ইখতিয়ার উদ্-দ্বীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খীলজীর সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড: একটি ইতিহাসভিত্তিক বিশ্লেষণ

ড. মোহাম্মদ মুহিবউল্যাহ ছিদ্দিকী

. ভূমিকা
এ পর্যন্ত প্রাপ্ত সমাজবিজ্ঞানীদের প্রদত্ত সংস্কৃতি সম্পর্কিত সংগাসমূহ ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, সংযোজন ও বিয়োজন করে আমরা একটি অনুসিদ্ধান্তে উপনীত হতে সক্ষম হয়েছি এবং তা হলো ‘সংস্কৃতি হচ্ছে মানব সৃষ্ট কর্মকান্ডের যোগফল যা সে উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছে এবং যা তার বিশ্বাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত’। অতএব সে মতে ইখতিয়ার-উদ্বীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজী কতৃক সৃষ্ট সকল কর্মকান্ড যা তার বিশ্বাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত তার সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মধ্যে গণ্য করা যেতে পারে। আলোচ্য প্রবন্ধে একটি ঐতিহাসিক পটভূমির প্রেক্ষাপটে বখতিয়ার খলজীর প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ; তাঁর সর্বভৌমত্বের প্রতীক-খোৎবা ও মূদ্রা; মুসলিম সমাজের ভিত্তি- মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকাহ প্রতিষ্টা; মুসলমানদের মৌলিক কাজ- দ্বীনের প্রচার ও প্রসার সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিসরে উপস্থাপনের প্রচেষ্টা করা হয়েছে।

.পটভূমি
উত্তর আফগানিস্তানের গরমশির [আধুনিক দস্ত-ই-মার্গ] এলকার বাসিন্দা ইখতিয়ারউদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী তুর্কি জাতির খলজ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। গজনীতে তিনি তাঁকে সৈনিক হিসেবে তালিকাভুক্ত করার জন্য মুহম্মদ ঘুরীর আজির-ই-মালিকের নিকট আবেদন করেন। কিন্তু খর্বাকৃতি ও বাহুদ্বয় হাটুর নিচ পর্যন্ত লম্বা হওয়ার কারণে তাঁর আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়। ভগ্নমনোরথ হয়ে বখতিয়ার অত:পর দিল্লির দিকে অগ্রসর হন এবং কুতুবউদ্দীন আইবকের অধীনে চাকরি প্রার্থী হন। কিন্তু সেখানেও তাঁর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো না। এরপর তিনি বদউনে চলে যান এবং সেখানে তিনি মালিক হিজবরউদ্দীন কর্তৃক একটি নিুপদে নিযুক্ত হন। অল্পকাল পরেই তিনি বদাউন পরিত্যাগ করে অযোধ্যায় উপস্থিত হন। এখানে তিনি শাসনকর্তা মালিক হুসামউদ্দীনের অধীনে তাঁর যোগ্যতার উপযোগী একটি চাকরি লাভ করেন। তাঁকে মির্জাপুর জেলার ভাগওয়াত ও ভিউলী নামে দুটি পরগনার জায়গির প্রদান করা হয়। শীঘ্রই প্রচুর সংখ্যক দু:সাহসী ভাগ্যান্বেষী খলজীর সাথে যোগ দেয়। বখতিয়ার তাদের সাহায্যে একটি শক্তিশালী বাহিনী গড়ে তোলেন।

১২০৩ খ্রিষ্টাব্দে বখতিয়ার খলজী বিহার আক্রমণ করেন এবং সে স্থান দখল করে প্রচুর ধন-সম্পদসহ প্রত্যাবর্তন করেন। অতপর তিনি কুতুবউদ্দীন আইবকের সাথে সাক্ষাৎ করেন তাঁকে বহুমূল্যবান উপহার প্রদান করেন। অত:পর বখতিয়ার খলজী বাংলার দিকে তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। ১২০৪-০৫ খ্রিষ্টাব্দে শীতকালে তিনি তাঁর দু:সাহসী অভিযান শুরু করেন এবং ঝাড়খণ্ডের দুর্গম অরণ্যাঞ্চলের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে এত দ্রুতগতিতে নওদীয়াহর দিকে ধাবিত হন যে, তাঁর সাথে মাত্র আঠারোজন অশ্বারোহী সৈন্য তাল রেখে আসতে পেরেছিল। নগরবাসীরা তাঁকে ঘোড়া ব্যবসায়ী বলে মনে করেছিল। বখতিয়ার খলজী অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে রাজপ্রাসাদ দখল করেন। রাজা লক্ষ্মণ সেন নগ্নপদে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যান। ইতোমধ্যে বখতিয়ার খলজীর মূল বাহিনীও এসে পড়ে এবং নওদীয়াহ তাঁর অধিকারে আসে।

