মুমিনের বৈশিষ্টাবলী

আলহাজ মোঃ আবু ছাঈদ :
প্রারম্ভিকাঃ যে সব ব্যক্তি আল্লাহকে না দেখেও তাঁকে একক সত্ত্বা হিসাবে বিশ্বাস করে এবং তাঁর প্রেরিত রাসূলকে বিশ্বাস করে। তাঁর বিধানাবলীকে অকপটে মেনে নেয় তারাইতো মুমিন।
একজন খাঁটি মুমিনের গুণ বা বৈশিষ্ট্য হলো- পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে আদায় করবে। ফজরের নামাজ আদায় করে, যিকির আযকার করে হালাল রিযিকের সন্ধানে বেরিয়ে পড়বে। যেকোন কাজ করার পূর্বে আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের (সঃ) তরীকা জেনে সে অনুযায়ী করবে। হাতে কাজ করবে, মুখে আল্লাহর যিকির ও অন্তরে আখিরাতের চিন্তা থাকবে। ইচ্ছাকৃত ভাবে কখনও নামায ত্যাগ করবে না। রোযা ছাড়বেনা, চুরি-ডাকাতি করবে না, অপরের হক নষ্ট করবে না, যেনা-ব্যাভিচার করবে না, মিথ্যা-গীবত করবে না, কাউকে কষ্ট দিবে না, আল্লাহপাক অসন্তুষ্ট হন এমন কোন কাজ করবে না ইত্যাদি।

কুরআন-হাদিসে মুমিনদের অনেক বৈশিষ্ট্য বা গুণের কথা বলা হয়েছে।
মুমিনের গুণ বা বৈশিষ্ট্যাবলীঃ পবিত্র কুরআনের অসংখ্য স্থানে মুমিনের প্রকৃত বৈশিষ্ট্যাবলী বর্ণিত হয়েছে। “সূরা মুমিনের” প্রথম দিকের কয়েকটি আয়াত এবং সূরা আনফাল প্রথম দিকের কয়েকটি আয়াতের মাধ্যমে মুমিনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলী তুলে ধরার চেষ্টা করব ইনশা আল্লাহ। সূরাতুল মুমিনুন এর প্রথম দিকে আল্লাহপাক এরশাদ করেনঃ “আসলে মুমিনরাই সফল, যারা নিজেদের নামাজে বিনয়ী-নম্র-ভীত (সম্পূর্ণভাবে আল্লাহতে নিবিষ্ট)। আর যারা অনর্থক কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকে। আর যারা যাকাতের ব্যাপারে সক্রিয়। আর যারা তাদের নিজেদের লজ্জাস্থানের হিফাজতকারী। তবে তাদের স্ত্রী ও তাদের মালিকানাভুক্ত ক্রীতদাসী ছাড়া, নিশ্চয়ই এতে তারা নিন্দনীয় হবে না। অতঃপর যারা এদের বাইরে অন্যকে কামনা করে, তারাই সীমালঙ্ঘনকারী। আর যারা নিজেদের আমানতসমূহ (আল্লাহর আদেশ, সততা, নৈতিকতা, আস্থা ইত্যাদি) ও প্রতিশ্রুতি ঠিক রাখে, আর যারা নিজেদের (নির্ধারিত সময়ে পাঁচওয়াক্ত আবশ্যিক জামাতবদ্ধ) সালাতে থাকে যত্নবান। তারাই হবে প্রকৃত ভাবে জান্নাতের উত্তরাধিকারী। যারা (জান্নাতুল) ফেরদাউসের অধিকারী হবে, তারা সেখানে চিরস্থায়ী হবে।” (সূরা মুমিনুন ১-১১ নং আয়াত)

আবার সূরা আনফালের প্রথম দিকে আল্লাহপাক এরশাদ করেন-
“নিশ্চয়ই মুমিনতো তারা, আল্লাহর স্মরণে যাদের অন্তর প্রকম্পিত হয়। যখন তাদের উপর তাঁর আয়াত সমূহ পাঠ করা হয়, তখন তাঁদের ইমান বৃদ্ধি পায় এবং যারা তাদের প্রভুর উপর ভরসা করে। আর যারা নামায কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি, তা হতে ব্যয় করে, তারাই প্রকৃত মুমিন। তাদের জন্য রয়েছে তাদের রবের নিকট উচ্চ মর্যাদা সমূহ এবং ক্ষমা ও সম্মানজনক রিযিক।” (সূরা আনফাল ২-৪ আয়াত)

উপরোক্ত আয়াত সমূহের আলোকে মুমিনের গুণাবলী বা বৈশিষ্ট্য সমূহের সংক্ষিপ্ত রূপ তুলে ধরা হলোঃ-
মুমিনের প্রথম গুণ হলোঃ- আল্লাহর কথা স্মরণ হওয়া মাত্রই তাদের অন্তর কেঁপে উঠে। যতো ধরনের লোভ-লালসা আসুক না কেন, আল্লাহর কথা স্মরণ হওয়া মাত্রই গুণাহ বর্জন করে এবং খাঁটি মনে তওবা করে।
সহীহ বুখারীর এক হাদিসে আছে, কিয়ামতের দিন সাত প্রকার মানুষ আল্লাহর আরশের নিচে ছায়া লাভ করবে। তার মধ্যে এক প্রকার হলো- “ঐ ব্যক্তি, যাকে কোনো বংশীয় রূপসী-সুন্দরী মেয়ে কু-কর্মের জন্য আহবান জানায়, কিন্তু সে একথা বলে প্রত্যাখ্যান করে যে, আমি আল্লাহকে ভয় করি, এসময় তার অন্তর আল্লাহর ভয়ে কেঁপে উঠে। একমাত্র আল্লাহর ভয়েই সে পাপ কাজ থেকে বিরত থাকে।” (বুখারী, মুসলিম, তিরমিজী, নাসাই)

সূরা মুমিনুনে বলা হয়েছে মুমিনরা নিজেদের নামাজে বিনয়ী-নম্র ও ভীত অর্থাৎ আল্লাহর স্মরণে তারা বিনম্র, বিনয়ী ও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মান্য করার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে।
মুমিনের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য বা গুণ হলোঃ- “তাদের সামনে কুরআন তিলাওয়াত করলে তাদের ইমান বৃদ্ধি পায়। আমাদের পূর্ববর্তী মুমিন ব্যক্তিদের অভ্যাস ছিল ঘরে নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করতেন। স্ত্রী-সন্তান ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের দিয়ে তিলাওয়াত করাতেন। ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) রমযান মাসে প্রতিদিনে এক খতম এবং প্রতিরাতে এক খতম কুরআন তিলওয়াত করতেন। হাদিসে এসেছে, যে ঘরে কুরআন তিলাওয়াত করা হয়, সে ঘরে আল্লাহ পাকের খাছ রহমত নাযিল হয়। সে ঘরের বাচ্চারা ছোট বেলা থেকেই দ্বীনদার আল্লাহওয়ালা হয়ে ওঠে।
মুমিনের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হলোঃ- “তারা একমাত্র আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে। সকল কাজে আল্লাহর উপর ভরসা করাকে তাওয়াক্কুল বলে। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে, আল্লাহ তাকে সমস্ত বিপদাপদ থেকে হেফাজত করেন, সমস্ত পেরেশানী দূর করে দেন, উত্তম রিযিক দান করেন এবং তিনিই তার অভিভাবক হয়ে যান। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন- “যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তাকে দুঃখ কষ্ট থেকে মুক্তির পথ বের করে দেন এবং তিনি এমন স্থান থেকে তার রিযিকের ব্যবস্থা করেন যা সে কল্পনাও করতে পারবে না। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান। আল্লাহ তাঁর উদ্দেশ্যে পূর্ণ করবেনই। নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রত্যেক জিনিসের জন্য একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন।” (সূরা তালাক- ২,৩)

হযরত উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সঃ) বলেছেন- “তোমরা যদি আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ তাওয়াক্কুল করতে, তাহলে তিনি অবশ্যই তোমাদেরকে পাখির মতই রিযিক দিতেন। পাখিরা ভোরবেলা খালি পেটে বাসা থেকে বের হয়ে যায় এবং সন্ধ্যা বেলা উদরপূর্তি করে ফিরে আসে।” (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)
মুমিনের চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হলোঃ- “তারা যথা সময়ে নামায কায়েম করে।”
আবার সূরা মুমিনুনে বলা হয়েছে- “মুমিনরা নিজেদের সালাতে থাকে যত্নবান।”
বিশিষ্ট সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, আমি নবী (সঃ) কে জিজ্ঞেস করলাম- কোন আমল আল্লাহর নিকট সর্বাধিক পছন্দনীয়? তিনি বললেন যথা সময়ে নামাজ আদায় করা। পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন তারপর কোনটি? তিনি বললেন, পিতা-মাতার খেদমত করা। তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন; এরপর কোনটি? তিনি বললেন, দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। (বুখারী ও মুসলিম)
মুমিনের পঞ্চম বৈশিষ্ট্য বা গুণ হলোঃ- “তারা উদার মনে আল্লাহর রাস্তায় দান-খয়রাত করে, কখনো কৃপণতা করে না।”
কৃপণ ব্যক্তি কখনো আল্লাহর ওলী এমনকি পূর্ণ মুমিনও হতে পারে না।

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সঃ) বলেন- আল্লাহর রাস্তার ধূলোবালি ও জাহান্নামের আগুনের ধোঁয়া কখনো বান্দার পেটে একত্র হবে না। অনুরূপভাবে কৃপণতা ও পূর্ণ ঈমান কখনো বান্দার পেটে একত্র হবে না। (নাসাই)
মহান আল্লাহ বলেন- “যারা তাদের সম্পদ দান করে রাতে ও দিনে, (গোপনে ও প্রকাশ্যে)। তাদের জন্যই রয়েছে তাদের প্রভুর নিকট পুরষ্কার। (মৃত্যুর পরে) তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা চিন্তিত ও হবে না।” (সূরা বাকারাহ ২৭৪)
মুমিনদের ষষ্ঠ বৈশিষ্ট্য হলোঃ- “আর যারা অনর্থক কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকে।” অর্থাৎ যে সব কথা বা কাজে কোন ধর্মীয় উপকার নেই, বরং ক্ষতি বিদ্যমান। তা থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব। রাসূল (সঃ) বলেছেন- “মানুষ যখন অনর্থক বিষয়াদি ত্যাগ করে, তখন তার ইসলাম সৌন্দর্য মন্ডিত হয়।” একারনেই এটাকে মুমিনের বিশেষ গুণ সাব্যস্ত করা হয়েছে।

মুমিনের সপ্তম বৈশিষ্ট্য বা গুণ হলোঃ- “যারা তাদের নিজেদের লজ্জাস্থানের হিফাজতকারী।” অর্থাৎ যারা স্ত্রী ও শরীয়ত সম্মত দাসীদের ছাড়া সব পর নারী থেকে যৌনাঙ্গ কে সংযত রাখে এবং এই দুই শ্রেণির সাথে শরীয়তের বিধি মোতাবেক কামচরিতার্থ করা ছাড়া অন্য কারো সাথে কোন অবৈধ পন্থায় কামনা-বাসনা পূর্ণ করতে প্রবৃত্ত হয়না।
মুমিনের অষ্টম বৈশিষ্ট্য হলোঃ- আমানত প্রত্যার্পণ করে। আমানত-এ এমন প্রত্যেকটি বিষয় শামিল, যার দায়িত্ব কোনো ব্যক্তি বহন করে এবং সে বিষয়ে কোনো ব্যক্তির উপর আস্থা স্থাপন ও ভরসা করা হয়। হুকুকুল্লাহ তথা আল্লাহর হক সম্পর্কিত আমানত হোক কিংবা হুকুকুল ইবাদ তথা বান্দার হক সম্পর্কিত হোক। সব ধরনের আমানত রক্ষা করা মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
আল্লাহর হক সম্পর্কিত আমানত হচ্ছে শরীয়ত আরোপিত সকল ফরয ও ওয়াজিব পালন করা এবং যাবতীয় হারাম ও মাকরূহ বিষয়াদি থেকে আত্মরক্ষা করা। বান্দার হক সম্পর্কিত আমানতের মধ্যে আর্থিক আমানত যে অন্তর্ভুক্ত, তা সুবিদিত; কেউ কারো কাছে টাকা-পয়সা গচ্ছিত রাখলে তা তার আমানত প্রত্যার্পন পর্যন্ত এর হিফাজত করা তার দায়িত্ব। এছাড়া কেউ কোনো গোপন কথা কারও কাছে বললে তাও তার আমানত। শরীয়ত সম্মত অনুমতি ব্যাতিরেকে কারও গোপন তথ্য ফাঁস করা আমানতে খেয়ানতের অন্তর্ভুক্ত।

মুমিনের নবম বৈশিষ্ট্য বা গুণ হলোঃ- অঙ্গীকার পূর্ণ করা। অঙ্গীকার বলতে প্রথমত; দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বোঝায়, যা কোন ব্যাপারে উভয় পক্ষ অপরিহার্য করে নেয়। এরূপ চুক্তি পূর্ণ করা ফরজ এবং খেলাফ করা বিশ্বাসঘাতকতা প্রতারণা তথা হারাম। দ্বিতীয় প্রকার অঙ্গীকারকে ওয়াদা বলা হয়। এক্ষেত্রে এক তরফা ভাবে একজন অন্যজনকে কিছু দেওয়ার অথবা অন্যজনের কোন কাজ করে দেওয়ার ওয়াদা করা, এরূপ ওয়াদা পূর্ণ করাও শরীয়তের আইনে জরুরী ও ওয়াজীব। রাসূল (সঃ) বলেন- ওয়াদা এক প্রকার ঋণ। মহান আল্লাহ আমাদেরকে মুমিনের প্রকৃত বৈশিষ্ট্্যাবলী অর্জনের তাওফীক দান করুন। “আমিন”

আলহাজ মোঃ আবু ছাঈদ
সিনিয়র শিক্ষক
বরিশাল সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়

Next Barisal banner ads

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *