সংস্কৃতি আন্দোলনের অগ্রনায়ক ড. আসকার ইবনে শাইখ

মাহমুদ ইউসুফ


(জন্ম ৩০ মার্চ ১৯২৫, ইন্তেকাল ১৮ মে ২০০৯)

বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ড. আসকার ইবনে শাইখ বাংলাদেশের সংস্কৃতি জগতের মহীরুহ। পূর্ব বাংলা তথা আজকের বাংলাদেশের নাটক ও নাট্য আন্দোলনের জনক আসকার ইবনে শাইখ ছিলেন একাধারে ভাষা সৈনিক, সংগঠক, শিক্ষাবিদ, গবেষক, প্রবন্ধকার এবং অনুবাদক। নাটকের প্রয়োজনে তিনি অনেক গানও রচনা করেছেন। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক। তাঁর প্রকৃত নাম এম. ওবায়দুল্লাহ, আর সাহিত্যিক নাম আসকার ইবনে শাইখ। তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রতই ছিলো বাংলার মুসলমানদের সাংস্কৃতিক উন্নয়নে কাজ করা। ইসলামী তাহজীব-তামাদ্দুনের পুনর্জাগরণ ও সংরক্ষণেই তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময় অতিবাহিত হয়। ইসলামের রূপ-সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত হয়েছে তাঁর সাহিত্যকর্মে। ইসলামের সোনালী অতীত পুনরুদ্ধার এবং বাঙালি মুসলমানদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তা বিনির্মাণে তাঁর নাট্যকর্ম উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।

বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগতে প্রথম স্বার্থক মুসলিম নাট্যকার ড. আসকার ইবনে শাইখ। অর্ধশতাব্দিকাল ধরে তিনি নাটকের সকল শাখায় বিচরণ করেছেন। নাট্যগুরু, নাট্যকর্ম, নাট্যব্যক্তিত্ব আসকার ইবনে শাইখ নাটক রচনার পাশাপাশি অভিনয়-নির্দেশনাও সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন মঞ্চ-রেডিও-টেলিভিশনের একজন খ্যাতিমান অভিনেতা-নির্দেশক। জীবিতকালে তিনি রেডিও-টেলিভিশনের জন্য নিয়মিত নাটক লিখতেন। এই জনপদের পূর্ণাঙ্গ জীবনচিত্র নিয়ে তাঁর পূর্বে কোনো নাট্যকার নাটক লিখতে এগিয়ে আসেননি। মুসলিম সমাজ জীবন বরাবরই উপেক্ষিত থেকে যায়। তোফা হোসেন লিখেছেন, ‘এদেশের মানুষের মন ও মানস, তাদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও চেতনা, তাদের জীবন-সংগ্রাম ও আশা-বাসনার প্রতিফলন তাঁর নাট্যকৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। তিনি অনলস নাট্যকর্মী। বাংলা নাটকের উন্নয়নে তাঁর অবদান অসামান্য। চারদিকে আজ নাট্য প্রয়াসের যে শুভ কর্মচাঞ্চল্য বিদ্যমান, তার সূচনাকারীদের প্রধান পুরুষ শাইখ। পঞ্চাশ দশকের আরম্ভ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও বাইরে এবং ৭০ সাল থেকে ৮০ সাল সাল পর্যন্ত স্বগৃহে ‘নাট্য একাডেমী’ স্থাপন করে তিনি বহু উৎসাহীকে হাতে-কলমে নাট্য বিষয়ে শিক্ষা দিয়েছেন।’ ১

পরাধীন আমলে ব্রিটিশ ও প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের ইসলাম বিদ্বেষের কারণে মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ছিলো খুবই শোচনীয়। প্রান্তিক জনগোষ্ঠির কাতারে ছিলো সামগ্রিক মুসলিম সম্প্রদায়। আসকারের ভাষায়, ‘নতুন দিনে গড়ে ওঠা নগরে-বন্দরে, অফিস-আদালতে নব্য শিক্ষিত হিন্দু ভাগ্যবানেরা, আর বনে-জঙ্গলে, মাঠে-ময়দানে বেশির ভাগ মুসলিম ভাগ্যহতরা।’ ২ সেই দুর্যোগের দিনে মুসলমানরা শির উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি। তারপরও বেশ কয়েকজন মুসলিম সাহিত্যিক নাটক রচনায় এগিয়ে আসেন। তাঁদের মধ্যে মীর মশাররফ হোসেন, শাহাদাৎ হোসেন, প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ, আবুল ফজল, আকবর উদ্দীন, বন্দে আলী মিয়া, মোহাম্মদ আবদুর রহমান, মোঃ ইসহাক রেজা চৌধুরী, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ। সাতচল্লিশের পট পরিবর্তনের পর বাংলা নাট্যমঞ্চে ধূমকেতুর মতো আগমন ঘটে আসকার ইবনে শাইখের। তাঁর আবির্ভাবের পূর্বে বাংলা নাটকে একচেটিয়া আধিপত্য ছিলো হিন্দুদের। আসকার সেই আধিপত্যকে ধূলোয় মিশিয়ে বাংলা নাটকে মুসলমানের রাজত্ব কায়েম করেন। বিশিষ্ট টিভি ও নাট্য অভিনেতা মরহুম ওবায়দুল হক সরকার লিখেছেন, ‘এতকাল নাট্যমঞ্চ ছিলো হিন্দুদের দখলে। মঞ্চে প্রবেশ করতে হলে হিন্দু সেজে প্রবেশ করতে হতো। আসকার ইবনে শাইখই প্রথম সুযোগ করে দিলেন মুসলমান হয়ে নাট্যমঞ্চে প্রবেশ করার। বিশ্বাস করুন বা নাই করুন, দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠির কোনো ঠাঁই ছিলো না সেদিনের দেশিয় নাটকে- মুসলমান ছিলো অপাঙক্তেয়। আসকার ইবনে শাইখ, নূরুল মোমেন প্রমুখ প্রথম মুসলমান চরিত্রকে বরণ করে নিলেন মঞ্চে।’ ৩

১৯৪৭ সালে ‘বিরোধ’ নাটক প্রকাশের মধ্য দিয়ে শাইখের নাট্যজীবনের আরম্ভ। ওই সময়ে ‘বিরোধ’ রচনা, প্রকাশনা ও মঞ্চায়ন বাঙালি মুসলমানদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে অবশ্যই ছিলো এক অপূর্ব ঘটনা। ১৯৪৯ সালে ফজলুল হক মুসলিম হলে বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নাট্যাভিনয়ের ব্যবস্থা করা হয়। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ উক্ত অনুষ্ঠানে মঞ্চায়নের জন্য ‘বিরোধ’ নাটক নির্বাচন করেন। যথাসময়ে ‘বিরোধ’ মঞ্চস্থ হয়। এ বিষয়ে আসকার ইবনে শাইখ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন,

‘বিরোধ মঞ্চায়ন প্রসঙ্গে কিছু স্মৃতি আজও আমাকে নাড়া দিয়ে যায়। এর পরিচালনার ভার ন্যাস্ত হয়েছিলো পরলোকগত দুই শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক সর্বজনাব মুহম্মদ আবদুল হাই (বাংলা বিভাগ) ও জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতার (ইংরেজি বিভাগ) উপর। শেষ পর্যন্ত অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুল হাই সাহেব একাই অক্লান্ত পরিশ্রম করে নাটকটি মঞ্চস্থ করেন। কার্জন হলে স্টেজ বেঁধে মঞ্চস্থ হচ্ছে ‘বিরোধ’। নাট্যারম্ভে হলের প্রভোস্ট ডক্টর আবদুল হালিম মঞ্চে এসে হাতজোড় করে (আক্ষরিক অর্থেই) দর্শকবৃন্দের কাছে অনুরোধ জানালেন: এই প্রথম মুসলমান সমাজের উপর একজন মুসলমান নাট্যকারের পূর্ণাঙ্গ নাটক মঞ্চস্থ হতে যাচ্ছে। তাতে দর্শকদের চোখ-কানের অভ্যাসে হয়তো বিসদৃশ নাড়া লাগবে। তারা যেন ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি নিয়ে নাট্যাভিনয়ের পুরোটাই দেখে যান। অর্থাৎ বিরক্ত হয়ে চলে না যান।’ ৪

ড. আসকার ইবনে শাইখ নিজস্ব মেধা, মনন ও সৃজনশীলতা নিয়োগের মধ্য দিয়ে মুসলিম বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যবাহী ধারাটিকে করেছেন সমৃদ্ধ ও বেগবান। তাঁর দ্বিতীয় নাটক ‘পদক্ষেপ’ রচিত হয় ১৯৪৭ সালে এবং প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে। সামাজিক দোষত্র“টি, উদ্ধত বংশগৌরব, সমাজের অন্যায়, শাসন ও শোষন এ নাটকের বিষয়বস্তু। সমাজের কুসংস্কার দূর করে প্রেম, ভালোবাসা ও ন্যায়ের সমাজ স্থাপন করবার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় এ নাটকে। ৫ পদ্মার পাড়ের জনপদের সংগ্রামী জীবন নিয়ে তিনি রচনা করেন বিদ্রোহী পদ্মা। এটি ১৯৫২ সালে রচিত ও ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয়। ২০০৬ সালে এটি চলচ্চিত্রে রূপদান করেন প্রখ্যাত পরিচালক বাদল খন্দকার। হিন্দু জেলেদের সমাজজীবন নিয়ে তিনি ১৯৫৩ সালে রচনা করেন বিল বাওড়ের ঢেউ। ১৯৫৫ সালে এটি প্রকাশিত হয়।

মেঘলা রাতের তারা ড. আসকার ইবনে শাইখের একটি অসাধারণ নাট্যকর্ম। ১৯৮১ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত হয়। এটি মূলত: দেশাত্মবোধক টেলিনাট্য সিরিজ। পলাশীর আম্রকাননে পরাধীনতার বীজ বপন, ইংরেজ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন, স্বদেশপ্রেম, ব্রিটিশ ফিরিঙিদের অত্যাচার, শোষন, নির্যাতন আলোচ্য নাটকগুলোর বিষয়বস্তু। ড. শাইখ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘আমাদের ঐতিহ্য আছে, গৌরবদীপ্ত পরিচয় আছে। আমাদের অতীত স্বদেশপ্রেমের অতীত, একদিন যারা ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিলেন, তাদের নিয়ে আমাদের স্মরণীয় অতীত নয়; ঐতিহ্য তো নয়ই। আমাদের ঐতিহ্য দৌলত আলী, মজনু শাহ্, রানী ভবানী, নূরুদ্দীন, মুসা শাহ, ভবানী পাঠক, দয়ারাম শীল, দুনিরাম পাল, সোবাহান শাহ্, তিতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহ, দুদু মিয়া এবং এমনি আরও অনেকে। আমাদের অতীত ফকির সন্নাসীরা, বিদেশী শাসন ও শোষনের বিরুদ্ধে উচ্চকিত ও সক্রিয় ছিল যাঁদের প্রতিরোধ সংগ্রাম। দুর্যোগভরা মেঘলা রাতে এঁরাই জ্বালিয়ে রেখেছিলেন স্বদেশপ্রেমের অম্লান শিখা। ভোগ করেছেন তাঁরা লাঞ্ছনা আর অত্যাচর, ত্যাগ করেছেন জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। তাঁদের নিয়ে ঘটেছে অনেক কিছু ঘটনা। সেই সব ঘটনাকে সেই সব মানুষকে আমাদের চিনতে হবে, জানতে হবে নিজেদেরই প্রয়োজনে। মুলত জাতীয় পরিচয়কে চিহ্নিত করার জন্যই আমার এ প্রয়াস।’ ৬

আলোচ্য গ্রন্থটি ১১টি টিভি নাটকের সঙ্কলন। নাটকগুলো হলো পলাশীর পথে, পলাশী, পলাশীর কান্না, অন্ধ রাতের ডাক, মন্বন্তর, বিদ্রোহ, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, রেনেসাঁ, বাঁশের কেল্লা, ঝড়ের ডাক এবং ঝড়ের রাতে। পলাশীর পথে নাটকে ইংরেজ বণিকদের দিল্লীর শাহী দরবার থেকে সুবে বাঙ্গালায় বাণিজ্য করার ফরমান লাভ, নবাব মুর্শিদকুলী খানের দক্ষ শাসনকার্য, হিন্দু জমিদারদের উৎপত্তি, আলিবর্দীর শাসন ক্ষমতা লাভ, বর্গী দস্যুদের দমন, বিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন, কোম্পানির কাউন্সিলর ও কর্মচারীদের গোপন লিপ্সা প্রভৃতি বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে। আলীবর্দীর ইন্তেকাল এবং সিরাজউদ্দৌলার মসনদে আরোহনের মধ্য দিয়ে আলোচ্য নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, জগৎশেঠ, মীরজাফর, উমিচাঁদ, রাজাবল্লভ, রায়দুর্লভ, নন্দকুমারদের বিশ্বাসঘাতকতা, পলাশীতে স্বাধীনতাকামীদের পরাজয়, ইংরেজদের লুটপাটের চিত্র নিয়ে ‘পলাশী’ নাটকের কাহিনী আবর্তিত। পলাশি ট্রাজেডির পরবর্তী পরিস্থিতিতে মীরজাফরদের নামমাত্র নবাবী নিয়ে ‘পলাশীর কান্না’ নাটক রচিত। ‘অন্ধ রাতের ডাক’ নাটকে আমরা দেখতে পাই মীর কাসিমের নবাবী লাভ, ব্যবসা-বাণিজ্যে ইংরেজদের একচেটিয়া অধিকার, দেশিয় বণিকদের শোচনীয় অর্থনৈতিক অবস্থা, মীর কাসিম কর্তৃক বিশ্বাসঘাতকদের ফাঁসি প্রদান, স্বাধীনতার জন্য মীর কাসিমের জীবনপণ প্রয়াস। ১৭৭০ সালের মহাদুর্ভিক্ষ নিয়ে রচিত হয় ‘মন্বন্তর’ নাটকটি। কোম্পানি আমলের কুখ্যাত ইজারাদার দেবী সিংহের অত্যাচার নির্যাতন এবং ফকির সন্যাসীদের প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে ‘বিদ্রোহ’ নাটক রচিত। অর্থনৈতিক শোষণের লক্ষ্যে লর্ড কর্নওয়ালিসের জমি বণ্টনের নীল নকশা নিয়ে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ নাটকটি রচিত। একই সাথে মুসা শাহ, পরাগল শাহ, বাল্কী শাহ, ভবানী পাঠক, চেরাগ আলী, মজনু শাহ প্রমুখ ফকির সন্যাসীদের আন্দোলন সংগ্রামের কাহিনী স্বার্থকভাবে ফুটে ওঠেছে আলোচ্য নাটকে। ‘রেনেসাঁ’ নাটক কোলকাতাকেন্দ্রিক তথাকথিত নবজাগরণ ও আধুনিকতা, ইংরেজদের সহচর উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত শ্রেণি তথা বর্ণহিন্দুদের আবির্ভাব, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রত্যক্ষ মদদে খ্রিস্টধর্ম প্রচার এবং টিপু পাগলা, সোবাহান শাহ্ প্রমুখ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের চেতনা নিয়ে আবর্তিত। সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীরের সংস্কার আন্দোলন এবং জমিদার কৃষ্ণদেব ও তার সহচর রামচন্দ্রের সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে নাট্যকার রচনা করেছেন ‘বাঁশের কেল্লা’। নীলকরদের অত্যাচার অবিচার, জমিদারদের দৌরাত্ম্য এবং ফরায়েজি নেতা দুদু মিয়ার প্রতিবাদ প্রতিরোধ সংগ্রাম নিয়ে ‘ঝড়ের ডাক’ নাটক রচনা করেছেন নাট্যকার। ১৮৫৭ সালের জোয়ান-জনতার বিপ্লবে পশ্চিমবঙ্গের ব্যারাকপুরে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন ঈশ্বরী পাঁড়ে ও মঙ্গল পাঁড়ে এবং চট্টগ্রামে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন মহাবীর হাবিলদার রজব আলী। এঁদের ত্যাগ-তিতিক্ষা নিয়েই লেখক রচনা করেন ‘ঝড়ের রাতে’ নাটকটি। মেঘলা রাতের তারা গ্রন্থটির শেষে লেখক একটি মূল্যবান প্রবন্ধ সংযোজন করেন। ‘ইতিহাস কথা বলে’ শীর্ষক প্রবন্ধটিতে ১৮৫৭ সালের মহাঅভ্যুত্থানের প্রাণপুরুষ বাহাদুর শাহ জাফর, মৌলবী আহমাদুল্লাহ্ শাহ্, প্রিন্স আজিমুল্লাহ্ খান, ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মদ আলী, অযোদ্ধার বেগম হাসরত মহল, লক্ষ্মীবাঈ, তাঁতিয়া তোপী, বখত খান, শাহজাদা ফিরোজ শাহ্, রায়বেরেলীর খান বাহাদুর খান, বিহারের অমর সিং, কুমার সিং, মৌলবী ফজলে হক খায়রাবাদী প্রমুখ নেতৃবৃন্দের সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করেছেন। মেঘলা রাতের তারা গ্রন্থ সম্পর্কে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের সাবেক মহাপরিচালক সৈয়দ আশরাফ আলী মন্তব্য করেছেন এভাবে, ‘এ নাট্যগ্রন্থে আমাদের নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্যের এক বিস্তৃতকালের ঐতিহাসিক ঘটনা-পরিক্রমা বিধৃত হয়েছে। পলাশী বিপর্যয়ের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র থেকে শুরু করে এ মহাবিপর্যয়ের কারণ যেমন এ গ্রন্থে উঠে এসেছে, তেমনি এ বিপর্যয়ের পর সুদীর্ঘ এক’শ বছরব্যাপী সংঘটিত সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসও অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও মনোগ্রাহী ভাষায় বিবৃত হয়েছে।’ ৭

