পরিবার থেকেও কেন পরিবারহীন শৈশব?

মাসুম মাহমুদ

বৃদ্ধাশ্রম সম্পর্কে কমবেশি সকলেই জানি কিন্তু আমরা কি কখনো সন্তান আশ্রমের কথা শুনেছি? আসুন আজকে এ বিষয়টি নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
সাধারণত পরিবারের উপেক্ষিত বয়োবৃদ্ধ সদস্যটিকে যখন সমাজ ও পরিবারের জন্য বোঝা হিসেবে মনে করা হয় অথবা সংসারের সকল অনিষ্টের মূল হিসেবে বৃদ্ধ সদস্যটিকে দায়ী করে অর্থের বিনিময়ে কিংবা সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত বয়োবৃদ্ধদের জন্য নির্দিষ্ট আশ্রমে পাঠানো হয় সেটিকে আমরা বৃদ্ধাশ্রম হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি।

অন্যদিকে পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্য অথবা ছোট সন্তানটিকে ধর্মীয় শিক্ষার্জন বা একটু বেশি দুষ্টুমি করার শাস্তি-স্বরূপ কিংবা উন্নত ক্যারিয়ার গঠনের উদ্দ্যেশ্যে বোডিং স্কুল, হেফজখানা, ক্যাডেট স্কুল, মিশনারী স্কুলগুলোতে পাঠানো হয় তাকে-ও পরোক্ষভাবে শিশু আশ্রম বলতে পারি।

একটু খোলাসা করা দরকার যে কেন এ বিষয়টি নিয়ে  কথা বলতে হচ্ছে! আমার ধারনা এই বিষয়টি নিয়ে জীবনের কোন একটি পর্যায়ে আমরা সকলেই চিন্তা করেছি কিন্তু সামাজিক অবস্থান ও ধর্মীয় প্রভাব ও অন্যান্য কারনে কোন সুসংবদ্ধ পদ্ধতিতে সমালোচনা করিনি। শিশু-কিশোরদের উচ্ছ্বাসপূর্ণ সময় কাটানোর সময়টিকে যখন চারদেয়ালের কপাটে বই-পুস্তক ও নিয়মশৃঙ্খলায় আবদ্ধ রাখা হয়, স্বর্ণসময়ের পুরোটা সময় মায়ের আঁচলের ছায়া বঞ্চিত করা হয় মনে মনে হয়তো প্রতিটি শিশুই তখন কবির গুরুর মতো গেয়ে ওঠে ”থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগতটাকে ” কেউ হয়তো কেবল মনের মধ্যেই নয় এই বিদ্রোহের সুর টেনে উন্মুক্ত করে পৃথিবীর সামনে যার বিভিন্ন অঘটনের শিকার হওয়ার হাজারো উদাহরণ সমাজে বিদ্যমান। এই শিশু আশ্রমের কারণে যে সকল সমস্যা তৈরি হতে পারে,

প্রথমত, শিশুর সামাজিকীকরণে বিরুপ প্রভাব বিস্তারের আশংকা, সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া হচ্ছে এমন প্রণালী যেখানে একটি মানব শিশু পূর্ণাঙ্গ সামাজিক মানুষে পরিণত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি ছেলে শিশু অনুকরণ করে তার বাবা, ভাই কিংবা পরিবারের পুরুষ সদস্যদের এবং ধীরে ধীরে বাবা, ভাই ও স্বামী হওয়ার প্রক্রিয়া রপ্ত করে। অন্যদিকে একটি মেয়ে শিশু অনুকরণ করে মা, বোন এবং পরিবারের নারী সদস্যদের।

এই সামাজিকীকরণ  প্রক্রিয়ার বাহন (Agent) হিসেবে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে পরিবার, পরিবার থেকেই আমরা সামাজিক হয়ে উঠি। কিন্তু শিশুটি যখন তার বিকাশকালের পুরোটা সময়ই পরিবার থেকে দূরে থাকে তখন এই দুরত্ব তার মানসিকতায় বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। একটু সহজ করে বললে, আমরা যারা পড়াশোনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে কিংবা মেসে থাকি দীর্ঘসময় পরে ছুটিতে বাড়ি গেলে বাড়ির সবাই আমাদেরকে অতিথি হিসেবে ট্রিট করে। কোন ভুল করলেও ‘কয়েকদিন পর তো চলেই যাবে ‘ এমন ভেবে কিছু বলা হয় না। নিজের অজান্তেই তখন কিছুটা দূরত্ব অনুভব করা অবাস্তব নয় এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই দূরত্বের অনুভূতি যখন শৈশব ও কৈশোরেই কোন শিশুর মননে তৈরি হয় সেটি অবশ্যই তার সামাজিক ও মানসিক অবসাদ সৃষ্টির কারণ হিসেবে বিবেচ্য।

দ্বিতীয়ত, বোডিং স্কুল একটি দন্ড (Punishment), বেশিরভাগ সময় হেফজখানা কিংবা বোডিং স্কুলগুলোতে একটু দুষ্টু ছেলেদের পাঠানো হয় এমনকি এমন ঘটনা-ও দেখা যায় একটি পরিবারের দু’ছেলের একজন পরিবারের সঙ্গে থেকে পড়াশোনা করছে আরেকজন একটু বেশি দুরন্ত হওয়ায় তাকে বোডিং স্কুল কিংবা হেফজ-খানায় পাঠানো হচ্ছে এতে করে শিশুটির মনে আগে থেকেই একটি চিন্তা লালিত হয় যে ‘আমি দুষ্টু বলেই তো শাস্তি হিসেবে  এখানে এসেছি’ তা থেকেই সে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে।

তৃতীয়ত, শিশুর সুশিক্ষা ও সঠিক বিকাশে বিঘ্নতা, দুরন্ত এই শিশুটিকে শৃঙ্খলায় রাখতে চাইলে তার জন্য প্রয়োজন শাসন ও ভালবাসার সমন্বয় সম্বলিত একটি পরিবেশ যা বোডিং স্কুলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে সম্ভব নয়। এখানে নির্ধারিত দায়িত্বশীলের নিয়ন্ত্রনাধীন থাকলেও সম্পূর্ণভাবে সুশিক্ষা প্রদান করা সম্ভব নয়। এ বিষয়টি হয়তো আমরা সকলেই বিশ্বাস করি যে ‘ক্লাস কিংবা আবাসিক শিক্ষার্থীদের মনিটররা চাকরি সূত্রে ডিউটি পালন করেন এক্ষেত্রে ‘ডিউটি’ এবং ‘রেসপন্সিবিলিটি’ দুটোই সম্পূর্ণ আলাদা পরিভাষা ‘ আর ছোট থেকেই দায়িত্বশীলহীনতায় ভোগা শিশুটি কখনো সম্পূর্ন সুশিক্ষা ও সঠিক বিকাশ পেতে পারে না।

তৃতীয়ত, সমাজবিচ্ছিন্ন মনোভাব, পরিবারের সঙ্গে বেড়ে ওঠা শিশুটি তার সব ধরনের বন্ধু বান্ধবের (Peer group) সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলতে পারে কিন্তু বোডিং স্কুল, হেফজ খানা, কিংবা ক্যাডেট শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ ব্যাপারে ঘাটতি দেখা যায় যেমন, নতুন প্রতিষ্ঠানে আসার পরপরই হাফেজ শিক্ষার্থীরা বেছে বেছে হাফেজদেরকেই বন্ধু হিসেবে বেছে নেয়, সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্য হতে কাউকে একেবারে কাছে ভাবাটা ডিস কম্ফোর্ট লাগে, একইভাবে ক্যাডেটের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক্স-ক্যাডেট খোঁজার প্রবনতা লক্ষনীয়।

চতুর্থত শিক্ষকরা সব ভুলের উর্ধ্বে, ধর্মীয় শিক্ষার উদ্দেশ্যে শিশুকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর পূর্বে অভিভাবক স্বয়ং  শিক্ষককে এই গ্যারান্টি দেন যে, ‘মাংস আপনার আর হাড্ডিগুলো আমাকে ফেরৎ দিলেই হবে’। (এর মাধ্যমে বোঝানো হয় প্রয়োজনে কঠিন শাস্তি দিয়ে হলেও পড়া আদায় করিয়ে নেওয়া) তখন শিক্ষকদের মধ্যেও একধরনের ‘ডোন্ট-কেয়ার’ মনোভাব চলে আসে যার ফলাফল স্বরূপ পান্না, পরিমলের মতো বিভিন্ন ঘটনা আমরা দেখতে পাই।

একটি বিষয় প্রতিটি অভিভাবককে সচেতন মস্তিষ্কে ও ঠান্ডা মাথায় ভাবার দাবি রাখে যে, আপনি কিংবা আমি শৈশবে কি করতাম? সারাদিন পর সন্ধ্যা হলেই দরজার সামনে আনাগোনা বাড়িয়ে দিতাম এই উদ্দেশ্যে যে কখন বাবা আসবে আর দৌড়ে কি তার কোলে উঠবো, রাতে বাবার গলা জড়িয়ে ঘুমানো  কিংবা ছুটির দিনে বাবার আঙ্গুল ধরে বেড়াতে যাওয়া ইত্যাদি সুখস্মৃতি থেকে কি নিজের শিশুটিকে বঞ্চিত করছি না? এই শিশুটিই যখন নিজ প্রতিষ্ঠানের জানালায় দাঁড়িয়ে অন্য কোন শিশুকে তার বাবার কোলে উঠে ঘুরতে দেখবে কিংবা বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করা অন্য সহপাঠীকে মায়ের হাতে টিফিন নিয়ে আসতে দেখবে তারমধ্যে তখন ঠিক কতটা শূন্যতাবোধ তৈরি হতে পারে।

সামাজিক জীবনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার যতটা প্রয়োজন ঠিক ততটাই প্রয়োজন পরিবারের। শিশুকে মেধা ও মননশীলতায় এগিয়ে রাখতে চাইলে বোডিং স্কুল নামক শিশুআশ্রমে নয় বরং প্রয়োজন পরিবারের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার।

মাসুম মাহমুদ শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *