সাংবাদিক এম জাকির হোসেন স্মরণে

আযাদ আলাউদ্দীন

ভোলার লালমোহনের সাংবাদিক এম. জাকির হোসেনের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় ১৯৯৯ সালে। আমি তখন দৈনিক জনতার বোরহানউদ্দিন উপজেলা সংবাদদাতা হিসেবে কর্মরত। কম্পিউটার শেখার জন্য ভোলা শহরে অবস্থান করছিলাম। তখন আমার বেশির ভাগ সময় কাটতো সাংবাদিক নজরুল হক অনু ভাইয়ের সাংবাদিক সংস্থা কার্যালয়ে। ভোলা শহরের অবসর সিনেমা হলের বিপরীত দিকের এ অফিসটি তখন সাংবাদিকদের পদচারনায় ছিল বেশ জমজমাট।
একদিন সন্ধ্যায় ওই অফিসে বসেই অনু ভাই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন জাকির ভাইয়ের সঙ্গে। বললেন- ইনি সাংবাদিক জাকির, দৈনিক দিনকালের ভোলা জেলা প্রতিনিধি। এরপর বিস্তারিত পরিচয়, কুশল বিনিময়, পেশাগত অন্তরঙ্গতা, দিনের পর দিন- দশ বছরের কত স্মৃতি—- সবই এখন ভেসে উঠছে মনের পর্দায়।
ভোলা আসলেই জাকির ভাই প্রথমে দেখা করতেন অনু ভাইর সাথে। আর আমি তখন ভাড়া থাকতাম ওয়েস্টার্ন পাড়ায় অনুভাইর পাশের একটি বাসায়। যারকারনে অনু ভাই বাসা থেকে বের হলেই প্রতিদিন আমার সাথে দেখা, প্রায় সময়ই দেখতাম তার সাথে রয়েছেন জাকির ভাই। আমরা তিনজন মিলে জমে উঠতো বেশ আড্ডা। ভোলা সাংবাদিক সংস্থার অফিস, খলিফা পট্রি, ডিসি অফিস, বাংলা স্কুল মোড় এসবই ছিল আড্ডার মূল জায়গা। রাত জাগা ‘নিশাচর’ অনু ভাইয়ের সাথে আমরাও যেন নিশাচর হয়ে উঠলাম। এভাবে কেটেছে প্রায় ছয়মাস।