বখতিয়ার খলজী স্বল্পকালীন সময়ের জন্য নওদীয়াহয় অবস্থান করেন এবং পরে তিনি গৌড়ের [লখনৌতি] দিকে যাত্রা করেন। তিনি ৬০১ হিজরিতে [১২০৫ঈ.] বিনা বাধায় গৌড় জয় করেন এবং সেখানে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন। অত:পর তিনি পূর্বদিকে অগ্রসর হন এবং উত্তর বাংলায় তাঁর অধিকার বি¯তৃত করেন।

. প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস
রাজনৈতিক সংস্কৃতির মূখ্য অধ্যায় হলো প্রশাসনিক বিভাজন। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. সর্বপ্রথম মুসলিম রাজ্যকে প্রশাসনিক সুবিধার্থে ৮টি প্রদেশে ভাগ করেন এবং প্রতিটি প্রদেশকে জেলায় বিভক্ত করেন। প্রতিটি প্রদেশে প্রাদেশিক শাসনকর্তা বা ওয়ালী এবং প্রতিটি জেলার জেলাপ্রশাসক বা আমিল নিয়োগ করেন। প্রাদেশিক ও জেলা প্রাশাসনের সাথে পৃথক বিচার ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য উভয় স্তরে কাযী নিয়োগ করেছিলেন। বখতিয়ার খলজী হলেন হযরত উমর ইবনুল খাত্ত্বাবের রাজনীতিক সংস্কৃতির উত্তরাধিকার। তাই তিনি তার নব বিজিত অঞ্চলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষে কয়েকটি প্রশাসনিক এককে বিভক্ত করেন। তখন সে সময়ে শাসনতান্ত্রিক বিভাগকে ইক্তা এবং ইকতার শাসনকর্তাকে মোক্তা বলা হতো।

মীনহাজ-ই-সিরাজের বর্ণনা গভীরভাবে নীরিক্ষা করলে প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে বখতিয়ার খলজীর প্রতিষ্ঠিত লক্ষনৌতি রাজ্য পূর্বে তিস্তা ও করতোয়া নদী, দক্ষিণে পদ্মা নদী, উত্তরে দিনাজপুর জেলার দেবকোট হয়ে রংপুর শহর পর্যন্ত এবং পশ্চিমে তার পূর্ব অধিকৃত বিহার পর্যন্ত বি¯তৃত ছিল। সম্ভবত: লখনৌতি রাজ্যে তিনটি মুকতা বা প্রদেশ ছিলো-
১. ‘বরসৌল’ ইকতা কে বর্তমান দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত ঘোড়াঘাট এলাকাকে নির্দেশ করা যায়, কারণ এটি রংপুর দিনাজপুর ও বগুড়া-এ তিন জিলার মিলনস্থলে অবস্থিত। বখতিয়ার খীলজী তাঁর সেনাপতি মালিক আলী মর্দান খীলজীকে অত্র এলাকার মুকতা নিয়োগ করেন।
২. গঙ্গাতরী ইকতা- ড. আবদুল করিম মনে করেন গঙ্গাতরীর নির্দেশকরণ এখনও সম্ভব হয়নি। কিন্তু ড. কালিকারঞ্জন কানুনগোর মতে- গঙ্গাতরী আইন-ই-আকবরীর তান্ডা সবকারের ‘গণকরা’ মহলের সঙ্গে অভিন্ন। বখতিয়ার খীলজী তাঁর অপর সেনাপতি মালিক হুসাম উদ্দীন ইওজ খীলজীকে এ ইকতার মুকতা নিয়োগ করেন। ৩. লখনৌরে ইকতা- বীরভূম জেলার নাগর অঞ্চল বর্তমানে রাজনগর নামে পরিচিত। বখতিয়ার খলজী তার বিশ্বস্ত সেনাপতি মালিক মোহাম্মদ শিরীন খলজীকে এ ইকতার মুকতা নিয়োগ করেন।

. সার্বভৌমত্বের প্রতীক: খোৎবা এবং মুদ্রা
ইসলামী সালতানাতের সার্বভৌমত্বের প্রতীক রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির মুখ্য উপাদান মূলত দুটো খুৎবা [জুমার নামাজের আগের বক্তৃতা] এবং ছিক্কা [মুদ্রা]। মীনহাজ লিখেছেন- ‘যখন মোহাম্মদ বখতিয়ার ঐ রাজ্য অধিকার করেন [তখন তিনি] নওদীয়াহ নগর ধ্বংস করেন এবং লখনৌতি নামক স্থানে রাজধানী স্থাপন করেন। সিই রাজ্যের [চতুম্পাশ্বস্থান] অঞ্চল তিনি অধিকার করেন এবং সমগ্র অঞ্চলে খুৎবা ও মুদ্রার প্রচলন করেন।’ মীনহাজের বর্ণনা এতই সংক্ষিপ্ত এবং সুস্পষ্ট যে তার থেকে খোৎবা এবং মুদ্রার প্রচলন সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা লাভ করলেও একটি মৌলিক প্রশ্নের জন্ম দেয় এবং তা হলো বখতিয়ার খীলজী কার নামে খোৎবা পাঠ করেন এবং কার নামে মুদ্রা অঙ্কন করেন?

ইতোমধ্যে এসকল প্রশ্নের উত্তর ইতিহাসবিদদের মধ্যে স্পষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে বৃটিশ মিউজিয়ামে বখতিয়ার খলজীর একটি স্বর্ণ মুদ্রা সংরক্ষিত আছে। উক্ত মিউজিয়ামের মুদ্রা গবেষক এন এম লওয়ার্ক সে মুদ্রাটি প্রথম প্রকাশ করে এবং তাতে কিছু অস্পষ্টতা থেকে যায়। পরবর্তীকালে ড. পি এল গুপ্ত ১৯৭৫-৭৬ সনে সে মুদ্রাটি Journal of the Varenda Research Museum vol. 4. pp. 29-34 প্রকাশ করেন। প্রখ্যাত মুদ্রা বিশেজ্ঞ ড. পি এল গুপ্ত মুদ্রাটির নিুরূপ বিবরণ প্রদান করেছেন-
প্রথম পিঠ:    একটি বৃত্তের ভিতর বল্লম হাতে একজন অশ্বারোহী এবং বৃত্তের বাইরে চারদিকে প্রথমে আরবী অক্ষরে ‘১৯শে রমজান ৬০১ হিজরী’ এবং পরে নাগরী অক্ষরে ‘গৌড় বিজয়ে’ লিখা।
অন্যপিঠে:    আরবী অক্ষরে ‘সুলতান উল-মুয়াজ্জম মুঈজ উদ্-দ্বীন মোহাম্মদ বিন সাম’ লিখা।
মুদ্রায় সুলতান মুঈজ উদ-দীন মোহাম্মদ বিন সাম অর্থাৎ মোহাম্মদ ঘুরীর নামাঙ্কিত কিন্তু ‘গৌড় বিজয়ে’ কথাগুলি লিখিত আছে সেহেতু ড. পি এল গুপ্ত মনে করেন যে মুদ্রাটি মুহাম্মদ বখতিয়ার খীলজী গৌড় বিজয়ের পরে তার প্রভুর নামে গৌড় বা লৌখনতি হতে জারি করেন; মুঈজ উদ্দীন মোহাম্মদ বিন সাম কখনও গৌড়ে আসেননি। অতএব মীনহাজের বর্ণিত মুদ্রার প্রচলন সম্পর্কিত জটিলতার অবসান হল।

এখন প্রশ্ন হলো মোহাম্মদ বখতিয়ার কার নামে খোৎবা পাঠ করতেন? খুব সহজ সরল উত্তর হচ্ছে সর্বভৌমত্বের সংস্কৃতিতে যার নামে মুদ্রা অঙ্কন করা হয়েছে তার নামেই খোৎবা পাঠ করা স্বাভাবিক সমীকরণ। কিন্তু মুসলিম জগতের খলিফা আব্বাসীয় খলিফার নামে, সুলতান কুতুব উদ্দিনের আইবকের নামে অথবা বখতিয়ার খীলজী নিজের নামে খোৎবা পাঠ করার সম্ভাব্যতা ইতিহাসবিদেরা তাদের ধারনা থেকে সম্পূর্ন বাদ দেননি।

দিল্লীর সুলতানদের শাসননীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো বাগদাদের আব্বাসীয় খিলাফতের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন। কারণ মুসলিম আইন বিশারদের মতে সারা মুসলিম জাহান এক এবং অবিভাজ্য এবং একজন খলিফা দ্বারা শাসিত হবে। খলিফা মুসলিম জগতের রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় প্রধান হিসেবে পার্থিব ও অপার্থিব কল্যাণের উৎস। খলিফার অনুমতি ছাড়া মুসলিম জগতের কোথায়ও কোন স্বাধীন রাষ্ট্রের উৎপত্তি এবং অবস্থান সম্পূর্ণ অবৈধ। পরবর্তীকালে আব্বাসীয় খিলাফতের দুর্বলতার সুযোগে খিলাফতের ভৌগোলিক সীমানায় যে সকল মুসলিম রাজবংশের উৎপত্তি হয়েছিলো তারা সকলে আব্বাসীয় খিলাফতের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতো। এ সকল প্রান্তিক স্বাধীন মুসলিম সুলতানগণ খলিফার দরবারে উপঢৌকনসহ দূত প্রেরণ; তাদের মুদ্রিত মুদ্রায় তাদের নামের সাথে খলিফার নাম অঙ্কিতকরণ এবং জুমার নামাজের খোৎবায় খলিফার নামের সাথে তাদে নাম পাঠ করে খলিফার প্রতি অনুগত্য প্রকাশ করতেন। আব্বাসীয় খলিফাগণ ও এসকল স্বাধীন সুলতানদের আনুগত্য প্রদর্শনে মুগ্ধ হয়ে তাদেরকে বৈধ সুলতান হিসেবে স্বীকৃতি দিতেন। তাদের জন্য সনদ ও খিলাৎ প্রেরণ করতেন। এমনিভাবে আইনত; দিল্লীর সালতানাত আব্বাসীয় খিলাফতের অংশ ছিল। গজনভীর সুলতান, এমন কি সুলতান মুঈজউদ্দীন মোহাম্মদ ঘুরী এবং তার বংশধরগণ আব্বাসীয় খলিফার আনুগত্য স্বীকার করতেন।

সে যুগে প্রচলিত মুসলিম জাহানের রীতি অনুসারে দিল্লীর সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা কতুবউদ্দিন আইবক তাঁর প্রভু মঈজউদ-দীন মুহাম্মদ ঘুরীর মৃত্যুর ৩মাস পর ১২০৬ ঈ. দিল্লীর সালতানাতে অধিষ্ঠত হয়ে বাগদাদের আব্বাসীয় খিলাফতের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন। তবে সরাসরি স্বীকৃত লাভ করতে সক্ষম হননি। বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফা আবু জাফর মনসুর আল মুনতাসির বিল্লার দূত ১২২৯ ঈ. সুলতান ইলতুৎমিরের জন্য খলিফার সনদ অর্থাৎ স্বীকৃতিপত্র এবং খিলাৎ [সম্মানসূচক পোষাক] নিয়ে দিল্লীতে আসেন। ফলে দিল্লীর সালতানাত দার-উল-ইসলামের অংশ এবং সুলতান খলিফার বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে পরিগণিত হয়।

গজনভীর সুলতান মুঈজ-উদ-দীন মোহাম্মদ বিন সাম খুৎবায় নিজের নামের সাথে আব্বাসীয় খলিফার নাম উল্লেখ করতেন। যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন ততদিন দিল্লীর সুলতান কতুবউদ্দিন আইবেক তাঁর নামে খোৎবা পাঠ করেন। তার মৃত্যুর পর কতুবউদ্দিন আইবেক নিজের নামে খোৎবা পাঠ করেন। বখতিয়ার খীলজী বেঁচে থাকতে যেহেতু আইবেক নিজের নামে খোৎবা পাঠ করেননি সেহেতু বখতিয়ার খীলজী আইবেকের নামে খোৎবা পাঠের প্রশ্ন আসে না। দ্বিতীয়ত: বখতিয়ার খিলজী বেঁচে থাকতে ভারত দার-উল-ইসলামের অংশ হিসেবে আব্বাসীয় খলিফাদের নিকট থেকে স্বীকৃতির প্রচেষ্টাও করা হয় নাই। তাই বখতিয়ার খলজী আব্বাসীয় খলিফাদের নামে খোৎবা পাঠের সম্ভাবনা থাকে না। তৃতীয়ত: বখতিয়ার খলজীর তিব্বত অভিযান ব্যর্থ হলে দেওকোট পৌঁছে অত্যাধিক মানসিক যন্ত্রনায় রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। সে মৃত্যুর শয্যা সম্পর্কে মীনহাজ লিখেছেন- ‘সেই বিপদের সময়ে তার মুখ থেকে অধিকাংশ সময়ে উচ্চারিত হতো সুলতানে-ই-গাযী মঈয-উদ-দুনিয়া-ওয়াদ-দীন মোহাম্মদ সাম এর কী এমন কোন বিপদ ঘটেছে যে আমার ভাগ্য আমাকে পরিত্যাগ করেছে। তখন এমন কি ঘটেছিল যে, সে সময়েই সুলতান-ই-গাযী [তার সারাহ] শাহাদৎ বরণ করেন’। এ বক্তব্য থেকে এ কথা প্রমানিত হয় যে বখতিয়ারখীলজী সুলতান-ই-গাজী মুঈজ-উদ্দিন মোহাম্মদ বিন সামের প্রতি পূর্ণ অনুগত ছিলেন। মোহাম্মদ বখতিয়ার খীলজী তার এ চরম দু:সময়ে মোহাম্মদ ঘুরীর কাছ থেকে সাহায্য চেয়েছিলেন অথবা সাহায্যের আশা করেছিলেন, না সুলতানের শুভেচ্ছাই তার বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার পক্ষে যথেষ্ট তা সুস্পষ্ট নয়। বারবার এ উক্তির উচ্চারণ এ কথা প্রমান করে যে মোহাম্মদ বখতিয়ার খীলজী সুলতান মোহাম্মদ ঘুরীর অনুগত এবং øেহপুষ্ঠ ছিলেন। সুতারাং তার নামেই খোৎবা পাঠ করাই খুব স্বাভাবিক ছিল। চতুর্থত: উপরে আলোচিত বখতিয়ার খীলজীর অঙ্কিত মুদ্রায় নিজের নাম বাদ দিয়ে মুহাম্মদ ঘুরীর নাম প্রকাশ এবং গৌড় বিজয় কথা দ্বারা অনুমিত হয় যে বিজিত অঞ্চল মোহাম্মদ ঘুরীর রাজ্যে ছিল। তাই বখতিয়ারের বিজিত অঞ্চলে পাঠিত খোৎবা মুঈজ-উদ-দীন মুহাম্মদ বিন সামের নামে পাঠ করা হতো বলে ইতিহাসতাÍিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ায় যায়।

. মুসলিম সমাজের ভিত্তি: মসজিদ, মাদরাসা, খানকাহ প্রতিষ্ঠা

মীনহাজ-ই- সিরাজ অত্যান্ত সুষ্পষ্ট করে লিখেছেন ‘ঐ অঞ্চল সমুহে [অসংখ্য] মসজিদ, মাদরাসা ও খানকাহ তার এবং তার আমিরদের প্রচেষ্টায় দ্রুত ও সুন্দরভাবে নির্মিত হয়।’  বখতিয়ার খীলজী লৌখনতী রাজ্যের রাজধানীতে, তার আমীরগন ইকতার [প্রদেশের] সদর দপ্তরে এবং অন্যান্য খলজী মালিকগন গুরুত্বপূর্ন স্থানে মুসলমানদের নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদ, মুসলমানদের সন্তানদের সুশিক্ষার জন্য মাদ্রাসা এবং সূফীদের দ্বারা নওমুসলিমদের ইলমে দ্বীন শিক্ষা দেয়ার জন্য খানকা প্রতিষ্ঠা করেন। শাসনতান্ত্রিক পুন:বিন্যাসের পর তিনি মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা করেন। মুসলিম সমাজের নিউক্লিয়াস বা কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে মসজিদ। মুসলমানেরা যেখানে গিয়েছে সেখানেই প্রথমে মসজিদ প্রতিষ্টা করেছে। যে সকল মুসলমান অভিযান পরিচালনার সময়ে অথবা তার পরে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য লখনৌতে আগমন করে তাদের সুবিধার জন্য তিনি মসজিদ, মাদরাসা ও খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন। এ প্রসঙ্গে ড. আবদুল করিম লিখেছেন, একজন সৈনিক হইয়াও বখতিয়ার খীলজী বুঝিতে পারেন যে, মুসলমান সমাজ প্রতিষ্ঠা ব্যতিত লখনৌতির মুসলমান রাজ্য শুধু সামরিক শক্তির উপর নির্ভর করিতে পারে না। সামরিক শক্তির প্রয়োজন একদিন শেষ হইবেই, কিন্ত অতপর, অর্থাৎ শান্তির সময়ে মুসলমান সমাজ- মুসলমান রাজ্যের স্থায়িত্ব বিধান করিবে’ আমাদের দেশের আবহাওয়া এবং আমাদের ইতিহাস অসচেতনতা ঐতিহাসিক নির্দশন দ্রুত নষ্ট অথবা ধ্বংস হয়ে যায়। যার কারণে বখতিয়ার খীলজির আমলের কোন স্থাপত্য নির্দশন আজও আবিষ্কৃত হয়নি।

. দ্বীন প্রচার: মুসলমানদের মৌলিক কাজ
বখতিয়ার খলজী যখন লখনৌতিতে আসেন তখন আব্বাসীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠিত ছিল। খিলাফতের প্রান্তিক রাজ্যসমূহের সম্প্রসারনে তখনও মূল কারণ দ্বীন- ই- ইসলাম প্রচার করা।  হিন্দু ও ইউরোপীয়রা যতই একে মাল-ই-গনীমতের লোভে পরিচালিত অভিযান বলে আখ্যায়িত করুক না কেন; মুসলিম সেনাপতিরা জিজিয়া দিতে সম্মত হয়েছে অথবা দ্বীন গ্রহণ করেছে এমন কোন রাজা বাদশাহর সাথে যুদ্ধ করেছে এমন প্রমাণ তারা দিতে পারবে না। সে জন্য প্রান্তিক রাজ্য বিজয়কে আব্বাসীয় খলিফা স্বীকৃতি প্রদান করতো; বিজয়ী সেনাপতিকে সনদ ও খিলাত দান করতো; সর্বোপরি বিজিত অঞ্চলকে দ্বার-উল-ইসলামের অংশ হিসেবে গ্রহণ করতো। তাছাড়া বিজয়ী সেনাপতি মাল-ই-গনীমত সংগ্রহ ও বন্টন করতো; জিজিয়া সংগ্রহ করতো; বখতিয়ার খিলজীর ক্ষেত্রে এ নীতির লংঘিত হয়নি।

উল্লেখিত প্রসঙ্গে মীনহাজ-ই-সীরাজ তিনটি তথ্য প্রদান করেছেন- ‘কোচ ও মেচ জাতির প্রধানদের মধ্যে একজন-যিনি আলী মেচ নামে পরিচিত হন- মোহাম্মদ বখতিয়ারের হস্তে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন এবং [তিনি মোহাম্মদ বখতিয়ারকে] পার্বত্য অঞ্চলে নিয়ে যেতে এবং পদ প্রর্দশক হতে সম্মত হন’।

‘মোহাম্মদ বখতিয়ার ঐ নদীর তীরে উপস্থিত হলেন এবং আলী মেচ মুসলিম সেনাবাহিনীর অগ্রভাগে ছিলেন। তিনি দশ দিন ধরে নদীর উর্ধ্ব মুখে সৈন্যদের চালিয়ে নিয়ে গেলেন।’’ [পৃ.-২৭]

‘মোহাম্মদ বখতিয়ার পানি থেকে বের হয়ে আসলে কোচ এবং মেচদের একদলের নিকট সংবাদ পৌছে গেল। পথ প্রর্দশক আলী মেচ তার আতœীয় স্বজনদের রেখে গিয়েছিলেন। তারা উপস্থিত হয়ে অনেক সাহায্য ও সেবা করলেন।’

কোচ এবং মেচ জাতির পরিচয় প্রদান করতে গিয়ে মীনহাজের অনুবাদক আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া লিখেছেন’ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত [উত্তর] অঞ্চলে বিশেষ করে, বৃহত্তর ও অবিভক্ত দিনাজপুর ও রংপুর জেলা সমুহে, বিহারের পুর্নিয়া জেলার কিয়দংশে ও অবিভক্ত আসামের পশ্চিমাঞ্চলে একটি পৃথক নবগোষ্ঠীর অস্তিত্ব দেখা যায়। চ্যাপটা নাক, উন্নত গন্ডাস্থি, বঙ্কিম চক্ষু, উদ্দন্ড কেশ এবং কেশ বিহীন দেহ, কেশ বিরল মুখমন্ডল এর অধিকারী এ নরগোষ্ঠী যে আদিতে মোঙ্গলীয় রক্তধারা থেকে উৎপন্ন তাতে কোন সন্দেহ নেই। অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার উত্তরাংশে এদের নিবাস অধিক পরিমাণে কেন্দ্রীভূত ছিল এবং এখনও আছে। রংপুর জেলার উত্তর-উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে আজও এদের ঘনবসতি দেখা যায়।’ মীনহাজের বর্ণনা  থেকে এটা সহজে ধারণা করা যায় যে- মেচ জাতির প্রধান আলী মেচকে বখতিয়ার খীলজী স্বয়ং দ্বীনের দাওয়াত দেন। সে দাওয়াত গ্রহন করে আলীমেচ এবং তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা, এমনকি তার মেচ জাতির বহু লোক বখতিয়ারের হাতে ইসলাম গ্রহন করেন। আলী মেচকে জোর করে বা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যে ধর্মান্তরিত করা হয়নি এবং আলী মেচ ও তার লোকেরা যে মোহাম্মদ বখতিয়ারের প্রতি অত্যন্ত আন্তরিকভাবে অনুগত ছিলেন তা সহজে বোঝা যায় বখতিয়ার খীলজীর চরম দুর্দিনে তাদের সাহায্যে ও সেবার দৃষ্টান্ত দেখে। বখতিয়ার খীলজীর প্রতি যদি তারা বিরূপ থাকতেন তবে তার সেই চরম অসহায় মুহূর্তে [অবস্থায়] ইচ্ছা করলে অতি সহজেই তার এবং তার সঙ্গীদের প্রাণনাশ করতে পারতেন; প্রতিশোধ নিতে পারতেন এবং তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসতেন না। এতে প্রমাণিত হয় যে আলী মেচ ও তার দলবলের সঙ্গে বখতিয়ার খীলজির একটা আন্তরিকতাপূর্ন দ্বীনি সম্পর্ক ছিল।

উপর্যুক্ত উদাহরণ যথেষ্ট যে বখতিয়ার খীলজী এবং তাঁর সঙ্গী সাথীরা লৌখনতি রাজ্যের রাজধানী ও প্রশাসনিক সদর দপ্তরে সাধারন মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত প্রদান করেছিলেন যার ফলে মেচ কোচসহ বহুজাতির দেশ আজ মুসলিম প্রধান দেশে পরিণত হয়েছে।

.উপসংহার
বখতিয়ারের ঘোড়া, ঢাল, তরবারী, বল্লম, তীর-ধনুসহ সকল অস্ত্র-সস্ত্রের সঠিক নমুনা না থাকলেও মীনহাজ সে সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারনা প্রদান করতে সক্ষম হয়েছেন।তাছাড়া ইতোমধ্যে আবিস্কৃত মুদ্রার একপীঠে বৃত্তের মধ্যে বল্লমধারী ঘোড়সওয়ারী সৈন্যর অঙ্কন তার সংস্কৃতিতে উন্নত সৈনিক জীবনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। তিব্বত অভিযান ব্যর্থতার পেছনে সমর নেতা হিসেবে তার কোন অযোগ্যতা প্রকাশ পায়নি বরং পাশ্ববর্তী রাজন্যবর্গের বিশ্বাসঘাতকতাই মূখ্য কারণ হিসেবে বিবেচ্য হয়েছে। এদেশীয় সামরিক কুটকৌশলের নিকট বখতিয়ার পরাজিত হয়ে দেবকোট ফিরে আসেন। এ দেবকোট হচ্ছে প্রাচীন ভারতের বরেন্দ্র অঞ্চলের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী ও জাকজমকপূর্ণ নগরী। দেবীকোট্ট, দেওকোট, দেবীকোট, উমাবন, উষাবন, কোটীবর্ষ, শোনিতপুর, বানপুর প্রভৃতি নামে এ নগরীর বর্ণনা যাদব প্রকাশের বৈজয়ন্তী, কল্পসূত্র, বিষ্ণুপুরান, শ্রীমৎ ভগবত, বায়ুপুরান এবং বৃহৎ সংহিতার মতো প্রাচীন গ্রন্থে পাওয়া যায়। এমন একটি নগরীকে রাজধানী হিসেবে নির্বাচন বখতিয়ারের উচ্চ ঐতিহ্যমন্ডিত সাংস্কৃতিক রুচিবোধ ও জ্ঞানের বহি:প্রকাশ। এখানেই বখতিয়ার ইনতেকাল করেন এবং এখানেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। এখনও তার সমাধিস্থলে দর্শনার্থীদের ভীড় লক্ষনীয়। এ দেবকোটে মাওলানা শাহ আতার সমাধি সৌধ রয়েছে যার দেয়ালে সংযুক্ত ৬৯৭ হিজরী [১২৯৭ঈ.] শিলালিপি বাংলার সুলতানী শাসনের প্রাথমিক যুগের গুরত্ব বহন করে। তাছাড়া সুলতান কায়কাউসের রাজত্বকালে [৬৯১-৭০২ হিজরী] প্রাদেশিক গর্ভনর জাফর খান বাহরাম আইতগীনের সময়ে মুলতানর সালাহউদ্দিন জিওয়ান্দের তত্বাবধানে একটি সমজিদ নির্মিত হয়। এসব তথ্য একথা প্রমাণ করে যে বখতিয়ারের প্রতিষ্ঠিত রাজধানী এবং সমাধিস্থল প্রাথমিক সুলতানী যুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ নগরী হিসেবে বর্তমান ছিল।

বখতিয়ার খলজী নওদীয়াহ ও লৌখনতি বিজয় করে বাংলার উত্তর প্রান্তে একটি মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। সে রাজ্যে তিনি মসজিদ, মাদরাসা ও খানকা প্রতিষ্ঠা করে মুসলিম সমাজের ভিত মজবুত করেছিলন; সে রাজ্যে তিনি মুসলিম রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতীক খোৎবা এবং মুদ্রার প্রচলন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সে রাজ্যে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ করে ওয়ালী, আমীল ও কাযী নিয়োগ দিয়ে একটি উন্নত প্রশাসন প্রবর্তন করেছিলেন। সে রাজ্যে দ্বীন ইসলাম প্রচার করে কোচ- মেচ সহ হাজার ধরণের অমুসলিমকে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে মুসলিম করেছিলন। এসবের সুফল আজ আমরা শতভাগ ভোগ করছি। অথচ বখতিয়ার খলজী এ প্রজন্মের কাছে অপরিচিত। তাই শুধু সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে নয়; বরং সর্বক্ষেত্রে বখতিয়ার খলজীর চর্চা প্রয়োজন; অতি প্রয়োজন। আগামী প্রজন্ম যেন বখতিয়ার খলজীকে সহজে চিনতে পারে সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় দায়িত্ব পালন করার জন্য সচেতন সুধী সমাজকে আহবান জানাই।

উৎস:
সাময়িকী, ০৩ এপ্রিল ২০১৬

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *