মেজর এম এ জলিলের সংগ্রাম

মাহমুদ ইউসুফ

মেজর এম এ জলিল ইতিহাস নির্মাতা। দেশের ইতিহাসে যারা মানুষের মুক্তির পথ বাতলে দিয়ে গেছেন, সেই গুটিকয়েক নায়কদেরই একজন মেজর জলিল। শৃঙ্খলিত রাষ্ট্রকে মুক্ত করতে তিনি জাতিকে শিখিয়েছেন ভ্রাতৃত্ব, ঐক্য ও সংহতির মহৎ আদর্শ। তাইতো এদেশের মানুষ তাঁর কাছে চিরঋণী।

আধিপত্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ প্রগতির অন্তরায়। মানবজাতির স্বাভাবিক জীবনের অন্তরায়ও বটে। বহিরাগত আক্রমণ, বৈশ্বিক আগ্রাসনে মানুষ মৌলিক চাহিদা পূরণেও ব্যর্থ হয়। সৃজনশীল চিন্তাভাবনা, গবেষণাকর্ম তো অনেক দূরের কথা, যুগে যুগে উপনিবেশবাদীরা চড়াও হয় শান্তিকামী জনতার ওপর। মনে পড়ে একাদশ-দ্বাদশ শতকের কথা। বর্বর ইউরোপীয়রা পঙ্গপালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে আরব মুলুকে। জেরুজালেমে খ্রিস্টানরা ১৯৯৯ সালে একদিনে হত্যা করে ৭০ হাজার মুসলিম নর-নারী-শিশু। দ্বাদশ শতক জুড়ে চলে তাদের হত্যাযজ্ঞ। ইমামউদ্দিন জেঙ্কি ও নুরুদ্দিন জেঙ্কি প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন দানবীয় ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে। অবশেষে সালাহউদ্দিন আইয়ুবি ১১৮৭ সালে সাম্রাজ্যবাদীদের রাহুগ্রাসমুক্ত করেন জেরুজালেমসহ আরব দুনিয়া।

ইউরোপীয় খ্রিস্টান ধর্মযোদ্ধারাই রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে বাংলাদেশে আধিপত্যবাদ পয়দা করে ১৭৫৭ সালে। এই পিশাচদের প্রতিরোধের ডাক দেন তরুণ নবাব সিরাজদৌলা। কিন্তু জগৎশেঠদের ছলচাতুরীতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন মুর্শিদাবাদে। একই সাথে সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে রইলেন নবাব সিরাজ। তাঁরই ওয়ারিশ মজনু শাহ, হায়দার আলি, টিপু সুলতান, সাইয়েদ আহমদ, শাহ ইসমাইল, তিতুমির, রজব আলি, শের আলি, শরিয়তউল্লাহরা এ সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন।

বিশ শতকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ খতম হলেও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ মাথাচাড়া দেয়। জাপানকে ওরা হালাক করে দিয়েছিল এটম বোমা দিয়ে। দক্ষিণ আমেরিকায় মার্কিন আধিপত্যবাদ পর্যুদস্ত হয় চেগুয়েভারের প্রবল প্রতিরোধে আর দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলসন মেন্ডেলার সংগ্রামে। ভিয়েতনামিরা হটিয়ে দেয় মার্কিন দস্যুদের। কিন্তু আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিনে আজও মার্কিন শকুনেরা উঁকিঝুঁকি মারছে। জিনঝিয়াংএ চাইনিজ সাম্রাজ্যবাদ, আরাকানে বার্মিজ সম্প্রসারণবাদ ঝেঁকে বসেছে। আর বাংলাদেশ! দিল্লির দলনে দলিত। ভারতীয় সম্প্রসারকদের সহিংসতায় সলিল সমাধি হতে যাচ্ছে বাঙালি জাতির! যেন ২০ কোটি রোহিঙ্গা ভাসছে বঙ্গোপসাগরে! বিগত অর্ধশত বছর যাবত হিন্দুস্তানি হিংস্রতায় রাজনৈতিক, অর্থনেতিক, কুটনৈতিক, গোয়েন্দাবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক দেউলিয়াত্বের শিকার। মুক্তিযুদ্ধের লড়াকু সৈনিক মেজর মোহাম্মাদ আবদুল জলিল স্বাধীনতার সূচনালগ্নেই চিনতে পেরেছিলেন বাংলাদেশের এই চিরশত্রুকে। তাইতো তিনি চিহ্নিত হন ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে। বরখাস্ত হন চাকরি থেকে। বঞ্চিত হন পদ-পদবি থেকে। জেল-জুলুমের গ্লানি গুণতে গুণতে প্রাণবায়ু উড়ে যায় ১৯৮৯ সালে। প্রতিবাদমুখর রাজনৈতিক মঞ্চে ধুমকেতুর মতোই আবির্ভাব। একইভাবে প্রস্থান। তবে জাতির যে উপকার করেছেন তাহলো- বাংলাদেশকে দিল্লির দাস বানানোর স্বপ্ন ভঙ্গ করে দিয়েছেন।

