গল্প:  বিনীতা

প্রিন্স আহম

আঠারো শতকের শেষভাগের কোনো এক সময়, ব্রিটিশ ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে তখনও খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারেনি ব্রিটিশ সেনারা। নদী-জলাময় জান্নাতনগর-রায়গঞ্জ অঞ্চল থেকে বিতাড়িত হয়ে পার্বতীপুর রাজ্যই তাদের শেষ সীমা মেনে নিয়েছে ব্রিটিশসিংহরা। কিন্তু- বিতাড়িত হওয়ার আগে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অসংখ্য মানুষকে ধরে এনেছে পার্বতীপুরে, যারা গত দশ বছর একপ্রকার ক্রিতদাসের মতো ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মানে।

কাদেরও এমনই একজন বন্দী  যুবক, বয়স বিশ-বাইশ বছর হবে, শ্যামবর্ণ মাঝারি গড়নের শরীরটা পরিশ্রমের ফলে পেটা লোহার মতো যেমন শক্ত, মনটা তার তেমনই নরম আর দূর্বল! ভীতু কাদের এক প্রকার মেনেই নিয়েছে তার নিয়তিকে, তাই তার জীবনটা এই কাদার মতো নোংরায়ও পদ্ম ফুলের মতো সাবলীল। পরিশ্রম সে করে বাধ্য শ্রমিকের মতো। কিন্তু- কাদেরের এর চেয়ে বড় একটা গুণ আছে- সে বাঁশি বাজায়! সারাদিনের অমানুষিক পরিশ্রমের পর সবাই যখন মড়ার মতো ঘুমায়, শুধু শিমুলগাছের কাঁটায় বিঁধে থাকে দ্বিতীয়ার একলা চাঁদ, সেই মরা আলোয় কাদেরের বাঁশের আড় বাঁশিতে বেজে ওঠে কান্নার সূর! তার বাঁশি শুধু কাঁদতেই জানে না, সে বাঁশি অর্ফিয়াসের সূরের মতো মরা নদীতে জোয়ার তুলতে জানে- এই খবর জানে শুধু একজন! ঐ যে শিমুলের নিচে অন্ধকারের বুকে এক টুকরো আরো গভীর অন্ধকার হয়ে মিশে আছে বিনীতা, সে জানে এ বাঁশিতে প্রেম আছে ঝিনুকের বুকে মুক্তোর মতো! কিন্তু- অন্ধকারটা আজ যেন একটু উশখুশ করছে, না?

০২

বিনীতা রায়গঞ্জের রাজদরবারের অমর্ত্য সুরেন্দ্র ঠাকুরের ছোট মেয়ে। কালবৈশাখী থেমে গেলে আকাশের কোনে যেমন ঝাপসা কালো এক টুকরো মেঘ ঘুরে বেড়ায়, ঠিক তেমনই কাজলবর্ণা ছটফটে মেয়ে বিনীতা, বিনয়ের বালাই নেই তার মাঝে। রায়গঞ্জ থেকে ব্রিটিশ বাহিনী ফেরার পথে তাকেও উঠিয়ে এনেছিলো। স্বভাবে বিনীতার কোনো বদল আসেনি, কায়িক শ্রম সে করে কিন্তু কাশ্মীরি মরিচের মতো তার ঝালে, তার ছায়া মাড়াতেও সবাই দশ বার ভাবে। বিনীতার কেবল এ তল্লাটে একটাই দূর্বলতা, কাদের! বিনীতা আহামরি সুন্দর নয়, হলেও হয়তো কাদেরের কিছু আসতো যেত না- বাঁশি বাজালেইতো আর সবাই কৃষ্ণ হয় না! বিনীতার তাতে কিছু এসে যায় না, রোজ রাতে যখন কাদেরের বাঁশি বাজবে, ঠিক তার আগে শিমুলের তলে রাধা ঠিকই হাজির হয়। ক্যাপ্টেন উড সাহেব পার্বতীপুরের হর্তা-কর্তা, তার এ পরগনায় বন্দীদের যৌনহেনস্তা করা কঠোরভাবে নিষেধ হওয়ায় মদ্যপ লয়েড কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলো, কিন্তু- ইদানিং বিনীতার গভীর রাতে বাইরে আসা-যাওয়া, তাকে অতিশয় প্রসন্ন করেছে। আজ সুযোগ বুঝে বিনীতাকে আক্রমণ করে সে। একে বিনীতার পরিশ্রমের ফলে সমর্থ হাত, তার উপর প্রচণ্ড রাগ- মদ্যপ লয়েডের গলায় চুলের কাঁটা বিঁধিয়ে দিতে তার খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু- কাদেরের বাঁশি কানে যেতেই যে ভালোবাসা ফেনিয়ে উঠেছে তার অন্তরে, তাতে – লয়েডহত্যার বিচারের কথা মনে উঠে কেঁপে উঠে বিনীতা! এই শীতে শিমুলের তলে সে ঘেমে ভিজে ওঠে!

০৩

প্রকৃতি বড় খামখেয়ালি, কার সাধ্য তাকে বোঝে? কাদের, যে কখনও কাজে ফাকি দেয়নি, যে ছিলো সবচেয়ে ভীতু, সে পালিয়ে যাচ্ছে! তাও পালাচ্ছে একজন খুনির হাত ধরে! শিমুলের অন্ধকার থেকে ধীর পায়ে যখন বিনীতা এসে কাদেরের পাশে বসেছিলো, তার দুটি বড় বড় চোখে চিকচিক করে উঠেছিলো দ্বিতীয়ার চাঁদ, তখন- কে যেন কাদেরের কানেকানে বলছিলো ‘এ তোমার জন্মজন্মান্তরের বন্ধু’! বিনীতা কী বলেছিলো কাদের শোনেনি, শুধু শুনেছিলো, ‘যেতে হবে’ ! শান্ত কাদের, ভীতু কাদের – বিনীতার হাত ধরে উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলো- ‘চলো…’! কাদের কিছুই জানে না, কিছুই চিনে না- শুধু জানে- এই সত্য, এই সুন্দর, এই ভবিতব্য! পালানোটা যতটা সহজ ছিলো তাদের জন্য, পার্বতীপুর ছেড়ে যাওয়াটা ততোটা সহজ ছিলো না। জান্নাতনগর-পার্বতীপুরের সীমানায় সসস্ত্র ব্রিটিশ সেনারা টহলে থাকে, গুলি ছুড়তে ওদের অনুমতি লাগে না, অনুভূতি জাগে না। কাদেরের তাতে বিশেষ ভাবনা নেই, সে শুধু চেয়ে চেয়ে বিনীতাকেই দেখছে, কী একটা যাদু আছে মেয়েটার মধ্যে। রাতের মধ্যেই রায়গঞ্জেরর সাবেক বাসিন্দা এক দর্জির কাছ থেকে দুটি কম্বল আর রাতের খাবারও জোগাড় করে ফেলেছে সে, আশ্রয়টা আশ্রয়দাতাকে বিপদে না ফেললে হয়তো তারও ব্যবস্থা হয়ে যেতো। জান্নাতনগরের সীমানাঘেষে একটা দুর্গম বন আছে, সেখানেই আশ্রয় নেয় ওরা।

০৪

কাদেরের ঘুম ভাঙলো যখন, তখন সূর্য কেবল চোখ মেলছে আর সেই প্রভাত সূর্যকে দু’ হাত তুলে নমস্কার করছে বিনীতা। কাদেরের ওঠার সাড়া পেয়ে তার দিকে ফিরে সে বললো, ‘তুমি এখানেই থাকো, আমি এক গেরস্থকে চিনি- দেখি কিছু খাবার জোগাড় করা যায় কিনা!’ বিনীতা পার্বতীপুরের দিকে অদৃশ্য হতেই জঙ্গলের মধ্যে একটা গুমগুম শব্দ শুনে সে দিকে সন্তর্পণে এগিয়ে গেল কাদের। জঙ্গলটা যেখানে প্রায় দুর্ভেদ্য সেখানে অনেক মানুষ বিক্ষিপ্তভাবে বসে আছে, যেন ধ্যান করছে। হঠাৎ একটা শক্ত হাত পিছন থেকে কাদেরের চুলের গোছা চেপে ধরে-

– শালা, গোরার দালাল, মালাউন!

কঁকিয়ে ওঠে কাদের-

-ছাইড়া দ্যান… লাগতেছে তো! আমি মুসলমান, কারো দালাল না!

– নাম কী তর?

– কাদের, আবদুল কাদের।

– অহ্! তা এইহানে কী চাইস?

চুলের ওপর হাতটা আলগা হতেই ঘুরে তাকায় কাদের, ভয় পায়- অদ্ভুতদর্শন এক লোক মাথায় টুপি, গালভর্তি দাড়ি, চোখে সুরমা দেওয়া, পরনে পাঞ্জাবি। কাদের জানায় সে জান্নাতনগর, তার বাড়ি ফিরতে চায়। লোকটি জানায়- এখানে যারা আছে সবাই বন্দী হয়ে এ অঞ্চলে এসেছিলো, এখন- নিজের রাজ্যে ফিরতে সাধনা করছে- সিঁদুর, নরকঙ্কাল আর শ্মশানের মাটি দিয়ে! এ সাধনায় সিদ্ধি লাভ করলে যেকোনো জায়গায় যাওয়া যায়। কাদেরকে লোকটি প্রয়োজনীয় উপকরণ দিয়ে সাধনপদ্ধতি শিখিয়ে দেয়। দাড়ি-টুপি পরা মুসলিমরা এমন সাধনা করতে পারে, তা হয়তো কাদের স্বপ্নেও ভাবতে পারতো না কিন্তু- অবিশ্বাস সে করে না, সেও যে বিনীতাকে নিয়ে স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়। কোমরে যত্ন করে উপকরণগুলো গুজে রেখে লোকটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে আসে কাদের। তখনই- দৃষ্টিসীমায় দেখা যায় বিনীতাকে, কপালে চন্দনের ফোঁটা দেওয়ায় তাকে যেন অপ্সরার মতো লাগছে। এত অল্প সময়ে মেয়েটা তার এত আপন হল কিভাবে কাদের জানে না। অবাক ভালোবাসায় বিনীতার ঠোঁটে ফুটে ওঠা হাসিটার দিকে তাকায় কাদের আর ঠিক তখনি গুলির শব্দে মিলিয়ে যায় হাসিটা। জঙ্গলটা কেঁপে ওঠে একপাশে গুলির শব্দ আর অন্যপাশে আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে। জান্নাতনগরের মুসলিম যোদ্ধারা আক্রমন করেছে এ দিকটা। বিনীতা আর কাদেরের মধ্যে তখন মাত্র হাত দশেকের দূরত্ব, দু’জন দু’টি গাছের গুড়িতে ঠেস দিয়ে আছে, এমন সময় কিছুক্ষণ আগে পরিচয় হওয়া সাধক ছুটতে ছুটতে আসে, সে কাদেরকে ভোলেনি, কাদেরের হাত ধরে হ্যাচকা টান দিয়ে বলে, “চল, জান্নাতনগরে!” কাদের বিনীতার দিকে এগিয়ে যেতে চায়, সাধক ততক্ষণে বিনীতার কপালের চন্দনের ফোটা দেখেছে, সে হুঙ্কার দিয়ে ওঠে, “ওরা মালাউন, গোরার দালাল, ওরে নেওয়া যাইবো না!” কাদের ডুকরে ওঠে, “তোমার পায়ে পড়ি, ভাই! ও ছাড়া আমার আর কেউ নাই, ও মানুষ, মালাউন না, ওরে নিতে দ্যাও! ওরে ছাড়া আমি বাঁচমু না!” কাদেরের মিনতিতে মন গলে সাধকের, সে রাজি হয়, আর ঠিক তখনই- একটা গুলি এসে লাগে কাদেরের কাঁধে, জ্ঞান হারায় সে।

০৫

জ্ঞান ফিরতে চারিদিকে তাকায় কাদের, আশেপাশে কোলাহলের যেটুকু কানে যায়, সেটুকু শুনে বুঝতে পারে- সে জান্নাতনগরে আছে। কাঁধে প্রচণ্ড ব্যথা উপেক্ষা করে উৎসুক হয়ে আশেপাশের সবাইকে প্রশ্ন করে- ‘ও কই?, পাশ থেকে কৌতুহলি প্রশ্ন আসে, ‘কে কই?’ এই প্রথম কাদেরের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে হাতড়ে মরে শূন্যতায়, সে তো বিনীতার নামও জানে না, কখনও যে নাম ধরে খোঁজার মতো দূরে সরে যাবে তারা, তা তো কাদের দুঃস্বপনেও ভাবেনি। সবাইকে হা-করে তাকিয়ে থাকতে দেখে হঠাৎ-ই একটা শেষ আশার আলো দেখতে পায় সে, বলে- সাধক! সাধক কই? সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করে, এ নাম তারা এর আগে কখনও শোনেনি! একজন প্রাজ্ঞ মুরুব্বিগোছের লোক এগিয়ে এসে বলে, ‘এই নিয়া দুই দিন বেহুঁশ হইয়া রইছো, কিছু খাইয়া একটু ঘুমাও! ঘুম থেইকা উঠলে দ্যাখবা সব মনে পইড়া যাইবো!’ বিষণ্ণতায় ডুবে যাওয়া কাদের জানে- মনে পড়ার কিছু নেই, কিছুইতো ভোলেনি সে; সে শুধু হারিয়েছে! কোমরে হাত দেয় সে- এখনও সেই সাধনার উপকরণগুলো সেভাবেই আছে, এগুলো দিয়েইতো সে ফিরতে চেয়েছিলো স্বাধীন জীবনে, বিনীতাকে নিয়ে!

০৬

এর অনেক কাল পর পর্যন্ত জান্নাতনগরে পাগল-সাধককে সবাই এক নামে চিনতো; একমুখ দাড়ি আর কপালে চন্দনের ফোটা দিয়ে টুপি-পাঞ্জাবি পরে যে মন্ত্র-তন্ত্রের সাধনা করতো। কিসের যে সে অদ্ভুত সাধনা তা কেউ জানতো না… কেউ বলতো শয়তানপূজা, কেউ বলতো গুপ্তধনের সাধনা। কাদেরও জানতো না এ সাধনায় সিদ্ধ হলে সত্যিই যেখানে খুশি যাওয়া যায় কিনা, সে জানতো না এগুলোতে বিশ্বাস করতে হয় না! সে শুধু জানতো বিনীতা আছে, ভালোবাসা আছে; বিনীতাকে সে ভালোবাসে! বিনীতার কাছে তাকে পৌঁছুতেই হবে ।

 

প্রিন্স আহম

বাংলা বিভাগ (স্নাতকোত্তর), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মুঠোফোনঃ ০১৬৮৬১২০৬৩৯

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *