মু হা ম্ম দ মা সু ম বি ল্লা হ
হঠাৎ করেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মেলন ডেকে বসল বাঙালি কীটরা। রাণী মৌমাছি তার সৈন্যদের নিয়ে হাজির হলো ব্যাপক শোডাউন করে। ফুল থেকে মধু আহরণ এবং পরাগায়ণের গুরু দায়িত্ব স্থগিত রেখেই আসতে হল তাদের। রাণী বলেছেন, এটা নাকি অস্তিত্বের প্রশ্ন। তাই আসতেই হবে। লাখে লাখে সেনা মৌমাছি চলে এল নাচি নাচি। মাঠে তাদের নির্ধারিত স্থানে সারিবদ্ধভাবে বসে গেল। সুরেলা কণ্ঠ যেসব মৌমাছির, তারা গান ধরল। অধিকারের গান। অস্তিত্বের গান।
আপাদমস্তক সবুজ পোশাকে গা জড়িয়ে তিড়িংবিড়িং লাফিয়ে লাফিয়ে এল ঘাসফড়িংয়ের দল। কিছু ঘাসফড়িং অবশ্য বাদামি রঙের ফ্যাশনেবল পোশাক পরেও এসেছে। প্রত্যেকের মাথায় বেশ কিছু সার্ভাইলেন্স ক্যামেরা বসানো। আন্তর্জাতিকসহ দেশীয় সকল ধরনের যোগাযোগের জন্য মাথায় দুটি করে অ্যান্টেনা বসানো। একটু একটু পর পর অ্যান্টেনা নাড়িয়ে নাড়িয়ে সিগন্যাল গ্রহণ করছে। নেতাগোছের এক ঘাসফড়িং মঞ্চে গিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল টমাস আলভা এডিসনের প্রতি। তার কল্যাণে বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে যাওয়ায় এখন আর তাদের হারিকেনের তপ্ত কাচে পুড়ে মরতে হয় না। দুরন্ত কিশোর এখন আর মস্তক ঠেসে ধরেনা গরম কাচে। হারিকেন দুর্ঘটনায় মৃত্যুহার এখন শূন্যের কোঠায়।
জোর করে মাছেদের দলে পাঠিয়ে দেওয়ায় জ্বালাময়ী ক্ষোভ ঝাড়ল চিংড়ি সম্প্রদায়ের নেতা। আজ কীটের সম্মান নিয়ে থাকতে পারলে এভাবে বেঘোরে প্রাণ হারানো লাগত না। তিড়িংবিড়িং সাঁতার কাটত মনের আনন্দে। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। এখন তাদের পোড়া লাশ পাওয়া যায় নুডুলসে, স্যুপে ও রান্নার কড়াইয়ে। বিভিন্ন সবজির সঙ্গে তাদের চুবিয়ে মারা হয়। বিশেষ করে কচুর সঙ্গে যখন চোবানো হয়, তখন তাদের শরীর ভীষণ চুলকায়। সামান্য অ্যালাট্রল দিয়েও কেউ কীটবিকতা দেখায় না। এর প্রতিকার দাবি করে বক্তব্য শেষ করল চিংড়ি কল্যাণ সমিতির নেতা চিংড়ি কারি।
খয়েরি কালারের গাউন পরে লাখে লাখে তেলাপোকা এসে উদ্যান ঘিরে ফেলল। নোংরা, পচা, ময়লা-আবর্জনায় বসবাস বলে অনেকেই নাক ছিটকাল। কিন্তু সংখ্যায় বেশি হওয়াতে তেলাপোকাদের নেতা কিছু কথা বলার সুযোগ জোর করেই ছিনিয়ে নিল। মঞ্চে উঠে দরাজ কণ্ঠে তেলাপোকা নেতা বলল, প্রিয় কীট ভাইয়েরা আমার, আপনাদের জানাই সর্বভূকীয় শুভেচ্ছা। আমাদের রয়েছে পাঁচ কোটি বছরের স্বর্ণালী ইতিহাস। পৃথিবীব্যাপি আমাদের বিচরণ। অথচ মনুষ্যজাতি আমাদের নাম দিয়েছে তেইল্যাচোরা। ইরাক থেকে তেল চুরি করল আমেরিকা, আর তেলচোরা নাম হল আমাদের। সত্যি কী বিচিত্র দুঃখ আমাদের! আমাদের নামের শেষে আমেরিকা আছে সেজন্য বোধ হয় এই নামকরণ। পেরিপ্লানেটা অ্যামেরিকানা আমাদের বৈজ্ঞানিক নাম। সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ব্যাপার হল, চোখের সামনে পেলেই মানুষ আমাদের জুতা পিষে মারে, ঝাড়ু দিয়ে মারে। অ্যান্টেনা দুটি নাড়িয়ে, ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তেলাপোকা নেতা বলল, কিন্তু কেউ আমাদের দমিয়ে রাখতে পারেনা। কারণ পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কোনো নীতিই আমরা পাত্তা দেই না। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে আমরাই সেরা। এক তেলাপোকা পিষে মরে, লক্ষ তেলাপোকা ঘরে ঘরে। জয় হোক সর্বভুক তেলাপোকাদের।
দৃষ্টিনন্দন ও কারুকার্যখচিত বাহারি রঙের মার্জিত পোশাক পরে যেই কীট মঞ্চে প্রেমের কবিতা আবৃত্তি করল, তাকে প্রজাপতি হিসেবেই সবাই চেনে। রুপে দিওয়ানা হয়ে কেউ তাদের মারার কথা ভাবতেও পারে না। কীটজগতের ক্রাশ তারা। ফুলে ফুলে পাতায় পাতায় পই পই করে উড়ে বেড়ায়। তা দেখে সবার দৃষ্টি জুড়ায়।
ভিমরুলদের নেতা মঞ্চে এসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদল অনেকক্ষণ। তাদের নাকি মানুষ ঘরবাড়ি সুদ্ধ জ্বালিয়ে দেয়। আগুনে পুড়ে শত শত মেধাবি ভিমরুলের মৃত্যু ঘটে। যার কোনো প্রতিকার আজও হয় নি। হুল কি শুধু তারাই ফোটায়! মানুষ কি ফোটায় না মানুষের হৃদয়ে ব্যথার হুল? কই মানুষকে তো কেউ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারে না!
সকল কীটের নেতা মঞ্চে এসে যার যার দুঃখের কথা বলে গেল। কিন্তু সর্বদলীয় কীটৈক্য পরিষদ কী জন্য এই সম্মেলনের ডাক দিয়েেছে তা কেউ জানে না। সভাপতির বক্তব্যের জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছে সবাই। সে তো নিশ্চয়ই স্পষ্ট করবে। ঝিঁঝিঁ পোকাদের ঝাঁঝালো ও জোরাল স্লোগানে মুখরিত পরিবেশে, প্রজাপতির কাব্যময় বিশেষণে ভূষিত হয়ে অবশেষ মঞ্চে আসল সর্বদলীয় কীটৈক্য পরিষদের সভাপতি বিশিষ্ট শিল্পপতি রাণী মৌমাছি। রাণী পরিস্কার করল সম্মেলন ডাকার কারণ। মাইকের কাছে এসে দরাজ কণ্ঠে জ্বালাময়ী গুনগুনিয়ে বলল, আপনারা এতক্ষণ আমার ভায়েদের দুঃখ-সুঃখের কথা শুনলেন। কিন্তু এসবের চেয়েও বড় সমস্যা হল আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। একটি মহল আমাদেরকে বাংলার মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়। কত্তবড় সাহস! সংবাদ সম্মেলন করে বলে, কীটের স্বল্পতা রয়েছে। দেশে কীট নাই। করোনা পরীক্ষা বিঘ্নিত হচ্ছে।কীট নাকি আমদানি করতে হবে। তাহলে আমরা কোটি পরিবার কী ঘাস কাটব!
ঘাসফড়িংয়ের টনক নড়ল। আয় হায় কী বলে এসব। চিৎকার করে বলে উঠল, আরে কেউ রাণীমাকে একটা মেন্টোস দে না রে। আরে এই কীট তো সেই ‘কিট’ না। আমরা তো দীর্ঘ ই কারের কীট। ওটা তো হৃস্ব ই কারের কিট।
রাণী মৌমাছি ভেতরে ভেতরে লজ্জায় লাল হয়ে গেলেও ধরা দিল না। বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথেই বলল, ওই হল আর কী! বাংলা একাডেমির দীর্ঘ ই কার তুলে দিতে কতক্ষণ? তখন তো ঠিকই অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উপস্থিত লাখ লাখ কীট মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। হুদাই কোটি কোটি টাকা খরচ করে এই প্রতিবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হল। এ টাকায় অন্তত এক মাসের পাউরুটি কলার সংস্থান হয়ে যেত।