ভারতের সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান ফিল্ড মার্শাল মানেক শ’ ভারতের শীর্ষস্থানীয় একটি ইংরেজি কাগজে সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘যদি বাংলাদেশকে একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয় তাহলে ভারতের আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। যেদিন আমার সৈনিকরা বাংলাদেশকে মুক্ত করে সেদিনই আমি এ কথা উপলব্ধি করি। বাংলাদেশিদের কখনোই ভারতের প্রতি তেমন ভালোবাসা ছিলো না। আমি জানতাম ভারতের প্রতি তাদের ভালোবাসা অস্থায়ী। অনুপ্রেরণা লাভের জন্য ভারতের দিকে না তাকিয়ে তারা মক্কা ও পাকিস্তানের দিকে দৃষ্টিপাত করবে। আমাদেরকে সত্যাশ্রয়ী হতে হবে। বাংলাদেশিদের প্রতি আমরা সঠিক আচরণ করিনি। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের সব রকমের সাহায্য করা উচিত ছিলো। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা তা করেন নি। তারা বেনিয়ার মতো আচরণ করছেন।’ [দৈনিক স্টেটস্ম্যান, ২৯ এপ্রিল ১৯৮৮] বীর উত্তম খালেদ মোশারফ ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরেই বলেছিলেন- ‘ভারতীয়রা আমাদের ভুটান সিকিম বানাবে।’ তিনি আরও বলেন- ‘তারা আমাদের চাইনজি অস্ত্র নিয়ে ভারতীয় নিম্নমানের অস্ত্র দিচ্ছে, আমাদেরকে তাদের পদানত করে রাখার জন্য।’ [সাপ্তাহিক, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭] এই ভারত নাকি বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু!

মার্কিন-ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ গোটা দুনিয়ার জন্যই ক্ষতিকর। তবে তারচেয়েও বেশি বিপদজনক ভারতীয় সা¤্রাজ্যবাদ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর সত্যাসত্য আরও বেশি জোরালো। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভূটান, মালদ্বীপ, নেপাল, বাংলাদেশে ভারতই সবচেয়ে বেশি বিপদাঙ্ক। ভারত সর্বদা শুধুই নিজের জন্য। ভারত কারও বন্ধু হতে পারে না। ভারতের অতীত ইতিহাস তাই বলে। তাদের অতীত কাহিনি শুধুই রক্তারক্তি। আদিমকাল থেকেই ভারতে যুদ্ধ-বিগ্রহ, হিংসা-দ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতার রক্ত বইছে। রক্তারক্তি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনে ভারত শীর্ষে। বোম্বের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মোনালি ঠাকুর যথার্থই বলেছেন, ‘ভারত আর বসবাস করার মতো জায়গা নয়! ভারতীয়রা তো জানোয়ারের থেকেও অধম।’ আক্ষেপের সঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে আমি ভীষণ লজ্জিত হই যখন দেখি বিদেশীরা ভারতবর্ষকে বসবাসের যোগ্যই মনে করে না। তাঁদের ধারণা ভারত একেবারেই নিরাপদ স্থান নয়। এগুলো শুনলে সত্যি খুব কষ্ট হয়। …
দেখতে গেলে, আমরা লোক দেখানোর জন্যই যেন উন্নত হচ্ছি। কিন্তু আসলে অধঃপতনই ঘটছে। মানুষ যেন পশুর মতো হয়ে উঠছে। যদিও পশুদের পাশবিক প্রবৃত্তিটা খুবই স্বাভাবিক। সেটাই ওদের ন্যাচারাল ইন্সটিঙ্কট। কিন্তু আমরা তো মানুষ! আমরা তো ওদের থেকেও খারাপ। পশুদের থেকেও আমাদের আচরণ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।’ [কলকাতা ২৪দ্ধ৭, দৈনিক কালের কণ্ঠ, ১১ মে ২০১৮]

মেজর জলিলের সংগ্রাম এর ছবির ফলাফল

ইতিহাসের প্রতিবাদী চরিত্রসমূহের মধ্যে এম এ জলিলের নাম প্রথম সারিতে। অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে যাদের হৃদয় চিরজাগরুক জলিল সেই চেতনাপুরুষ। ইন্ডিয়ার হিংস্রতায় যখন সবাই ভয়ে মুখে কুলুপ এঁটে দিন গুজরান করছেন, তখন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন। দেশ মাতৃকার জন্য নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে স্বাধীনতার স্বাদ জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়াই ছিলো তার জীবন সংগ্রামের ব্রত। সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকা ও ভারতীয় আগ্রাসনমুক্ত রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যয়ে প্রতিষ্ঠিত থাকার ‘অপরাধে’ তাঁকে বঞ্চিত করা হয় সরকারি সব খেতাব ও সুযোগ-সুবিধা থেকে। তিনি ছিলেন স্বাধীন অ্যাডভেঞ্চার এবং দুঃসাহসিক লড়াকু।

জীবনযুদ্ধে বার বার নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে তিনি জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেকুলার, স্বৈরাচার, ভারতীয় জঙ্গি গোষ্ঠী- সবাই চেয়েছে তাঁর কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে। জলিল তার বজ্রশক্তি দিয়েই ভেতরের-বাইরের শত্রুশক্তির মোকাবেলা করেছেন। ভারতীয় জঙ্গি বাহিনীর ঔদ্ধত্য ও চোখ রাঙানি সম্পর্কে ‘অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা’ শীর্ষক কিতাবে পুঙ্খানুপঙ্খ আলোকপাত করেছেন। পাঠকদের বইটিকে অবশ্য পাঠ্য হিসেবে নেয়া উচিত।

ফ্যাসিবাদী ভারত চিরকাল রক্তাক্ত করেছে বাংলাদেশের মাটি, বিভাজন করেছে মাটি ও মানুষকে। আর এখানে তৈরি করেছে একদল বশংবদ পোষাপ্রাণী যারা হায়েনার চেয়েও ভয়ঙ্কর। আদর্শে তারা ধর্মনিরপেক্ষবাদী, বাম ও রামপন্থী। ওরা ভারতীয়দের থেকেও বেশি ভারত প্রেমিক। বরেণ্য সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান বলছেন, দিল্লির কুকুরের দল দিল্লির ছুঁড়ে দেয়া সেক্যুলারিজমের হাড্ডি চাটতে চাটতে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটাকেই ধ্বংসের ব্যবস্থা করছে।’ [আমাদের সময়. কম, ২৪ জুলাই ২০১৮]

মেজর জলিল ৯ নং সেক্টরের সিপাহসালার ছিলেন। দক্ষিণাঞ্চল ছিলো তাঁর যুদ্ধক্ষেত্র। যুদ্ধের শুরু থেকেই নানা বিষয়ে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদের সাথে মতবিরোধ স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। অবশ্য শুধু তাঁর সাথে নয়। প্রায় সব সেক্টর কমান্ডারদের সাথেই ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদের বিরোধ চলছিল। মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর সহযোগিতার নেপথ্য কারণ জানতে পেরে তিনি সরব হয়ে উঠেন নব্য উপনিবেশবাদী শক্তির বিরুদ্ধে। লোভ, মোহ, উচ্চাকাঙ্খা ত্যাগ করে মেহনতি মানুষের কাতারে কাঁধ মিলিয়ে দেশি-বিদেশি শত্রুর মোকাবেলা করেন।

পাকিস্তান আর্মির আত্মসমপর্ণের পর মুক্তবাংলায় ভারতীয় বাহিনী লুটপাটে অংশ নিলো। বাংলার সম্পদ পাচার শুরু করলো। এ সময় ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্র-শস্ত্র, গোলাবারুদ, কলকারখানার মেশিনারিজ ও বাংলাদেশিদের মালসামানাসহ প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুটে নিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। হিন্দুস্তানি লুটেরাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন মেজর জলিল। এই লুণ্ঠনে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে বাধা দেয়ায় তখনকার সরকার মেজর জলিলের উপর ক্ষিপ্ত হয়। মেজর জলিল ভারতীয় বাহিনীর লুণ্ঠনের প্রতিবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম. এ. জি ওসমানী এবং ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের সর্বাধিনায়ক জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নিকট পত্র লিখেন যা ১৭ ডিসেম্বর তাদেরকে পৌঁছানো হয়। ভারতীয় বাহিনীর বেপরোয়া লুটতরাজের বিরুদ্ধে ক্রমেই ক্রোধে অগ্নিরূপ ধারণ করেন মেজর জলিল। তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল দানবির সিংকে বলতে বাধ্য হন, ‘দেখামাত্র গুলির হুকুম দিয়েছি আমি, ভারতীয় সেনাবাহিনীকে লুটতরাজ করা হতে বিরত রাখুন।’ মেজর জলিল পরবর্তী কয়েকদিন জাহাজে চড়ে বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর এবং ভোলার বিভিন্ন জায়গায় জনসভা করে জনসাধারণকে ভারতীয় বাহিনীর লুটতরাজ ও দস্যুবৃত্তি সম্পর্কে সতর্ক করে দেন।

দেশে আজ স্বল্পসংখ্যক প্রবলদের হাতে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ বঞ্চিত, প্রতারিত, শোষিত ও নির্যাতিত। দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যে জনতার জান ওষ্ঠাগত। ধর্মনিরপেক্ষতা, পৌত্তলিকতা, কায়েমি স্বার্থবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীলতা ছড়ি ঘোরাচ্ছে মানুষের নাকের ডগায়। মেজর জলিলের এই জন্মোৎসবে, যারা তাঁকে ভালোবাসেন, স্মরণ করেন, শ্রদ্ধা করেন, তাদের আজ শপথ নিতে হবে- অর্ধশতাব্দী পূর্বে অপরাজনীতির বিপরীতে তিনি যে রেনেসাঁর বাণী উচ্চারণ করেছিলেন, সেই রেনেসাঁর সমাপ্তি সাধন করে অহির কিতাব আল কুরআনের ভিত্তিতে মিথ্যাচারহীন, দুর্নীতিশূন্য, জুলুমহীন ও শোষণহীন এক নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *