আযাদ আলাউদ্দীন
দেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ‘সারেগামা একাডেমি’র ইউটিউব চ্যানেলে একটি গান দেখেছিলাম সেদিন। ওই গানটি লিখেছেন বিশিষ্ট গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী মাসুদ রানা। গানটিতে শিশুদের উপর বর্তমানে যে মানসিক ও শারীরিক চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে তার বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে। ইচ্ছে করলে আপনারাও দেখতে পারেন ‘১০ কেজি ওজন’ শিরোনামের ওই গানটি। গানটি দেখে আমার মনের ভাবনার জগতে যে- আলোড়ন তুলেছে তার আলোকেই আজকের এই লেখা।
একটি শিশুর মানসিক বিকাশ ও বেড়ে ওঠায় অভিভাবক তথা বাবা-মায়ের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক মা-বাবা-ই চান তার সন্তান সুস্থ্য, সুন্দর ও ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠুক। কিন্তু শুধু চাইলেই কি তা বাস্তবায়ন হবে? নিশ্চয়ই নয়। এজন্য প্রয়োজন অভিভাকদের সচেতনতা। বর্তমান সমাজে দেখা যায়, শিশুদের অসম প্রতিযোগিতার মুখোমুখি দাড় করিয়ে দেয়া হয়। এই অবস্থার বাস্তব চিত্র আমরা দেখি সরকারি স্কুলগুলোতে শিশুদের ভর্তি নিয়ে অভিভাবকদের- বিশেষ করে মায়েদের অতিমাত্রায় উৎকন্ঠা নিয়ে। তারা সন্তাকে সরকারি স্কুলে ভর্তি করাতে এতটাই বেপরোয়া হয়ে যান যে, সরকারি হাই স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করাতে না পারলে যেন- মানসম্মান সব গেল! অথচ সরকারি স্কুলে না পড়েও অনেক সন্তান এখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত।
শিশুদের জন্য যা করণীয়
# সন্তানের কাজের প্রশংসা করতে হবে, তার কাজের সমালোচনা না করে কীভাবে করলে কাজটা সুন্দর হবে তা নিয়ে সন্তানের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।
# সন্তানের প্রতিটি মতামত গুরুত্বসহকারে শুনতে হবে। সন্তানের সঙ্গে তার ভালো লাগা, খারাপ লাগা বিষয়গুলো নিয়ে কথা বললে তার ভেতরে চিন্তা করার দক্ষতা তৈরি হবে।
# সন্তান যে জিনিসগুলো ব্যবহার করে, সেটা তার পছন্দ অনুযায়ীই যদি কেনা সম্ভব হয়, তবে সন্তানের মতামত প্রদানের অভ্যাস গঠন হবে। তার বিছানায় চাদর, পড়ার টেবিল, কোন পোশাক পরবে, সেসবের ব্যাপারে তার পছন্দকে গুরুত্ব দিতে হবে।
# আমরা অনেকেই শিশুকে মেঝেতে নামতে দিই না। খেলনা দিয়ে খেলতে দেই না। আমাদের ভয় থাকে সন্তান পড়ে যেতে পারে বা আঘাত পেতে পারে। কিন্তু শিশুদের স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য তারা হাঁটবে, খেলবে এ জন্য সন্তানকে নিয়ে মা-বাবার ভয় পেলে চলবে না। তাকে তার মতো থাকতে দিতে হবে।
# অনেক সময় মা-বাবা সন্তানের সব কাজ করে দেন। এমনকি বড় হওয়ার পরেও খাবার খাইয়ে দেন, এটা করা ঠিক নয়। এতে করে সন্তান দায়িত্ব নিতে শেখে না। দায়িত্ব নিতে ভয় পায়। বাচ্চাকে আমাদের ছোট ছোট দায়িত্ব দিতে হবে। যেমন হতে পরে সন্তান খাওয়ার পরে তার প্লেটটা সে নিজেই পরিষ্কার করবে। পরিষ্কার করে যথাযথ স্থানে রাখা। স্কুল থেকে বাসায় আসার পরে স্কুল ড্রেস, জুতা–মোজা নিজেই খুলে রাখবে। ঘুমানো সময় তার নিজের বিছনা নিয়েই পরিষ্কার করে নিতে হবে। তবে কোনো শিশুরা যদি এগুলো না করে, তাহলে তাকে বকা দেওয়া যাবে না। সন্তানকে বুঝিয়ে বলতে হবে যে নিজের কাজ নিজেই করা উচিত।
# শিশুরা যদি ইচ্ছে করে কিছু করতে চায়, সেটা আমরা তাদের জন্য ক্ষতিকর না হলে নিষেধ করব না। আমরা তাদেরকে সাহস দেব। তার কাজে সহযোগিতা করব এবং তাকে উৎসাহ দেব।
# অনেক সময় শিশুরা নিজের দামি একটা খেলনা ভেঙে ফেললে আমরা তাকে বকা দিই। বাচ্চারা কোনো কিছু ভেঙে বা নষ্ট করে ফেললে তারই কিন্তু সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়। ওকে তখন আমরা বলব যে তোমার খেলনাটা ভেঙে গেছে, তাই তোমার অনেক মন খারাপ হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আমরা সতর্ক থাকব যেন খেলার সময় খেলনাটা না ভেঙে যায়।
# সন্তানের সঙ্গে কোনো প্রতিশ্রুতি দিলে সেটা পালন করা উচিত। একই সঙ্গে সন্তানকে ভালো কিছু করার জন্য পুরস্কার দিতে হবে। ধরুন, আপনার সন্তানকে সপ্তাহের শুরুতে বললেন যে তুমি যদি নিয়মিত স্কুলে যাও, তাহলে শুক্রবার তোমাকে ঘুরতে নিয়ে যাব। সে যদি ঠিকভাবে স্কুলে যায়, তাহলে অবশ্যই তাকে শুক্রবার ঘুরতে নিয়ে যাওয়া উচিত। এতে সন্তানও শিখবে কথা দিয়ে কথা রাখতে হয়।
# খেলাধুলা ও সুস্থ্য ধারার সংস্কৃতির প্রতি উৎসাহিত করতে হবে। লেখাপড়ার পাশাপাশি এক্সট্রা কারিকুলামে আগ্রহী করতে হবে। উৎসাহ দিতে হবে। যেমন- গান ও কবিতা আবৃত্তি শেখানো।
# শিশুকে পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে।
# ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা প্রদান করা। যেমন- সত্য কথা বলতে শেখানো, মন্দ কথা বলা ঠিক নয়, ভালো কাজ করলে পূর্ণ হয়, মন্দ কাজ করলে পাপ হয় ইত্যাদি।
# সর্বোপরি সন্তানকে শেখাতে হবে যে- ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা বিসিএস ক্যাডার হওয়াই জীবনের আসল সফলতা নয়, আসল সফলতা হলো- ‘ভালো মানুষ হওয়া’। ##
তথ্যসূত্র: ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘পুষ্পকলির কথা’ (প্রথম সংখ্যা), প্রকাশক ও সম্পাদক: শামীমা সুলতানা
লেখক
আযাদ আলাউদ্দীন প্রকাশক ও সম্পাদক মুক্তবুলি
০১৭১২১৮৯৩৩৮