জমাদার দৌলত আলী এই দেশে এই জাতির জন্য জীবন দিয়েছেন পলাশির প্রান্তরে। দৌলত আলী একজন অখ্যাত সৈনিক। কিন্তু দেশমাতৃকার জন্য জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, দেশপ্রেমিকরা কখনও ষড়যন্ত্রকারীদের পাতা ফাঁদে পা’ দেয় না। পলাশিতে একটি তিন্তিড়ী ও বওলা বৃক্ষের ছায়াতলে তাঁর সমাধি। শ্রী অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘… তাহা একজন মুসলমান জমাদারের সমাধিস্তুপ। মুসলমান বীর সম্মুখ-সংগ্রামে সিরাজউদ্দৌলার সিংহাসন রক্ষার জন্য প্রাণপণে অস্ত্র চালনা করিয়া অবশেষে চিরনিদ্রায় অভিভূত হইয়াছেন। প্রতি বৃহস্পতিবারে বাঙ্গালী কৃষান-কৃষানরা তাহার উপর ভক্তি ভরে ফুল ফল তন্ডুলকনা ‘সিন্নী’ প্রসাদ করিয়া এখনও সেই পুরাকাহিনী সঞ্জীবিত রাখিয়াছে।’ ৮ মরহুম আসকার ইবনে শাইখ তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে রচনা করেছেন নাটক ‘দৌলত আলীর সন্তানেরা’। এছাড়া ‘পলাশী ও পলাশীর কান্না’ নাটকেও তাঁর চরিত্র স্বার্থকভাবে ফুটে ওঠেছে।

উপমহাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও স্বাধীনতার ইতিহাসে মুসলিম মহিলাদের অবদান অনেক। স্বাধীনতার প্রত্যাশায় নিজেদের অর্থ সম্পদ বিলিয়ে দিয়েছেন এবং বুকের ধন ছেলে মেয়েদেরকে জিহাদের ময়দানে পাঠিয়ে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেছেন দেশ ও স্বজাতির মুক্তির জন্য। ইতিহাসের পাতায় সেইসব মহান নারীদের অনেকেরই নাম নেই। অথচ তাঁদের মহাত্যাগের কাহিনি সত্যি। সেই সব জানা অজানা ১২ জন মহিয়সী নারীকে নিয়ে ড. শাইখ রচনা করেছেন ঐতিহাসিক নাটক কন্যা জায়া জননী। শিরোনামগুলো হলো – নাম না জানা মা, কবি রহিমুন্নেসা, নবাব নন্দিনী যীনাতুন্নেসা, গদীনশীন বেগম, সিরাজ বেগম লুৎফুন্নিসা, সিরাজ দুহিতা, ফরহাদ বানু, মন্নুজান, সুলতানা রাজিয়া, চাঁদ সুলতানা, মহিলা নবাব এবং বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন। শিরোনামই বলে দেয় নাটকের বিষয়বস্তু।

আসকার ইবনে শাইখের একটি বিখ্যাত মঞ্চনাটক ‘অগ্নিগিরি’। এই নাটকের মাধ্যমে লেখক দেশের জনগণকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস পেয়েছেন। এই নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফকির বিদ্রোহের নেতৃত্বদানকারী মজনু শাহ। বিদেশি শক্তির অত্যাচারের মোকাবেলা করতে দেশপ্রেমিক সংগ্রামী কর্মীদের উদ্ভব ঘটে। তাঁরা ইংরেজ শোষকের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য বিদ্রোহী মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলেন। এইসব মু্িক্তযোদ্ধাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ফকির মজনু শাহ। অতীতের সেই মহামানুষটির কৃতিত্ব নাটক আকারে তুলে ধরে ড. শাইখ একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৮৫৭ সালের মুক্তিসংগ্রামে গর্জে ওঠেছিলো এদেশের আমির, বণিক, কৃষক, সিপাহি, দিনমজুরসহ সকল শ্রেণি পেশার নাগরিক। সেই মহাঅভ্যুত্থানের চেতনাকে উদ্বেলিত হয়ে ড. শাইখ রচনা করেন মঞ্চ নাটক রক্তপদ্ম, অনেক তারার হাতছানি এবং গল্পগ্রন্থ কালো রাত তারার ফুল। প্রিন্স আজিমুল্লাহ খান, শাহ আহমাদুল্লাহ সুফী, মুহাম্মদ আলী খান, হযরত মেহরাব আলী শাহ, হাবিলদার রজব আলী, পীর আলী, মৌলবী এলাহি বকস, বেগম হাসরত মহল, ওয়াজেদ আলী শাহ, শাহজাদী কুলসুম যমানী, সফর আলী খানসহ অসংখ্য জানা অজানা মুসলিম বীরদের বীরত্বগাঁথা নিয়ে রচিত এসব নাটক ও গল্প। ১৮৫৭ সালের ১ লা আগস্ট ঈদ-উল-আজহার দিনে উজনালয় ২৩৫ জন নিরস্ত্র মুসলিম সিপাহীকে হত্যা করে ইংরেজ পিশাচ ফ্রেডারিক কুপার ও তাঁর এদেশিয় দোসররা। উল্লেখ্য ২৮২ জন সিপাহীকে উজনালার পুলিশ স্টেশনে একটি ছ্ট্টো কুঠুরিতে বন্দী করা হয়। এঁদের মধ্যে ৪৭ জন জন প্রচন্ড গরমে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। আর বাকিদের প্রতিবারে ১০ জন সিপাহিকে দঁড়িতে বেঁধে কুপারের আদেশে গুলি করে হত্যা করে শিখ সৈন্যরা। এইসব হতভাগ্য শহিদদের স্মরণে রচিত হয় বেতার নাটক ‘এমনি এক বকরীদে’।

ইসলামি চেতনায় অভিসিক্ত, মহানবি (সঃ) এর আদর্শ সংগ্রামের প্রতি অনুরক্ত নাট্যকার ড. আসকার ইবনে শাইখ তাঁর কর্মময় জীবনে ইসলাম থেকে কখনও বিচ্যুত হননি। তাইতো আমরা দেখতে পাই, ঐতিহাসিক বদরযুদ্ধ, খন্দকের যুদ্ধ, মক্কা বিজয়, ইমাম হোসাইনের শাহাদাত, সালাহউদ্দিন আইয়ুবির স্বাধীনতা সংগ্রাম এর ঘটনার নাট্যরূপ দিয়ে তিনি অমর হয়ে আছেন। বাংলা সাহিত্যে এর দ্বিতীয় কোনো নজির নেই।

৬২২ সালে সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ। এই যুদ্ধে পরাজিত কুরায়েশ বাহিনীর ৭০ জন সদস্য বন্দী হয়। যুদ্ধবন্দীদের প্রতি মহানবি (সঃ) এর মহানুভবতা নিয়ে রচিত হয় ‘মুক্তি অভিনব’ নাটক। মহানবি (সঃ) এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী ও আবু সুফিয়ানের মুশরিক বাহিনীর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৬২৬ সালে। এ যুদ্ধে কাফের, মুশরিক, ইহুদি ও বেদুইনদের সৈন্য সংখ্যা ছিলো ১০ হাজার। আর মুসলিম মুজাহিদদের সংখ্যা ছিলো মাত্র আড়াই হাজার। যুদ্ধে আবু সুফিয়ানের বাহিনী পরাজিত হয়ে মক্কায় ফিরে যায়। এই খন্দকের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ড. শাইখ রচনা করেন ‘প্রতিধ্বনি’ নাটক। এ প্রসঙ্গে নাট্যকার লিখেছেন, ‘কিন্তু খন্দকের যুদ্ধকে তুলে ধরাই এ রচনার মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের সর্বাঙ্গীন কল্যাণের জন্য, পতিত অবদমিত দিশাহারা মানুষের জন্য, রহমাতুল্লিল আলামীন নবীজী মুহাম্মদ (সঃ) এর মাধ্যমে আল্লাহ প্রদত্ত পুর্ণাঙ্গ দ্বীন বা জীবন বিধান যে ইসলাম, তারই চিরশ্বাশ্বত আহ্বানকে তুলে ধরা।’ ৯ ইসলামী বিপ্লবের কাহিনি নিয়ে রচিত লেখকের আরেকটি নাটক ‘মহাবিজয়’। নবি করিম (সঃ) এর মক্কা বিজয়কে কেন্দ্র করে এটি রচিত। মুসলিম মিল্লাতের মহামিলনমেলা হজ্জ ও কুরবানি নিয়ে লেখক সৃষ্টি করেন ‘বান্দা হাজির আল্লাহ’ নাটকটি।

কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসাইনের শাহাদাত এবং ইয়াজিদ বাহিনীর নৃশংসতা ও উল্লাস নিয়ে রচিত হয় ‘দান্তে কারবালা’ নাটকটি। ক্রুসেডের দ্বিতীয় পর্যায়ে চিরস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন গাজি সালাহউদ্দিন ইউসুফ আইয়ুুবি। ১১৮৭ সালে সুলতান তাঁর মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে ক্রুসেডারদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয় হিত্তিনের প্রান্তরে। হিত্তিনের প্রচন্ড যুদ্ধে বিজয়ী মুজাহিদরাই পুনর্দখল করে নেয় জেরুযালেম। এই ঘটনা নিয়ে ড. শাইখ রচনা করেন বেতার নাট্য ‘এক সিংহের জাগরণ’।

অষ্টম শতকের শুরুতে রাজা রডারিক স্পেনকে নরক রাজ্যে পরিণত করেছিলো। মানুষের জীবন ও নারীদের মান সম্ভ্রম নিয়ে সে হোলিখেলায় মেতে ওঠে। ইহুদিদের ওপর চালিয়েছিলো নির্যাতনের স্টিমরোলার। মানবতা সেখানে লুন্ঠিত হচ্ছিল চরমভাবে। সেই বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে তারিক বিন যিয়াদ ৭১২ সালে রাজা রডারিককে পরাজিত করে স্পেনের মাটিতে শান্তির পতাকা উড্ডীন করেন। আন্দালুসিয়ায় ইসলামের ইতিহাসের এই গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা এবং রডারিক-ফ্লোরিণ্ডা-ফোনিস-জুলিয়ান ও অত্যাচারিত ইহুদিদের বিদ্রোহ নিয়ে ড. শাইখ রচনা করেন ঐতিহাসিক নাটক ‘কর্ডোভার আগে’। আন্দালুসিয়ায় প্রায় ৮০০ বছর মুসলমানরা রাজত্ব করে। স্পেনের মাটি থেকে মুসলিমদের শেষ অধিকার খ্রিস্টানরা মুছে দেয় ১৫০২ সালে। রাজা ফার্দিনান্দ ও রানী ইসাবেলা মুর মুসলমান নিধনের শেষ ‘কর্তব্য’টুক পালন করে। স্পেনের মুসলমানদের রক্ষায় খ্রিস্ট অপশক্তির বিরুদ্ধে জিহাদের অবতীর্ণ হয় মহাবীর মুসা। মুসার বীরত্ব ও মুসলিমদের বিষাদময় কাহিনি নিয়ে রচিত হয় ঐতিহাসিক নাটক ‘রাজপুত্র’।

আসকার ইবনে শাইখের আরেকটি বিখ্যাত নাটক রাজ্য রাজা রাজধানী। ইসলাম এদেশিয় জনসমাজের ধর্ম-সমাজ-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত করে। সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ন্যায়, উদারতা, মৈত্রির বানী ছড়িয়ে হিন্দু লাঞ্ছিত-প্রপীড়িত সমাজে মুক্তির সোনালী আশ্বাস এনেছিলো ইসলাম। ফলে তার গ্রহণযোগ্যতা হয়েছিলো ব্যাপক। বস্তুত ইসলামের মানবিক আবেদনে এদেশিয় জনসমাজের আলোকময় রূপান্তর ঘটে। ড. শাইখ সেই বিস্মৃত, চাপাপড়া সময় ও মানুষকে নাটকের মুখের আঙিনায় টেনে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেন তারই স্বার্থক ফলশ্র“তি রাজ্য-রাজা-রাজধানী। মোট ১৪ টি নাটকের পরিসরে তিনি সেই বিশেষ সময়কালটির যে রূপরেখা প্রস্ফুটিত করেছেন একালে তার গুরুত্ব ও মূল্য অপরিসীম। এসব নাটকে লেখকের ইতিহাসনিষ্ঠা, স্বজাতিপ্রেমের পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের উজ্জ্বল প্রকাশ মূর্ত হয়ে ওঠেছে। ১০

আসকার ইবনে শাইখ ঐতিহাসিক ছিলেন না বটে। তবে তাঁর প্রবন্ধরাজি ইতিহাসের নানা উপাদান এবং অজানা অনেক তথ্য উপাত্তে সমৃদ্ধ। ইতিহাসের অন্তরালে হারিয়ে যাওয়া অজানা অনেক বিষয়কে হাজির করে অনুসন্ধিৎসুদের দৃষ্টিকে খুলে দিয়েছেন তিনি। কবি আবিদ আজাদ লিখেছেন, ‘আসকার ইবনে শাইখকে প্রশ্ন করেছিলাম- আজকের দিনে সামাজিক নাটক থেকে অনেকটাই মুখ ফিরিয়ে আপনি ইতিহাসের প্রতি এত মনোযোগী হয়ে উঠলেন কেন? উত্তরে তিনি বললেনঃ ইতিহাসের একটা অর্থ যদি ‘প্রাচীন বা অতীতের কথা’ হয়, তাহলে আজকের কথার সঙ্গে অতীতের কথার একটা যোগসূত্রকে অস্বীকার করা যায় না। আজকের সমাজের নানা সমস্যার কথা, বিশেষ করে আমাদের দেশে বিরাজমান সম্প্রদায়গত সম্পর্কের কথা, ভাবতে গিয়েই আমাকে অতীতের পানে তাকাতে হল। আমার জীবনের প্রথম অনেকটা অংশই কেটেছে হিন্দু সমাজের নিবিড় সাহচর্যে। তখনই হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কিত কিছু প্রশ্ন আমার মনে জাগে, বৃদ্ধি পায় এদেশের সামাজিক ইতিহাসের প্রতি আমার আগ্রহ। এ ব্যাপারে পরবর্তীতে স্বনামখ্যাত ভারতীয় চিন্তাবিদ মানবেন্দ্র নাথ রায়- এর ‘ The Historical Role Of Islam ’ পুস্তিকাটি এবং আরও কয়েকজন প্রগতিশীল লেখকের বইপত্র আমাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে।
তারপর কেটেছে বেশ কিছু সময়। জীবনের অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে পরিণত বয়সে পা’ রেখেছি। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে হিন্দু মুসলমান সম্পর্কের ব্যাপারে রাজনৈতিক ও সামাজিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যে ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। তাকে যতটা সম্ভব ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে যাচাই করে দেখার চেষ্টা করেছি। তার সঙ্গে আরও জানার প্রয়োজন অনুভব করেছি। এর থেকেই প্রধানত আমার এই ইতিহাস মনস্কতা।’ ১১ ইতিহাসের অন্ধগলি হাতড়িয়ে তিনি মনিমুক্তাকে টেনে তুলেছেন অকুতোভয়ে। সত্য ও বাস্তবতাকে নিশঙ্কচিত্তে পাঠকের সামনে পেশ করেছেন। মাটি ও মানুষের কথা, সহসা নতুন ভোর, রঙধনুকের দেশে, স্বদেশ সমাচার, নামাকরণ সমাচার, বাঙালী জাতি, সংস্কৃতি সভ্যতার অভিযাত্রা ও ঈদুল ফিতর, চৈতন্য থেকে চেতনা, স্বাধীন স্বপ্নভূমি ও স্বীয় সাংস্কৃতিক কথা, স্বাধীন স্বপ্নভূমি ও সাম্প্রদায়িকতা, বাংলাদেশের বহমান সংস্কৃতি ধারা, স্বাধীন সুলতানী আমলে বাঙ্গালার সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থা, কতিপয় পর্যটক ও লেখকের দৃষ্টিতে সুলতানী আমলের বাঙ্গালা, নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও পলাশী বিপর্যয়, মীর জাফরী নবাবী এবং, স্বাধীনতাকামী নবাব মীর কাসিম শীর্ষক নিবন্ধসমূহ তাঁর ইতিহাস সচেতনতার পরিচয় বহন করে।

ইতিহাসখ্যাত দুর্দমনীয় তুর্কি বীর ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খলজি ১২০৫ সালের ১০ মে (১৯ রমযান ৬০১ হিজরি) নদিয়া অর্থাৎ লক্ষ্মণাবতী অধিকার করেন। ১২ একই সাথে বাংলাদেশে রাজনৈতিক মুসলিম যুগের সূচনা ঘটে। এ প্রসঙ্গে ড. শাইখ লিখেছেন, ‘বাঙলায় মুসলিম রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে ইখতিয়ার-উদ-দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর নাম ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। এই রাজ্যটি প্রতিষ্ঠার পরই বিভিন্ন স্থান থেকে নতুন উপায়ে মুসলমানরা স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে এ রাজ্যে আসেন। মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, নব প্রতিষ্ঠিত এ রাজ্যটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য একটি মুসলমান সমাজের প্রয়োজন। এমনি একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার কাজ অবশ্যি ত্রয়োদশ শতকের বহু আগেই আরম্ভ করেছিলেন এদেশে আগত সুফি-দরবেশগণ। তাঁদেরই মাধ্যমে ইসলামের বাণী বাঙ্গলার সজল মাটি স্পর্শ করেছিল সপ্তম শতকেই। পরবর্তীতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার ফলে ইসলামের প্রচার ও প্রসার ত্বরান্বিত হয়ে ওঠেছিল মাত্র।’ ১৩

‘মুসলিম আমল বাংলার শাসনকর্তা’ ড. শাইখের অসাধারণ গবেষণাকর্ম। ১২০৫ থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত সাড়ে পাঁচশ’ বছরের মুসলিম শাসনের ওপর সংক্ষিপ্ত অথচ একটি প্রামাণ্যগ্রন্থ। বখতিয়ার খিলজী থেকে সিরাজউদ্দৌলা পর্যন্ত এ দীর্ঘ সময়ের ৯৪ জন শাসনকর্তার ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৩৩৮ থেকে ১৫৩৮ সাল পর্যন্ত দুশ বছর ছিলো স্বাধীন বাঙ্গালা। সুলতান ফখর-উদ-দীন মুবারক শাহ্ (১৩৩৮-১৩৪৯) ছিলেন স্বাধীন বাঙ্গালার প্রতিষ্ঠাতা। শেষ স্বাধীন সুলতান ছিলেন গিয়াস-উদ-দীন মাহমুদ শাহ (১৫৩৩-১৫৩৮)। ১৫৩৮ সালে পাঠান বীর শের খান বাঙ্গালা জয় করেন। শুরু হয় বাঙ্গালায় আফগান শাসন। ১৫৭৬ সাল পর্যন্ত আফগানরা স্বাধীনভাবে দেশ শাসন করেন। ১৫৭৬ সালের ১২ জুলাই রাজমহলের যুদ্ধে আফগান নেতা দাউদ খান কররানি মুঘল সেনাপতি খান ই জাহানের কাছে পরাজিত হয়। শুরু হয় মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে সুবে বাঙ্গালা। এ ঘটনার ১৮১ বছর পর পলাশিতে চূড়ান্তভাবে স্বাধীনতা হারায় বাংলাদেশ। ১৭৫৭ থেকে ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার ১০ জন নবাব নাজিম নামমাত্র দায়িত্ব পালন করেন। এরা মুলত ছিলেন রাজনৈতিক যাত্রামঞ্চের ভার। মূল ক্ষমতা ছিলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। ইতিহাসে এ সময়টা ‘মুর্শিদাবাদ নাজিমি’ আমল নামে পরিচিত। আসকার ইবনে শাইখ সংক্ষেপে উক্ত ১০ জন কথিত নবাবের দায়িত্ব ও ক্ষমতার ওপর আলোচনা করেছেন। মধ্যযুগের বাঙ্গালার সুফী সাধকদের জীবনী ও কর্মের ওপরও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে আলোচ্য ইতিহাসগ্রন্থে।

আসকার ইবনে শাইখের ইতিহাসের ওপর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হলো গবেষণাধর্মী ‘ক্রুসেডের ইতিবৃত্ত’। বাংলা ভাষায় এ বিষয়ে তথ্যসমৃদ্ধ দ্বিতীয় কোনো বই রচিত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। পুস্তকখানা ক্রুসেডের হাজার বছরের ইতিহাসের একটি অমূল্য এ্যালবাম। ১০৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর পোপ দ্বিতীয় আরবান প্রাচ্য মুসলিম জাতির বিরুদ্ধে ক্রুসেড ঘোষণা করেন। খ্রিস্টান ইউরোপের ‘অর্বাচীন, বর্বর ও মূর্খ’ লোকেরা মুসলিম রাজশক্তিকে খতম এবং মুসলিমদের নিধনের লক্ষ্যেই ক্রুসেড যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ১০৯৮ সালে ওরা এন্টিয়ক দখলে নিয়ে সেখানে ১০ হাজার মুসলিমকে হত্যা করে। ১০৯৯ সালে জেরুজালেম দখল করে ভয়ঙ্কর এক রক্ত স্নানের মধ্য দিয়ে। ক্রুসেডাররা ফালি ফালি করে কেটে ফেলে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষকে। তলোয়ারের নাগালের মধ্যে কেউ রেহাই পায়নি। মুসলিমদের লাশে আবৃত রাস্তা দিয়ে পায়ের গোড়ালি সমান রক্তধারা পেরিয়ে অতিকষ্টে হেঁটে যেত ক্রুসেডাররা। মুসলিম নিধনের সেই বর্বর দৃষ্টান্ত আজও ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, ইরাক, আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, সুদান, চেচেন, কসোভা, ভারত, কাশ্মীর, মায়ানমার ফিলিপাইন, আলবেনিয়ায় লক্ষ্যণীয়। ১১৮৭ সালের ২ জুলাই গাজি সালাহউদ্দিন আইয়ুবি খ্রিস্টান ক্রুসেড জঙ্গি সন্ত্রাসীদের আস্তানা গুড়িয়ে দিয়ে জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করেন।

খ্রিস্টান ধর্মযোদ্ধারা আরব দুনিয়ায় পরাজিত হলেও তারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পরে রক্তের নেশায়। কলম্বাস, ভাস্কো দা গামা, উইলিয়াম হকিন্স, লর্ড ক্লাইভ, রাজা ফার্দিনান্দ, রানী ইসাবেলা, নেহেরু, বাল গঙ্গাধর তিলক, প্যাটেল, বল থ্যাকার, গান্ধি, মাওসেতুঙ, জন মেজর, বুশ, ব্লেয়ার, বারাক ওবামা, ফাত্তাহ সিসি, নরেন্দ্র মোদি, অংসান সূচি, নেতানিয়াহু সকল সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রই ক্রসেডারদের প্রতিচ্ছবি। পার্থক্য শুধু এক জায়গায়- তখন ক্রুসেডের অন্তর্ভুক্ত ছিলো শুধু খ্রিস্টান সম্প্রদায়। বর্তমানে ইহুদি, খ্রিস্টান ও ব্রাহ্মণ্যবাদী এ ত্রিশক্তি মিলে ক্রুসেডের পতাকা বহন করছে। ড. শাইখের চোখে বিষয়টা ধরা পরেছে এভাবে, ‘১০৯৫ খ্রিস্টাব্দের শেষ থেকে ১২৯১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জারি ছিলো খ্রিস্টশক্তির আরম্ভ করা এই ক্রুসেড এবং তারই জবাব হিসেবে মুসলিম শক্তির জেহাদ। প্রথম পর্যায়ে খ্রিস্টানরা বিজয়ী হলেও পরবর্তী দুটি পর্যায়ে জয় পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বিজয়ী হয় মুসলিম শক্তি।
১২৯১ খ্রিস্টাব্দের পরেও জারি ছিলো এই ক্রুসেড, যদিও তার উত্তেজনা তখন নিঃশেষ প্রায়। ইতিহাসে সেসব ক্রুসেড ‘পরবর্তী ক্রুসেড’ নামে অভিহিত; আর তাতেও পরাজিত হয় খ্রিস্টশক্তি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মুসলিম শক্তি এই বিজয়ের ফসল ঘরে তুলে সমৃদ্ধশালী হতে পারেনি; বরং বিজিত খ্রিস্টানরাই রেনেসাঁ বা নবজাগরণের সূর্যালোকে স্নাত হয়ে বিভূষিত হল নবযুগ স্রষ্টার গৌরবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, খ্রিস্টানদের করায়ত্ব এই নবযুগে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে-কৌশলে-শক্তিতে বলীয়ান হয়ে তারা মুসলিম প্রতিপক্ষকে ধ্বংসের নবতর উপায় উদ্ভাবনে নিজেদেরকে নিয়োজিত করে। ফলে মধ্যপ্রাচ্য ও প্রাচ্যংশের এই ভারতবর্ষেও তারা ছুটে আসে নিজ স্বার্থ উদ্ধার ও বহুকালপোষিত মুসলিম বিদ্বেষ চরিতার্থের লক্ষ্যে। মুসলিম শক্তির অযোগ্যতা ও চরিত্রহীনতার সুযোগে তারা সে লক্ষ্য অর্জনে সফলও হয়। ভারতবর্ষে মুসলিম মুঘল শক্তিকে ধ্বংস করে তারা ভারতবর্ষের অধিশ্বর হয়ে বসে। ইউরোপিয় খ্রিস্টশক্তির এসব কর্মকাণ্ডকেই আমরা চিহ্নিত করেছি ‘আরও পরবর্তী ক্রুসেড’ রূপে।
একেবারেই হালে আমরা পৃথিবীময় কি দেখতে পাচ্ছি? বসনিয়ায়, ফিলিস্তিনে, কাশ্মীর ও ভারতের নানাস্থানে এবং পৃথিবীর অন্যান্য ভূভাগে? মুসলমানদের বিরুদ্ধে খ্রিস্টান-ইহুদি-ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তির এসব কর্মকাণ্ড কি সেই ক্রুসেডকেই স্মরণ করিয়ে দেয় না?’ ১৪

হদিস :
১. আসকার ইবনে শাইখ, বাংলা মঞ্চ নাট্যের পশ্চাতভূমি, সাত রং প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ, একুশে ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা- ১৪৮ (কভার পেজ, লেখক পরিচিতি প্রসঙ্গে)
২. আসকার ইবনে শাইখ, বাংলা মঞ্চ নাট্যের পশ্চাতভূমি, সাত রং প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ, একুশে ফেব্র“য়ারি, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা- ৮০
৩. উদ্বৃতি- মুহাম্মদ মতিউর রহমান, নাট্যকার আসকার ইবনে শাইখ, মাসিক অগ্রপথিক, জুলাই ২০০৯, ২৪ বর্ষ, সংখ্যা ৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, পৃ ৩৮
৪. আসকার রচনাবলী ২, আবিদ আজাদ ও মাহবুব হাসান সম্পাদিত, শিল্পতরু প্রকাশনী, ঢাকা, সেপ্টেম্বর ১৯৯২, পৃ ১৩৫
৫. আসকার রচনাবলী ১, আবিদ আজাদ ও মাহবুব হাসান সম্পাদিত, শিল্পতরু প্রকাশনী, ঢাকা, সেপ্টেম্বর ১৯৯২, পৃ ৭৫
৬. আসকার ইবনে শাইখ, মেঘলা রাতের তারা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, তৃতীয় সংস্করণ, সেপ্টেম্বর ২০০৩, পৃ ৭
৭. আসকার ইবনে শাইখ, মেঘলা রাতের তারা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, তৃতীয় সংস্করণ, সেপ্টেম্বর ২০০৩, পৃ ৫
৮. শ্রী অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, সিরাজদ্দৌলা, দিব্য প্রকাশ, একুশে ফেব্র“য়ারি ২০০৩, পৃষ্ঠা ২১২
৯. আসকার রচনাবলী ৮, আবিদ আজাদ ও মাহবুব হাসান সম্পাদিত, শিল্পতরু প্রকাশনী, ঢাকা, সেপ্টেম্বর ১৯৯৬, পৃ ১০
১০. আসকার ইবনে শাইখ, রাজা রাজ্য রাজধানী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ, এপ্রিল ২০০৫, পৃ ৬
১১. আসকার রচনাবলী ৪, আবিদ আজাদ ও মাহবুব হাসান সম্পাদিত, শিল্পতরু প্রকাশনী, ঢাকা, সেপ্টেম্বর ১৯৯৩, পৃ ৪
১২. সুখময় মুখোপাধ্যায়, বাংলার ইতিহাস (১২০৪-১৫৭৬), খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি, এপ্রিল ২০০০, পৃ ১১, ২৪
১৩. আসকার রচনাবলী ৭, আবিদ আজাদ ও মাহবুব হাসান সম্পাদিত, শিল্পতরু প্রকাশনী, ঢাকা, সেপ্টেম্বর ১৯৯৬, পৃ ২৬০
১৪. ড. আসকার ইবনে শাইখ, ক্রুসেডের ইতিবৃত্ত, মদীনা পাবলিকেশন্স, বাংলাবাজার, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ফেব্রুয়ারি ২০০২, পৃ ৬-৭

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *