সৈয়দ আলী আহসানের অনন্য গ্রন্থ ‘মহানবী’

ড. সাইয়েদ মুজতবা আহমাদ খান ।।

মনীষী সৈয়দ আলী আহসান তাঁর ‘জীবনের শিলান্যাস’ গ্রন্থে লিখেন: ১৯৫৮ সালের এপ্রিল কি মে মাসে আমি তেহরান গিয়েছিলাম। তেহরানে থাকা কালে ইরানের বিখ্যাত পণ্ডিত যায়নুল আবেদীন রাহনুমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। তিনি তাঁর রচিত ‘পয়াম্বর’ বইটি আমাকে উপহার দেন। আমার হাতে তিনি বইটি তুলে দিয়ে বলেছিলেন ‘একজন সাহিত্যিক তাঁর সাহিত্য চর্চায় যদি মহান রাসুলের জীবনকে অবলম্বন করে তাহলে সে একই সঙ্গে পূন্যবান এবং সফলকাম সাহিত্যিক হবে বলে আমি মনে করি। কেননা, এই জীবনটি এমন একটি জীবন যেখানে ঔদার্য্য আছে, সান্তনা আছে, বরাভয় আছে এবং পরিচ্ছন্নতা ও পরিশুদ্ধতার জন্য দিকনির্দেশনা আছে। আমি এই গ্রন্থ রচনা করে শান্তি পেয়েছি। আমি আপনাকে এই পথে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আমি আধুনিক যুক্তিবাদি মানুষ, কিন্তু আমি রাসুলের জীবন কথা লিখতে গিয়ে আমি আবেগে চঞ্চল হয়েছি। মনে হয়েছে আমি যেন অলৌকিকের দ্বার প্রান্তে পৌঁছেছি। পৃথিবীতে কত মহাপুরুষ এসেছেন এবং চলে গেছেন কিন্তু রসুলে খোদা (স.) এমন একজন পুরুষ যাঁর নাম উচ্চারণের সাথে সাথে গাছের পাতা সবুজ হয়ে কেঁপে উঠে, বাতাস প্রবাহিত হয় পৃথিবীর এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে এবং একটি স্নিগ্ধ বরাভয়ে মানুষ আশ্বস্ত হয়’। সু-পণ্ডিত এবং আধুনিক শিক্ষায় সু-শিক্ষিত যয়নুল আবেদিন রায়নুমার উপরুক্ত কথাগুলো মণীষী সৈয়দ আলী আহসানের ভাল লেগেছিল। তিনি একসময় ওমরা পালনের ইচ্ছা করেন এবং হারাম শরীফে প্রবেশ করে প্রার্থনা করেন ‘আমি আজ তোমার করুণা প্রার্থী হয়ে তোমার সান্নিধ্যে এসে উপস্থিত হয়েছি, আমার প্রার্থনা এই আমি জ্ঞাত এবং অজ্ঞাত সারে যে সমস্ত পাপ করেছি এবং যে সমস্ত স্খলন এড়াতে পারিনি সেগুলো থেকে আমাকে মুক্ত কর, আমার কর্মকে সঠিক কর, আমার অন্তরকে পবিত্র কর, আমার ভবিষ্যৎকে আলোকিত কর এবং আমাকে শুভ ও কল্যাণের প্রকষ্ঠে উপস্থিত কর। প্রার্থনার পর পরই আমার মনে একটি ইচ্ছা সুদৃঢ় হলো যে, আমাকে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর একটি জীবনী লিখতে হবে। আমি তাই সর্ব মুহূর্তে এট ভাববার প্রয়াস পেলাম যে, আমাকে যেভাবেই হোক আমার নিজের প্রয়োজনে গ্রন্থ রচনায় হস্তক্ষেপ করতেই হবে।’

 

বাংলা ভাষায় রসুলে আকরাম (স.)-এর জীবনী ইতঃমধ্যে অনেক রচিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটা চমৎকার হয়েছে আবার কোনো কোনোটা তেমন আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি। সবগুলো মিলে বাংলা ভাষায় রাসূলে আঁকরাম (স.)-এর জীবনীগুলো মোটামোটি একটা বৃহৎ সংখ্যা দাঁড়িয়ে গেছে। নানা পণ্ডিত-জ্ঞানির নানান দৃষ্টিভঙ্গিতে রচিত গ্রন্থগুলোয় রাসূলে আঁকরাম (স.)-এর জীবনের সামগ্রিক একটা রূপ তৈরি হয়ে বাংলাভাষী পাঠক পাঠিকার জ্ঞান তৃষ্ণার খানিকটা হলেও মিটানো সম্ভব হয়েছে। সর্বোপরি আধুনিক বাংলা গদ্যের চমৎকার একটা কুশলী ব্যবহার উপস্থাপনার মাধ্যমে রাসূলে আঁকরাম (স.)-এর জীবনের প্রধান প্রধান দিকগুলোর বিশ্বস্ত প্রমাণ সম্বলিত ঐতিহাসিক বর্ণনা লিপিবদ্ধ করবার একটা প্রয়াস আমরা মনীষী সৈয়দ আলী আহসানের ‘মহানবীর’ ভিতরে লক্ষ্য করি। একটি মহান জীবন এবং প্রজ্ঞার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে তিনি এই গ্রন্থটি লিপিবদ্ধ করেন।

‘মহানবী’ লিপিবদ্ধ করতে যেয়ে রসূলে আকরাম (স.)-এর উপর বাংলা ভাষায় লিখিত তার পূর্বের এবং সমকালের লেখক সাহিত্যিকবৃন্দের অনুকরণ কিংবা অনুসরণ কোনোটাই গ্রহণ না করে সম্পূর্ণ নিজস্ব এক চমকপ্রদ এবং অত্যাধুনিক বাংলা গদ্যের শৈলীকে অবলম্বন করেছেন। তার বক্তব্য যেমন মনোজ্ঞ ধারালো তেমনি সত্যনিষ্ঠ। ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহ বর্ণনায় তিনি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য তথা মাধুর্য মণ্ডিত ভাষা ব্যবহারের সাথে সাথে অভিনব শব্দ ও বাক্যে বক্তব্যকে আকর্ষণীয় করে তুলতে প্রয়াসী হয়েছেন। এমন সুন্দর এবং অতীব নতুনত্বের ভাষা ভঙ্গি বর্তমান বাংলা গদ্যে সচরাচর দেখতে পাওয়া দুর্লভ। যেহেতু তিনি একজন আধুনিক কবি কিন্তু তার গদ্যে কবির কাব্য কুশলতার পরিবর্তে চমৎকার ও অভিনব গদ্যের একটি নিদর্শন আমরা প্রত্যক্ষ করি। যা একজন কৃতি গদ্য শিল্পীর অনবদ্য অবদানকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।

তাঁর এরূপ ভাষা শৈলী তাঁর নিজেরই আবিষ্কার। যা কারো দ্বারা প্রভাবজ কিংবা প্রভাবান্বিত নয়। দীর্ঘ কালের চর্চা এবং বিপুল পঠন পাঠনে তাঁর এ ভাষা রূপ তৈরী হয়েছে। যা তাঁকে চিনিয়ে দেয় তাঁর স্বতন্ত্র সত্তাকে। তাঁর নিজস্ব পথ পরিক্রমণকে।
তিনি বলেন: মহনবীর জীবন কথা রচনায় আমার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আত্মশুদ্ধি। শিক্ষিত সমাজের কাছে পাঠযোগ্য সাহিত্যের সংরাগ যুক্ত গ্রন্থ উপহার দেয়া। বিভিন্ন দুদর্শা থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে হলে এবং সত্য ও পরিচ্ছন্নতার মধ্যে জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে মহানবীর জীবন কথা জানা প্রত্যেক মানুষের জন্য অপরিহার্য।

মনীষী সৈয়দ আলী আহসান রসূলে আকরাম (স.)-এর একটি পাঠ যোগ্য সাহিত্যের স্বাদ যুক্ত অত্যন্ত মানসম্পন্ন গ্রন্থ উপহার দেয়ার যে উদ্দেশ্য তাঁর ছিলো তা পুরোপুরি পালন করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রথম পরিচ্ছেদ থেকে শুরু করে সর্বশেষ চতুর্বিংশ  পরিচ্ছেদ পর্যন্ত তাঁর যে লেখার ধারাবাহিকতা তাতে লক্ষ্য করা যায়-তিনি তাঁর রচনা শৈলী এবং ঘটনা ও কাহিনী বর্ণনায় চমৎকার সাবলীল ও নির্ভার গদ্যের মাধ্যমে পাঠককে ধরে রেখে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন।

ঘটনা সংঘাত সংঘর্ষের পরম্পরা রক্ষা করে কাহিনী এগিয়ে যাচ্ছে। পাঠক চিত্ত শিহরিত হচ্ছে। কিন্তু ক্লান্তি তাকে স্পর্শ করছেনা। বরং সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সবিশেষ উৎসাহিত করছে। একটা অনন্য আকর্ষণীয় গদ্য ভঙ্গির মধ্যে পাঠকের চিত্ত আপ্লুত হচ্ছে এবং শিহড়িত হতে হতে মুগ্ধতার মধুরসে নিজেকে ধীরে ধীরে ডুবিয়ে দিচ্ছে। আনন্দিত ও শিহড়িত হৃদয়ে মহানবীর চমৎকৃত জীবন কথায় বিমুগ্ধ হয়ে নিজেকে ধন্য করছে।

এমন বিরল গদ্যের সংস্পর্শে তার আত্মা বিগলিত হয়ে রাসূলে আকরাম (স.)-এর প্রতি পাঠকের হৃদয় সত্তা শ্রদ্ধাবনত হচ্ছে এবং তাঁর আদর্শের আলোকে নিজের জীবনকে গড়ে তুলবার অঙ্গিকারে আবদ্ধ হচ্ছে। যে জীবন মানুষকে অভিভূত করে, যে জীবন বিধাতার নিকট আত্মসমর্পনের একটি অলৌকিক পরিচয় বহন করে পাঠকচিত্তকে তৃপ্ত ও বিমোহিত করে তুলছে, যে জীবন সকল মানবের কল্যাণে সব সময়ের জন্য নিয়োজিত সেই জীবনের একটি মনোজ্ঞ আলেখ্য ‘মহানবী’ গ্রন্থটি।

আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মহানবীতে লক্ষ্য করা যায়, পাশ্চাত্যের বিভিন্ন লেখকরা রাসূলে আকরাম (স.)-এর চরিত্র এবং বিভিন্ন কর্মকান্ড সম্পর্কে যে বিরুপ আপত্তিকর, কুৎসিত মন্তব্য ও বক্তব্য তাদের রচিত গ্রন্থগুলোতে উচ্চারণ করেছেন, সেববের যুৎসই জবাব এবং অকাট্য যুক্তি দিয়ে নস্যাৎ করবার একটি বলিষ্ঠ প্রয়াস চালানো হয়েছে। অত্যন্ত শক্তিশালী যুক্তির সাহায্যে ঐসমস্ত লেখকদের ভুল ধারনা অপনোদনের চেষ্টার সাথে সাথে মোক্ষম জবাব প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

 

মনীষী সৈয়দ আলী আহসান শুধু ইংরেজি কিংবা বাংলা সাহিত্যের ছাত্রই ছিলেন না-ইসলামি জ্ঞান বিদ্যায়ও ছিলেন অত্যন্ত পারদর্শী এবং সু-পণ্ডিত। যে কারণে তিনি পাশ্চাত্য ও প্রতীচ্য এবং প্রাচ্যবিদনামক এক দল এক চোখা হরিণের ন্যায় কলমজীবী-গ্রন্থ প্রনেতাদের নানারূপ কুৎসা মতলববাজী লেখালেখীর সু-চিন্তিত ও সর্ব মহলে গ্রহণযোগ্য মতামত দিয়ে মিথ্যাচার মুলোৎপাটনের প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। মণীষী সৈয়দ আলী আহসান শুধু প্রাচ্যের নয় প্রতীচ্যেরও অনেক বিষয়ের সুপ-িত ছিলেন। পাশ্চাত্যের নানা দেশ-জাতির সভ্যতা সংস্কৃতি, সাহিত্য এবং ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে ছিলেন প্রগাঢ় অভিজ্ঞ। তাঁকে তো বাঙ্গালকে হাইকোট দেখানোর সাথে তুলনা করা যাবে না। তাঁকে তো সাত অন্ধের হাতি দর্শনের উদাহরণ দেওয়া সঠিক হবে না। সর্বদিকে দিয়ে তিনি ছিলেন একজন আধুনিক জ্ঞানী-প্রাজ্ঞ মানুষ। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও চিন্তা চেতনার সাথে সংস্লিষ্ট একজন বিজ্ঞান মনস্ক মানুষ। এসব কারণেই ‘মহানবীতে’ গোঁজামিলের পরিবর্তে- গোড়ামীর বিপরীতে সর্বমহলে সর্বাধিক গৃহীত, সু-বিবেচিত মতামতের মাধ্যমে ইতিহাসের সত্য ঘটনার বিবরণ এসেছে একজন সত্যনিষ্ঠ, সত্যসন্ধানী প্রজ্ঞাবান গবেষকের মত। ইতিহাসের ঘটনাকে গোপন কিংবা এড়িয়ে যাওয়ার সামান্য তম প্রয়াস আমরা মহানবীতে প্রত্যক্ষ করিনি। বরং গ্রন্থের ছত্রে ছত্রে এবং বিভিন্ন অধ্যায়ে-অধ্যায়ে তিনি যে এই সংক্রান্ত বির্তকিত বিষয়ে সু-চিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেছেন তাতে উভয়কুল রক্ষা পেয়েছে। কোনো পক্ষই বিক্ষুদ্ধ না হয়ে বরং এ গ্রন্থে গৃহীত তাঁর মনোভাব ও কৌশলকে সকলে সাধুবাদ জানাতে কারপন্য করবেন বলে প্রতীয়মান হয় না। ##

 

ড. সাইয়েদ মুজতবা আহমাদ খান

সাবেক সহকারী অধ্যাপক, দৌলতখান সরকারি আবু আব্দুল্লাহ কলেজ

দৌলতখান, ভোলা। ০১৭১২৯৮৪০৯৬

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *