শেরে বাঙ্লার মাজারে

ফররুখ আহমদ ।।

এক

উন-নব্বই গ্রীষ্মের প্রদাহে

তাপ-দগ্ধ যার জীবন,

সেই বিরাট পুরুষ

ঘুমিয়ে পড়েছে এখানে!

এখানে এই শ্যামল মাটির নিচে

সে নিয়েছে তার দিনান্তের শেষ শয্যা।

 

চৈত্রের আগুন-ঝরানো আকাশের নিচে,

বৈশাখের প্রচণ্ড ঝড়ে,

শ্রাবণেল অঝোর বর্ষণে

সে ছিল মাটি আর মাঠের মানুষের

সবচেয়ে আপনজন,

শ্রমিক ছাত্র আর দুর্গত জাতির

সবচেয়ে দরদিজন!

আজ আর কেউ তোমরা তার সাড়া পাবে না,

সাড়া পাবে না তোমরা সেই বিরাট পুরুষের

সারা জীবন যে সংগ্রাম করেছে

অন্যায়ের বিরুদ্ধে,

আর অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে

নিজে হয়েছে ক্ষত-বিক্ষত

(কো’কাফের রক্তলোলুপ দৈত্যের সামনে

রূপকথার নায়কের মত সে ছিল দূর্জয়; দুঃসাহসী)।

যত চেষ্টাই করি না কেন

ভুলতে পারি না শেরোয়ানি, তুর্কি টুপি-পরা

সেই বিরাট পুরুষকে!

দুর্বল, ক্লীব, অনুকারী মানুষের মাঝখানে

সে ছিল পাহাড়েরর মত দৃঢ়

পাহাড়ের উন্নত শীর্ষ …

যুগান্তের কোন ঘূর্ণি তুফান

নোয়াতে পারেনি তার উন্নত শিরদাঁড়া

কোন দিন আত্মবিক্রয়ের প্রান্তরে!

 

একমাত্র আল্লার কাছে ছাড়া

নত হয়নি যে কারু কাছে

সে ছিল সমস্ত জাতির জাত্যাভিমান

আর সহৃদয়তার প্রতীক …

জীবনের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে

নিঃস্ব হয়েছিল সে নিজে

সমস্ত ফসল বিলিয়ে দিয়ে

নিঃস্ব হয়েছিল সে নিজে

সমস্ত ফসল বিলিয়ে দিয়ে

শস্যরিক্ত মাঠ যেমন নিঃস্ব … উদার …

 

শতাব্দীর স্রোত চেয়েছিল

তাকে নিঃশেষ ঝড় নিশ্চিহ্ন করে দিতে,

পাহাড়তলীর যেমন উড়িয়ে নিয়ে যায়

ঝরা পাতার চিহ্ন,

কর্ণফুলীর বন্যা যেমন ভাসিয়ে নিয়ে যায়

খড়কুটোর অস্তিত্ব

বিস্মৃতির নিতল সমুদ্রে …

 

কিন্তু পারলো না সে …

মৃত্যু  এসে থমকে দাঁড়ালো

তার জানাজায় শরিক

শোক-দীর্ণ লক্ষ লক্ষ মানুষের মুখ দেখে;

আর নিজের হাতে তাকে পরিয়ে দিল

অমরত্বের অদৃশ্য শাহী তাজ।।

 

দুই

বিরাট ব্যক্তিত্বের যুগ শেষ হ’ল

শেষ হ’ল যুগ বহুমুখি প্রতিভার;

এখন দেখি চার পাশে

ক্ষুদ্র আর ইতর সত্তার আনাগোনা! …

বাঘের পরিত্যক্ত অরণ্যে

ঘুরে বেড়াচ্ছে সংখ্যাহীন শৃগাল

ধূর্তামির সকল অপকৌশল নিয়ে;

কিন্তু পূর্ণ হচ্ছে না কিছুতেই

বিরাট ব্যক্তিত্বের শূন্যাসন।

 

আদর্শবাদী পুরুষের

বহুমুখি প্রতিভার সেই বিরল দীপ্তি

(সূর্যের আলোয় ঝলসে-ওঠা

মুজাহিদের নাঙ্গা তলোয়ারের মত

ধাঁধিয়ে দিত যা দুশমন ফৌজের দৃষ্টি,

আর আশ্বাস দিত মজলুম জনতাকে,

পথভ্রান্ত রাহী মুসাফিরকে

অন্ধকারে বিচ্ছুরিত বিদ্যুৎফলার মত

জীবনের সংকট- সঙ্কুল সড়কে);

আজ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না কোনখানে।

দিগন্ত-বিস্তুত সেই প্রসারিত হৃদয়

যা টেনে নিত সকল দুর্গত মানুষকে

নিজের বিশাল বক্ষে,

আশ্রয় দিত তরঙ্গ-বিধ্বস্ত সকল আশ্রয়প্রার্থীকে

পদ্মার প্রশস্ত বালুচরের মত

প্রশান্ত; উদার

কেউ আর খুঁজে পাবে না সে হৃদয়

এই স্বার্থপর সংকীর্ণ মানুষের দঙ্গলে!

 

সেই নিরলস, নিঃস্বার্থ, মহৎপ্রাণ কর্মী

(যে গড়ে তুলেছিল জাতির দৃঢ় বুনিয়াদ

যুগযুগান্তের কঠোর প্রয়াসে,

জ্বেলেছিল অজ্ঞতার অন্ধকার শামাদানে

নিযুত আলোক-বর্তিকা

সঞ্চার করেছিল কালবৈশাখীর দুর্বার গতিবেগ

প্রাণহীন মৃত জনপদে)

উত্থানে-পতনে, সাফল্যে-ব্যর্থতায়, অভিমানে -আত্মত্যাগে

মহাকাব্যের নায়কের মতই যার মহত্ত্ব;

সেই মহ্যপ্রাণ কর্মীকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না এখানে!

এখন আর ভাবতেও পারি না আমরা

কিভাবে এক নিঃসঙ্গ পুরুষ

এগিয়ে যেতে পারে একটা জাতিকে বুকে তুলে নিয়ে

মৃত্যু-মুখর, হিংস্র, প্রতিকূল পরিবেশে …

দুঃখ, দৈন্য, হতাশা আর অধঃপতনের

সর্বনিম্ন স্তর থেকে

উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারে কিভাবে একটা জাতিকে

রূপকথার রক পাখির মত

মুক্তির সবচেয়ে উঁচু শিখরে …

 

কিন্তু এ তো রূপকথা নয়,

এ- তো বাস্তব সত্য …

সূত্র:
ফররুখ আহমদ রচনাবলি দ্বিতীয় খণ্ড, বাংলা একাডেমি, ঢাকা ১০০০,

প্রথম প্রকাশ জুন ১৯৯৬, পৃ ৮৯-৯২

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *