টি.এম. জালাল উদ্দীন
‘শের-ই-বাংলা’ শুধু একটি খেতাবই নয়। এটি একটি আদর্শ। এটি শুধু বরিশালেরই নয় – সমগ্র বাংলার। শুধু বাংলারই-বা কেন বলি – বিশ্বের সকল আদর্শবান ব্যক্তির। কেননা, তিনি ছিলেন জাতি-ধর্ম, স্থান-কাল নির্বিশেষে সকলেরই প্রাণের মানুষ। তার চিন্তা ধ্যান-ধারণা ছিল সকলের জন্যই সমান। তাই তার এ আদর্শকে লালন করার দায়িত্ব সকল আদর্শবান ব্যক্তির। কিন্তু তার সে আদর্শ আজ উপেক্ষিত।
আমি অতিশয় ক্ষুদ্র ও নগন্য ব্যক্তি। তবুও আমি এ আত্মত্যাগী মহাপুরুষের স্মৃতি চারণ ও আদর্শ রক্ষার উদ্দেশ্যে সকলের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। তার নামে বরিশালের মাটিতে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করার জন্য সকলকে অনুরোধ করছি। কিন্তু অনেকটা পথ অতিক্রম করে আমি আজ হতবাক! দেখছি এ পথটি খুবই বন্ধুর। আমি অনেক প্রশ্নের সম্মূখীন হচ্ছি। কেউ বলেন – শের-ই-বাংলার বংশের কারো মাথা ব্যথা নেই, আপনি কেন এতটা করতে যাচ্ছেন? কেউ বলেন – কী করেছেন শের-ই-বাংলা এ বরিশালের জন্যে? কী করেছেন তার বংশের জন্যে? তার আদর্শ ‘পেটে লাথি মারা’র আদর্শ। তিনি ইচ্ছা করলে তার বংশধরদের সোনার সিংহাসনে বসিয়ে যেতে পারতেন। ইচ্ছা করলে বরিশালকে তিনি স্বর্গপুরীরূপে গড়ে যেতে পারতেন। আরও যে কত শত আভিযোগ–! এ সব শুনেও আমি পিছপা’ হতে পারছি না। আমি তার রক্তের কেউ নই সত্য। কিন্তু আমি যে এ রত্নগর্ভা বরিশালেরই সন্তান। তিনি নিজের জন্য কিছু না করে সমাজের জন্য এক ব্যতিক্রমধর্মী আদর্শের জন্ম দিয়ে গেছেন- এটিই তো দুষ্প্রাপ্য ও অতুলনীয় আদর্শ – আমাদের অহংকার। অতএব এর পরিচর্যা করা সকল আদর্শবান ব্যক্তিরই দায়িত্ব ও কর্তব্য।
তাই আমি আমাদের শিক্ষিত সমাজের প্রতি বিনয়ের সাথে আবেদন রাখছি – আসুন আমরা দেশের বরেণ্য মহাপুরুষদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। এ সাধনা আমাদের আত্মাকে কিছুটা হলেও বিশুদ্ধ করবে। আত্মা বিশুদ্ধ হলে কর্ম, কর্ম বিশুদ্ধ হলে পরিবেশ বিশুদ্ধ হবে। একমাত্র আদর্শ পরিবেশই পারে একটি আদর্শ সমাজ উপহার দিতে পারে।
এ প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে আমি শিক্ষিত সমাজের যথেষ্ট সারা পেয়েছি। তাদের অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে ভীষণভাবে উৎফুল্ল করেছে। কিন্তু হায়! আমি উৎফুল্ল চিত্তে অধীর আগ্রহ নিয়ে যখন তাদের দিকে হাতটি বাড়াই, তখন অনেকেই কৌশলে হাতটি সরিয়ে নেন।
তখন নিরাশ মনে আমার কানে বেজে ওঠে বঙ্গবন্ধুর সেই বাণীটি ‘আমি প্রধান মন্ত্রিত্ব চাই না; আমি মানুষের অধিকার চাই।’ আমারও বলতে ইচ্ছে করে ‘আমি এত শত ধন্যবাদ চাই না; আমি এর বাস্তবায়ন চাই। আবার এক কবির কবিতা মনে পড়ে গেল ‘কে লইবে মোর কার্য, কহে সন্ধ্যা রবি; শুনিয়া জগৎ রহে, নিরুত্তর ছবি। মাটির প্রদ্বীপ কহিল, ‘হে স্বামী, আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি। এবার শুনছি ঐ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্ঠস্বর ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে—–।’
কবিদের সব আত্মা আমার পিছে লেগেছে। তাই আমি পিছপা’ না হয়ে মাটির প্রদীপ হয়ে সামনের দিকেই চলছি। ‘তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই।’ তার আদর্শই আমার সোনার হরিণ। হে শের-ই-বাংলা, আমি তোমাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। তোমার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।
‘জীবন মরণে, তোমারই স্মরণে-
গাইছি সাম্যের গান।
তব আদর্শের লাগি, অকাতরে মোরা
‘জীবন করব দান।’
‘বাংলাকে যিনি বাসেন ভাল
‘অন্তরে তার তুমি।
তোমার নামে ধন্য এ দেশ
ধন্য বঙ্গভূমি।’
‘কে বলে তোমায় বিত্তহীন,
কে বলে তুমি নিঃশ্ব?
তোমার গুণগান গাইছি মোরা,
গাইছে সারা বিশ্ব।’