এরপর আমি বিএম কলেজে বাংলায় অনার্সে ভর্তি হয়ে চলে আসলাম বরিশাল। পড়াশোনার পাশাপাশি স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে যোগ দিলাম দৈনিক দক্ষিণাঞ্চলে। জাকির ভাই তারও অনেক আগে থেকে এ পত্রিকার লালমোহন প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তখন দক্ষিণাঞ্চলের বার্তাসম্পাদক ছিলেন আকতার ফারুক শাহিন ভাই। তার সাথে সাথে জাকির ভাইর ছিল অন্যরকম গভীর সম্পর্ক। আমি দক্ষিণাঞ্চলে যোগ দেয়ায় জাকির ভাই খুব খুশি হলেন। এরপরতো নিয়মিত যোগাযোগ। কিছুদিন পর আকতার ফারুক শাহিন ভাই দক্ষিণাঞ্চল ছেড়ে আজকের বার্তায় চলে যান। তখন দক্ষিণাঞ্চলের বার্তাসম্পাদকের দায়িত্ব আসে আমার উপর। সেকারনে নিউজের প্রয়োজনে জাকির ভাইয়ের সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ আরো বেড়ে যায়।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি কেমন ছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে স্পষ্ট না থাকলেও তার পেশাগত দিকটি আমার কাছে ছিল খুবই স্পষ্ট। স্থানীয় পত্রিকার একজন বার্তাসম্পাদক ভালোভাবেই জানেন তার কোন এলাকার রিপোর্টারের লেখা, লেখার মান, সংবাদ নিরপেক্ষতা ও কৌশল কেমন। এসব ক্ষেত্রে জাকির ভাই ছিলেন মানউত্তীর্ন। তার লেখা এডিটিংয়ের তেমন কোন প্রয়োজন হতোনা। নিশ্চিন্তে ছেপে দিতাম তার লেখা। কারণ আমার বিশ্বাস ছিলো- সকল ধরনের ঝামেলা মোকাবেলা আর নানা দিক বিবেচনা করেই কৌশলী লেখা লিখতেন তিনি।
জাকির ভাইর হাতের লেখা ছিল খুবই সুন্দর, লিখতেন গোট গোট করে বড় বড় অক্ষরে। ফোনে প্রায়ই মজা করে বলতাম- জাকির ভাই, এত বড় বড় অক্ষরে লিখে আমাদের ফ্যাক্সের কাগজ তো সব আপনিই শেষ করে ফেলছেন। তিনি বলতেন- ছোট অক্ষরে লিখলে তো আপনাদের পড়তে অসুবিধা হবে। তাই এরুপ বড় করে লেখা।
কয়েকবছর পর জাকির ভাই এবং এমএমসির হাত ধরে লালমোহনের সাংবাদিকতায় যুক্ত হলেন জসিম জনি। তখন বেশির ভাগ সময়ই জসিম জনির হাতের লেখা ড্রাফট সাইন করে অফিসে পাঠাতেন জাকির ভাই। পর্যায়ক্রমে জনিও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে পাকা সাংবাদিক হয়ে ওঠেন। জাকির ভাই কেমন যেন কিছূটা অলস হয়ে উঠতে লাগলেন। প্রায়ই ছোট খাট নিউজ মিস করতেন। পরদিন ফোন করলে বলতেন ‘ভাই অলস হয়ে গেছি’।
বলতাম- আপনি অলস হয়েছেন তো কি হয়েছে ‘আপনার পাটোয়ারি আছেনা !’ । কথাটি তিনি প্রথমে বুঝতে পারেননি। পরে যখন বোঝালাম আপনি তো এখন আর তেমন একটা লেখেন না, বেশির ভাগ লেখার ড্রাফটইতো লিখছে আপনার শিস্য জসিম জনি। আপনি তো শুধু সাইন করে পাঠান। তাহলে জনি কি আপনার পাটোয়ারি (দলিল লেখক) না? এরুপ বলার পর তিনি হেসে উঠে খুব মজা করলেন। প্রায়ই বিষয়টি নিয়ে জোকস্ করতেন তিনি । বলতেন- আরে ভাই আমার পাটোয়ারি এখন আর ঠিকমত কাজ করেনা ! আপনি কিছু বলেন।
একবার জাকির ভাইকে বললাম- আমি পেশা এবং বয়স- দুটোতেই আপনার জুনিয়র। আমাকে ‘আপনি’ না বলে ‘তুমি’ সম্বোধন করবেন। তিনি যুক্তি দেখিয়ে বললেন এটা সম্ভব নয়। বললাম কেন? তিনি বললেন- আপনি বয়স এবং পেশায় আমার চেয়ে জুনিয়র হলেও অফিসিয়াল দৃষ্টিতে আপনি আমার বস। হয়তো দেখা গেলো অফিসে বসেই আমি আপনাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করলাম। তখন অন্য স্টাফদের মাঝেও এর নেগেটিভ প্রভাব পড়তে পারে। আমি তার যুক্তির কাছে হেরে গেলাম।
দশ বছরে জাকির ভাইর সাথে মিশে আছে অনেক স্মৃতি । সেসব স্মৃতি লিখে লেখার পরিসর না বাড়িয়ে শুধু এক কথায় বলবো- মফস্বল সাংবাদিকতায় একজন নিবেদিত প্রাণ সংবাদকর্মি ছিলেন জাকির ভাই। ঢাকা কিংবা বরিশালে সাংবাদিকতা করলে তিনি হয়তো অনেক ভালো করতে পারতেন। কিন্তু লালমোহনের মাটি ও মানুষকে ভালোবেসে তিনি এলাকা ছাড়েননি । তাকে কয়েকবার অফার করেছিলাম- বরিশালে এসে ডেস্কে জয়েন করেন। তিনি রাজি হননি। সাংবাদিকতার জন্য তার মতো এতো অধিক সময় ব্যয় এখনকার কয়জন মফস্বল সাংবাদিক করেন? বিষয়টি প্রশ্নের দাবি রাখে।
শুনেছি জাকির ভাইর নামে লালমোহনে একটি স্মৃতি পরিষদ হয়েছে, আছে তার দীর্ঘদিনের সবচেয়ে প্রিয় ঠিকানা প্রেসক্লাব, এছাড়াও সক্রিয় রয়েছে রিপোর্টার্স ইউনিটি। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে আমার প্রত্যাশা সকলে মিলে জাকির ভাইর স্মৃতি রক্ষায় কিছু একটা করুন। তার দীর্ঘদিনের গবেষণাধর্মী লেখা গুলো একত্রিত করে একটি সংকলন বের করা যেতে পারে। অনেক ম্যাগাজিন ও পত্রিকায় নিয়মিত আইটেমের পাশাপাশি তার অনেক স্পেশাল লেখাও প্রকাশিত হয়েছে। এসব বিশেষ লেখা নিয়ে একটি বই প্রকাশ হতে পারে। জাকির ভাইর পরিবারের সব সদস্য ও তার সন্তান ভালো আছেতো ? আমরা সহকর্মিরা কি তাদের খোজ খবর নিচ্ছি?
নিউজের চিন্তা মাথায় রেখে যে মানুষটি ঘুমোতে যেতেন, আবার সকাল হলে একই চিন্তা মাথায় নিয়ে জেগে উঠতেন, সেই জাকির ভাই এমনভাবে চলে যাবেন বিষয়টি আমাদের ভাবনায়ও আসেনি কখনো।

সড়ক দূর্ঘটনায় তার মৃত্যুর খবরটি প্রথম পাই কবি ফিরোজ মাহমুদের কাছে। লালমোহন কামিল মাদরাসার সহকারি অধ্যাপক ফিরোজ ভাই সেদিন বরিশালে আমার কাছে অবস্থান করছিলেন। মোবাইল ফোনে অবগত হয়ে খবরটি আমাকে জানান তিনি। শুনে বিস্ময়ে অবাক হয়েছি। খবরের সন্ধানে বাড়ি থেকে বের হওয়া মানুষটি শেষ পর্যন্ত নিজেই খবর হয়ে উঠলেন। সহকর্মি সাংবাদিকদের শোকসাগরে ভাসিয়ে চির বিদায় নিলেন তিনি। জাকির ভাই, আমরা অপনার স্মৃতি কি কখনো ভুলতে পারি ? । ##

আযাদ আলাউদ্দীন বরিশাল ব্যুরো চিফ, দৈনিক নয়াদিগন্ত
০১৭১২১৮৯৩৩৮

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *