শাহানাজ পারভীন’র কাব্যগ্রন্থ চাঁদের চোখে জল

আল হাফিজ ।।
কবিরা সাধারণত আবেগ প্রবণ হয়ে থাকেন আর কবিতা হলো আবেগকে জাগ্রত করার এক অনন্য শিল্পমাধ্যম। আবেগের সঙ্গে বেগের সম্মিলন ঘটিয়ে কবিরা মানবিক সৌন্দর্যের এমন এক অলৌকিক জগৎ সৃষ্টি করেন যার স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে মানুষ। কেননা কবিতা মানুষের সরল স্বপ্নের নান্দনিক বয়ানে সতত সজাগ। আবেগঘন হৃদয়ের ভাষা দিয়ে সহজিয়া কলাকৌশলে যা প্রকাশিত হয়। এই কলাকৌশল কতোটা মাঙ্গলিক তা বিবেচনা করবেন পাঠক- সমালোচক। তবে দেশ জাতি ও সমাজকে স্বপ্ন দেখিয়ে কল্যাণের পথে এগিয়ে নেয় কবিসমাজ। মানবিক মূল্যবোধের আলোকিত কারুকাজে ভরে যায় তাদের কাব্য সংসার। কাব্যের সেই অফুরন্ত দ্যুতি সাধারণ মানুষকে উজ্জীবিত করে, উৎসাহিত করে নিরন্তর।
কবিতা আশার কথা বলে, আকাঙ্খার কথা বলে আর বলে ভালোবাসার কথাও। আশা-আকাঙ্খা আর ভালোবাসার কথা বলতে আবেগের দরকার। এই আবেগ নিয়ে ‘চাঁদের চোখে জল’ শীর্ষক কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন কবি শাহানাজ পারভীন। সহজ-সরল ভাষায় জীবনের নানামুখী আনন্দ-বেদনার গল্প-কথা উপমা-রূপকের মাধ্যমে বলার চেষ্টা করেছেন কবি। তার ভাষায় রয়েছে সহজিয়া জীবন যাপনের ছাপ। উঠে এসেছে জীবন সংগ্রামের ছায়াচিত্র। জয়-পরাজয়, প্রেম-বিরহের এক অনন্য ভাষাজগৎ। জৈবনিক চাওয়া-পাওয়ার কথা, স্বপ্ন-সম্ভাবনার কথা, প্রেম-বিরহের কথা তিনি বলার চেষ্টা করেছেন সহজ-সরল প্রত্যয়ী ভাষায়। যেমন-
কেউ জানে না কোন মিলনে
চাঁদ আর বাঁশি বাঁধা,
ভক্ত সকল মত্ত রূপ আর সুরে
কেউ দেখে না তাদের গোপন কাঁদা।
-[চাঁদের চোখে জল, পৃষ্ঠা- ০৯]
কবি শাহানাজ পারভীন ১৯৮১ সালে বরিশালের ঝালকাঠি জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সরকারি বি এম কলেজ থেকে প্রাণিবিদ্যায় অনার্স ও মাস্টার্স করে বর্তমানে শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম ‘ভালোবাসার ফুল’। এছাড়াও ‘ধূসর শ্রাবণ’ নামে তার একটি যৌথ কাব্যগ্রন্থ রয়েছে। ‘চাঁদের চোখে জল’ কাব্যগ্রন্থে তিনি যাপিত জীবনের বৈচিত্র্যপূর্ণ ছবি আঁকার চেষ্টা করেছেন। তার কবিতার কেন্দ্রে রয়েছে মা-মাটি আর মানুষ। তার কাব্যচেতনায় রয়েছে নৈতিক আকাঙ্খা, সত্য-ন্যায় এবং মানবতার জীবন্ত উপলব্ধি যা তাকে সত্য- প্রেম- পবিত্রতার সন্ধানী করে তোলে। ফলে তার কবিতায় সামাজিক সৌন্দর্য্য, দৈনন্দিন আনন্দ-বেদনা, প্রেম-বিরহ, আশা-নিরাশা ও স্বপ্ন-সম্ভাবনার কথা উঠে আসে সহজ সাবলিল আবেগময় ভাষায়। তার কবিতার স্মৃতিময় একটি অংশ তুলে ধরছি-
তিরিশ বছর পেরিয়ে গেছে
এখনো আমার ডায়েরির ভাঁজে লুকিয়ে আছে
তোমার দেওয়া শুকনো গোলাপ দল।
তোমার দেওয়া ঝরনা কলম রেখেছি অবিকল।
-[ অন্তযাত্রা, পৃষ্ঠা- ১২ ]
কবির এই পঙক্তি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের মনের পর্দায় ভেসে ওঠে তার নিজের হারানো প্রেমের স্মৃতি। মূলত স্মৃতি জাগানিয়া আবেগমথিত ভাষায় ফেলে আসা জীবনের গল্প বলেছেন কবি শাহানাজ। জীবনমুখী চিন্তা-চেতনার সরল বয়ান রয়েছে এই কাব্যগ্রন্থের পাতায় পাতায়। ‘বীরের বউ’ শিরোনামের কবিতায় উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সম্ভার- যেখানে আমরা দেখি যুবতী স্ত্রী বাসন্তীকে ফেলে রেখে মুক্তিযুদ্ধে চলে যায় স্বামী। এ রকম আবেগঘন অনেক বিষয়ে কবি উচ্চারণ করেছেন সাবলিল পঙক্তিমালায়। তার কবিতার ভাষা যেমন সহজ সরল তেমনি তিনি ব্যবহার করেন সহজ উপমা-রূপক। তার কয়েকটি উপমা নিচে দেওয়া হলো-
ক. কোনো কোনো নদী আছে থেমে থাকে আনমনা বালিকার মতো
কোনো কোনো নদী আছে তীর ক্ষয়ে ধায় অবিরত।
– [ অভিমান, পৃষ্ঠা-২২ ]
খ. অশ্রুবালা, অশ্রু লুকিয়ে কঠিন ভাস্কর্যের মতো
অবিচল থাকাতেই তো জীবনের স্বার্থকতা।
– [ অশ্রুবালা, পৃষ্ঠা- ৫৯ ]
গ. আমিতো নিজেকে জ্বালিয়েছি অগ্নিগিরি স্বেচ্ছায় যেমন জ্বলে
আমি আনমনা চলেছি ঠিক ঢেউয়ের আঘাতে পাথর যেমন চলে…
– [জলাঞ্জলি, পৃষ্ঠা- ৪২ ]
কবি শাহানাজ পারভীন তার কাব্য ভাবনায় তুলে এনেছেন বিশ্বমানবতার মৌলিক বিষয়-আশয়। মানুষের সুখ-দু:খ, আনন্দ-বেদনা, আশা- হতাশা, প্রেম-বিরহ সবই তার কবিতায় বর্ণিত হয়েছে নান্দনিক আন্তরিকতায়। সামাজিক অরাজকতা, রাজনৈতিক বাস্তবতা, অর্থনৈতিক নিপীড়ন কোনো কিছুই বাদ যায় নি তার কাব্যচিন্তা থেকে। এখানে যেমন ব্যক্তিগত পাওয়া- নাপাওয়ার চিত্র ফুটে উঠেছে তেমনি উঠে এসেছে বিশ্বমানবিকতার বঞ্চনার চিত্রও। নানান দেশের নানান মানুষের দু:খ-কষ্ট দেখে ব্যথিত হয়ে ওঠে কবির হৃদয়। মানুষের প্রতি মানুষের এই ভয়াবহ আচরণ দেখে কবির মন হৃদয় ভেঙেচুরে মাটি হয়ে যায়। তখন প্রতিবাদি হয়ে তার কলম থেকে বেরিয়ে আসে শব্দের তীব্র বারুদ। তার কবিতা থেকে কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরছি-
ক. মানুষ হয়ে মানুষ মারার খেলায় গিয়েছো মজে
তোদের দেখে রাক্ষসেরা হাসিতেছে মুখ গুজে।
– [ প্রতিবাদের অগ্নিগিরি, পৃষ্ঠা- ২৪ ]
খ. এখনো অনেক তরতাজা জীবন রাস্তায় যায় পিষে
না ফোটা কলির স্বপ্নগুলো ধুলার সাথে মিশে…
– এখনো অনেক আঁধার, পৃষ্ঠা- ৬৪ ]
কবি শাহানাজ পারভীন অত্যন্ত দরদ দিয়ে মানুষের দু:খ-দুর্দশার কথা বলেছেন, অরাজকতার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠে প্রতিবাদ করেছেন। আন্তরিকতার সঙ্গে জীবনের জয়গান গেয়েছেন, মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়েছেন। তার কাব্যভাষা, উপস্থাপনা কৌশল, শব্দপ্রয়োগের সরলতা পাঠকহৃদয় ছুঁয়ে যায়। তার কবিতায় কোনো দুর্বোধ্যতা নেই, নেই কোনো জড়তা, যা বলার তা তিনি সোজাসুজি বলার চেষ্টা করেছেন। মূলত এখানেই তার কবিতার স্বার্থকতা- নান্দনিকতার গূঢ় রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। তার কাব্য স্টাইল সহজিয়া রূপে-রসে-গন্ধ-মাধুর্যে ভরপুর। উপমা- রূপকের ব্যবহারে নেই কোনো বাহুল্য, নেই কোনো শৈথিল্য। তার কবিতা থেকে কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরছি-
ক. টলতে টলতে বেঁচে আছি
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আমার পথ চলার চেষ্টা
আর তুমি
বহাল তবিয়তে হয়তো পুরুষত্বের দম্ভ নিয়ে
পা ফেলছো অভিরাম।
– [ শেষ চিঠি, পৃষ্ঠা- ১৮ ]
খ. ডানা ভাঙা পাখিটাই জানে
ডানা তার কতো দরকারী
হেরে যাওয়া সৈন্য শুধু জানে
কতোটা প্রয়োজন তরবারী।
– [ উপলব্ধি, পৃষ্ঠা- ৩২ ]
গ. সুর তোলা সেই তারের বীণা
সুর চেনে না নিজে,
যে ধূপ গন্ধ বিলায়
সেই ধূপ জানে না
তার বুকেতে লুকিয়ে আছে কিযে।
– [ অপূর্ণতা, পৃষ্ঠা- ৩৪ ]
কবি শাহানাজ পারভীন এমনই বোধগম্য ভাষায় তার কবিতা উপস্থাপন করেছেন ‘চাঁদের চোখে জল’ কাব্যগ্রন্থে। আশা করি কবি শাহানাজ রচিত এ কাব্যগ্রন্থটি বোদ্ধা পাঠক-সমালোচকদের কাছে ভালো লাগবে। আমরা কবির সাফল্য কামনা করি। তার কাব্যজীবন সুষমামণ্ডিত হোক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *