী সংস্কৃতির দিকে আকৃষ্ট হই। সংগ্রহ করি কবি মতিউর রহমান মল্লিকের গানের বই ‘ঝংকার’। তৎকালীন সমসাময়িকদের মধ্যে যাদের কণ্ঠ ভালো তাদেরকে এসব গানের অ্যালবাম শুনতে উদ্বুদ্ধ করি। আমি নিজেও রাতে ক্যাসেট বাজিয়ে শুনতে শুনতে অনেক গান মুখস্ত করে ফেলি। এক পর্যায়ে ১৯৯৫ সালের দিকে ভোলার মির্জাকালু ও হাকিমউদ্দিন এলাকায় তৈরি হয় ইসলামী গানের একটি গ্রুপ। সেই গ্রুপে ছিলেন- মুসা তারেক, তৈয়ব উল্যাহ, আবু আবদুল্লাহ সবুজ, হারুন অর রশিদ, মোরশেদ আলম, আজিম উদ্দিন খান প্রমুখ। এই গ্রুপটি তখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিশেষ করে তাফসিরুল কুরআন মাহফিলে একক ও যৌথভাবে ইসলামী গান পরিবেশন করতো। পরবর্তীতে এই গানের দলটি ভোলার আলহেরা শিল্পীগোষ্ঠীর- মির্জাকালু শাখা হিসেবে কাজ করে। গ্রাম পর্যায়ে চলতে থাকে ইসলামী ভাবধারায় সাংস্কৃতিক কার্যক্রম।

১৯৯৪ সালে ভোলার কবি মোজাম্মেল হক টাউন হলে অনুষ্ঠিত হয় ছাত্র সংগঠনের স্মরণীয় একটি কর্মি সম্মেলন। তখন ছাত্র সংগঠনের জেলা সভাপতি ছিলেন আবু জাফর চৌধুরী। সেই সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে আসেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি রফিকুল ইসলাম খান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য আমন্ত্রিত হন ঢাকার সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীর সদস্যরা। শরীফ বায়জীদ মাহমুদের নেতৃত্বে শিল্পী মশিউর রহমান লিটন, শাজাহান কবিরের মতো শিল্পী ও অভিনেতাদের পরিবেশনা দেখে সেদিন মুগ্ধ হন ভোলার শত শত দর্শক।

সেই বছর-ই ভোলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে শক্তিশালী করার জন্য হাদিসুর রহমান কে পরিচালক ও হাফেজ ফজলুর রহমান ফারুককে সহকারী পরিচালক করে গঠিত হয় আলহেরা শিল্পীগোষ্ঠীর কমিটি। ভোলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শুরু হয় সৃজনশীল সংস্কৃতি চর্চার আনুষ্ঠানিক পথচলা। তখন এই শিল্পীগোষ্ঠীতে ভালোমানের বেশ কয়েকজন কণ্ঠশিল্পী ও অভিনেতার দুর্দান্ত পারফর্মে এগিয়ে যায় সংগঠনটি।

১৯৯৮ সালের শেষের দিকে আমি ভোলা শহরে অবস্থান করি। তখন আলহেরা শিল্পীগোষ্ঠীর পরিচালক ছিলেন আবু আবদুল্লাহ। আমি ছিলাম সহকারি পরিচালক। শিল্পী জাফর ফিরোজ (পরবর্তীতে অনুপমের পরিচালক), কবির হোসেন নোমান, শরীফ মো. ফয়সাল, ডা. হাসানাইন আহমেদ, হাসান আল বান্না, কাইয়ুম সহ আরো অনেকেই ছিলেন অ্যাকটিভ শিল্পী ও দক্ষ সংগঠক। সবমিলিয়ে ভালোই চলছিলো এই সংগঠনের কার্যক্রম।

১৯৯৯ সাল ছিলো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মশতবার্ষিকী। সেবছর কবি মতিউর রহমান মল্লিকের সমন্বয়ে সারাদেশে জমকালো আয়োজনে দিবসটি পালন করে বাংলাদেশ সংস্কৃতিকেন্দ্র। তার ছোঁয়া এসে লাগে দ্বীপজেলা ভোলায়। বর্ণাঢ্য আয়োজনে নজরুল জন্মশত বার্ষিকী পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেই অনুষ্ঠানের উদ্বোধক ছিলেন সাবেক মন্ত্রী মোশারেফ হোসেন শাজাহান। প্রধান অতিথি ছিলেন নাট্য ব্যক্তিত্ব ও অভিনেতা আরিফুল হক। বিশেষ অতিথি ছিলেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক। বিশেষ আকর্ষণ ছিলেন আলোচিত কণ্ঠশিল্পী মাস্টার আরিফ।

একমাসব্যাপি চলে সেই অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি। তৎকালীন সময়ের ছাত্রনেতা ও সংগঠক আবু জাফর চৌধুরী, মো. আব্বাস উদ্দিন, আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, মীর শরীফ হোসাইন, অ্যাডভোকেট ইলিয়াস হোসেন সুমন, আতাউর রহমান কামাল, ইউনুছ শরীফ, মেহেদী হাসান সুমন, কামাল উদ্দিন মোল্লা সহ পুরো ভোলা জেলার ডানপন্থী সকল সংগঠক ঐক্যব্ধ হয়ে কাজ করেন এই অনুষ্ঠান বাস্তবায়নের জন্য।

আবু আবদুল্লাহ ভাইর ভোলা আলিয়া মাদরাসা সংলগ্ন বাসায় রাত জেগে পোস্টারে স্ক্রিন পিন্ট করা, পোস্টার লাগানো, আদর্শ একাডেমিতে সকাল-বিকেল ছোট এবং বড় শিল্পীদের রিহার্সেল- সবমিলিয়ে চলে রাতদিনের কর্মযজ্ঞ। অবশেষে অনুষ্ঠিত হলো সফল এক অনুষ্ঠান। বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে ওই অনুষ্ঠানের খবর। পরিচালক আবু আবদুল্লাহ তখন মানব জমিন পত্রিকার ভোলা জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আর আমি ছিলাম দৈনিক জনতা পত্রিকায়। আলহেরা শিল্পীগোষ্ঠীর পরিচালক-সহকারি পরিচালক আমরা দুজনই সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত থাকায় অনুষ্ঠানের মিডিয়া কভারেজ ছিলো আশাতীত। ভোলার আলহেরা শিল্পীগোষ্ঠীর জন্য মাইলফলক এবং আমাদের স্মৃতিতে অমলিন হয়ে থাকবে নজরুল জন্মশতবর্ষের সেই অনুষ্ঠান। এরকিছুদিন পর বরিশাল বিএম কলেজের বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়ে আমি বরিশাল চলে আসি। সেই থেকে শুরু হয় আমার বরিশালের অধ্যায়।

আযাদ আলাউদ্দীন, সাবেক সহকারী পরিচালক, আলহেরা শিল্পীগোষ্ঠী, ভোলা।

One comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *