বাংলাদেশের প্রথম ট্রান্সজেন্ডার কবি শোভার জীবনের হার না মানার গল্প

শাবনুর আক্তার নীলা ||

জীবন যুদ্ধে হার না মানা শোভা নিজেই হাতে করে বই এনে বইমেলায় আসা ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছেন। হাতেগোণা কয়েকজন পরিচিত ও বন্ধুরা বই কিনলেও মেলায় আসা বেশিরভাগ মানুষের থেকে মিলছে না তেমন সাড়া। ট্রান্সজেন্ডারদের নিয়ে নেতিবাচক ভাবনা আমাদের সমাজে প্রচলিত থাকায় অনেকে আবার তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে এড়িয়ে যাচ্ছেন।

২১ শতকে এসে দেশ ও সমাজ অনেকদূর এগিয়ে গেলেও এগোতে পারেনি ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটির মানুষেরা। শিক্ষা, চিকিৎসা, উন্নত জীবন এগুলো এখনো তাদের কাছে বইয়ে পড়া গল্পের মতো, যেগুলোর নেই কোন বাস্তব রূপ। সমাজে পিছিয়ে থাকা এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে থেকে শোভা চৌধুরী আলোর শিখা হাতে নিজেকে একটু একটু করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সামনের দিকে। বাংলাদেশের প্রথম ট্রান্সজেন্ডার কবি ও লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ইতোমধ্যে তার লেখা দুটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে।

শোভা চৌধুরীর লেখা প্রথম কবিতার বই ‘শ্রাবণ সন্ধ্যা’ ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয়। ‘আমি শোভা বলছি’ কবিতার বইটি ২০২১ সালে প্রকাশিত হয়। সামাজিক বৈষম্য ও আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল হওয়ার কারণে বই ছাপাতে কোন নামকরা প্রকাশনীকে পাশে পাননি শোভা। বইমেলার স্টলগুলোতেও ঠাঁই হয়নি তার কবিতার বইয়ের।

তাই তো জীবন যুদ্ধে হার না মানা শোভা নিজেই হাতে করে বই এনে বইমেলায় আসা ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছেন। হাতেগোণা কয়েকজন পরিচিত ও বন্ধুরা বই কিনলেও মেলায় আসা বেশিরভাগ মানুষের থেকে মিলছে না তেমন সাড়া। ট্রান্সজেন্ডারদের নিয়ে নেতিবাচক ভাবনা আমাদের সমাজে প্রচলিত থাকায় অনেকে আবার তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে এড়িয়ে যাচ্ছেন।

শুভ থেকে শোভা হয়ে ওঠা

খুলনার খালিশপুরের নিভৃত পল্লীতে জন্ম হয় একটি ছেলে শিশুর। পরিবার থেকে বাচ্চাটির নাম রাখা হয় শুভ। শুভ যখন শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা দিতে থাকে তখনই তার জীবনে অশুভ ছায়া পড়তে শুরু করে। তার পরিবার বুঝতে পারে শুভ আর পাঁচটা স্বাভাবিক ছেলের মতো আচরণ করছে না, তার পোশাক থেকে চলাফেরায় আসছে ব্যাপক পরিবর্তন। শোভার জীবনে অবহেলা, বৈষম্য প্রথম শুরু হয় নিজ পরিবার থেকেই। একে একে চোখের সামনে নিজের চিরচেনা বাবা, ভাইরা অপরিচিত হতে শুরু করে। সমাজ তার পরিবর্তন কে মেনে নেওয়ার আগেই পরিবার থেকে বঞ্চনা শুরু হয়।

শোভা চৌধুরী মনের মধ্যে একরাশ চাপা কষ্ট নিয়ে বলেন, “আমার বাবা আমার সাথে কথা বলতো না, এটার চেয়ে কষ্ট আর কি হতে পারে! বড়ভাই আর মেজোভাই আমাকে প্রায় মারতো। কারণ ‘হিজরাদের’ সমাজ ভালো চোখে দেখে না, পরিবারে এমন কেউ থাকলে সমাজে মুখ দেখানো যায় না”।

শুভ ধীরে ধীরে নিজের পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করতে থাকেন এবং উপলব্ধি করতে শুরু করেন, তিনি ছেলে হয়ে জন্মালেও তার ভেতরের সত্ত্বাটা আসলে একজন নারীর। এভাবেই শুভ হয়ে ওঠেন আজকের শোভা।

জীবন সংগ্রাম

জীবনে চলার পথে পরিবার থেকে কোনরকম সহযোগিতা পাননি। ছোটবেলা থেকেই জীবন সংগ্রাম করে গেছেন একা। নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে স্কুলের ছোট বাচ্চাদের পড়াতেন। বাচ্চাদের কেউ কেউ ৫০-১৫০ টাকা করে দিত, সেই টাকা দিয়ে চালিয়েছেন নিজের লেখাপড়ার খরচ।

“পরিবারে শুধু মা তার সন্তান হিসেবে আমাকে ফেলে দিতে পারেনি, তাও পরিবারের বাকি সবার তোপের মুখে মা কিছু বলতে পারতো না। স্কুল-কলেজে ছেলেরা আমার সাথে মিশতে চাইতো না, আমাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করতো, ‘হাফ লেডিস’ বলে ডাকতো। কিছু মেয়েরা আমার বন্ধু হয়েছিল আর বাকিরা আমার সাথে কথা বলতে চাইতো না”।

“বাবা আমার মাকে প্রায়-ই বলতো আমাকে যেন বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। এতো লাঞ্ছনা-বঞ্চনার পরে একদিন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম বাড়ি থেকে চলে আসবো। তারপর ২০১০ সালে কলেজ শেষ করে সেই যে প্রথম বাড়ি ছেড়ে ঢাকা চলে এসেছিলাম, আজও আর বাড়ি ফেরা হয়নি”, বলছিলেন শোভা।

তারপর তিনি ঢাকায় এসে মিরপুর সরকারি বাংলা কলেজে সমাজকল্যাণ বিভাগে ভর্তি হন। শোভা ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন যা তার সম্ভাবনার দুয়ার আরও প্রশস্ত করে দেয়।

সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন থেকে তিনি বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের (বিএনসিসি) সাথে যুক্ত ছিলেন। বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সাথে কাজ করেছেন চার বছর। বর্তমানে তিনি বৃহন্নলা সংগঠনের সাথে যুক্ত আছেন।

শোভা চৌধুরী আইসিডিডিআরবি-তে ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটির পরামর্শক পদে চাকরির সুযোগ পান। সেখানে তিনি তিন বছর কাজ করেন। হঠাৎ চাকরী চলে যাওয়ার পর বিশাল অট্টালিকা আর জনসমুদ্রের শহর ঢাকায় শোভা একা কী করবেন? কোথায় থাকবেন? ভেবে যখন কূল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছিলো না, তখন পরম মমতায় তার দিকে আশ্রয় ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় মিতু নামের আরেকজন ট্রান্সজেন্ডার নারী। শোভাকে তিনি তার পুরান ঢাকার বাড়িতে থাকতে দেন এবং নিজের মেয়ের মতো কাছে টেনে নেন।

সেই থেকে আজও শোভা তাকে মা বলে ডাকেন। যেই মেয়েটি একদিন ছেলে থেকে পরিবর্তন হতে শুরু করে বলে নিজের মা পর্যন্ত মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, যেই পরিবর্তনে ছিলনা তার বিন্দুমাত্র হাত বা অপরাধ। সেই মেয়েটিই একদিন এই অচেনা শহরে খুঁজে পেল একজন মা ও মায়ের মমতা।

বৈষম্যর শিকার

ট্রান্সজেন্ডার নারী হিসেবে যখনি কিছু করতে গেছেন তখনি সমাজ তাকে চোখে আঙুল দিয়ে তার অবস্থান কোথায় এই সমাজে তা দেখিয়ে দিতে মরিয়া ছিল। স্নাতক পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পেয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার পরেও চাকরীর জন্য ঘুরে ঘুরে পাননি কোনো চাকর। এছাড়াও তিনি খুলনার সরকারি কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট থেকে ৪ বছরের ডিপ্লোমা ডিগ্রি শেষ করেন। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কৃষি কর্মকর্তার বিভিন্ন পদের জন্য দীর্ঘ ৭ বছর চেষ্টা করেও সফলতা পাননি।

শোভা বলেন, “আমি সব জায়গায় ছুটে গেছি, কতশত যে পরীক্ষা দিয়েছি। এমনকি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরেও আমার চাকরি হয়নি, অনেক জায়গায় ভাইভা বোর্ড থেকে আমাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল”।

“তারপর হঠাৎ ফোন করে আমার কাছের এক ভাই ‘অপু’ আমাকে জানায় আমি নিউজ প্রেজেন্টার হিসেবে কাজ করতে আগ্রহী কিনা। সেখান থেকে আমার পরিচয় মারজান আপুর সাথে যিনি নিজ উদ্যোগে আমার মতো আরও ২০জন ট্রান্সজেন্ডার নারীকে সংবাদ পাঠিকার কোর্স শেখান। কিন্তু তারপর আমি অনেক চ্যানেলে চেষ্টা করেও চাকরি জোটাতে ব্যর্থ হই। এখনো আমি বিভিন্ন মিডিয়া চ্যানেলে চেষ্টা করে যাচ্ছি”।

কবিতার জগতে পদচারণা

ছোটবেলা থেকে বই পড়া, কবিতা আবৃত্তি করার প্রতি তার বেশ ঝোঁক ছিল। তখনও তিনি বুঝতে পারেননি একদিন তার নামের সাথে পাল্টে যাবে গোটা জীবনটাও। ছোটবেলা থেকে শোভা খুলনা জেলা শিল্পকলা একাডেমী থেকে নৃত্যকলা, নাট্যকলা শিখতেন। গাঙচিল সাহিত্য সংগঠন এর সাথে যুক্ত হওয়ার পর সাহিত্যের জগতে তার জানাশোনা ও জ্ঞান আরও বাড়তে থাকে। কবিতা আবৃত্তিতে একাধিকবার নিজ জেলার স্কুল থেকে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। এছাড়াও পেয়েছেন বিভিন্ন সম্মাননা পুরস্কার। ২০১১ সালের ২৩ নভেম্বর ঢাকার ফ্লোটিলায় অনুষ্ঠিত কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় জাতীয়ভাবে শোভা চৌধুরী প্রথম হন। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ তাকে মেডেল পরিয়ে দেন। তখন কবিতা আবৃত্তিতে শোভা বেশ পারদর্শী হলেও লেখালেখিতে সেভাবে মনোনিবেশ করেননি।

কিশোর বয়সে সমাজ ও পরিবার থেকে বিচ্যুত হয়ে একা একা থাকতে সময় তার মধ্যে লেখালেখির অভ্যাস গড়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ পড়ে হাতে খড়ি হয় তার কবিতার জগতের। তারপর সংগঠনগুলোর সাথে কাজের পাশাপাশি টুকটাক লেখালেখি চালিয়ে যেতে থাকেন।

কবিতার বই প্রকাশ

চারদিক থেকে হাজার চেষ্টা করেও যখন পাওয়া যাচ্ছিলো না চাকরি, তখন শোভা লেখালেখিতে পুরোপুরি মনোযোগ দেন। ২০১৮ সালে নিজের জমানো অল্প কিছু টাকা দিয়ে প্রথম কবিতার বই প্রকাশ করেন। কিন্তু সেই বইগুলো নিজস্ব চেনাজানা লোকের বাইরে আর কেউ নেয়নি।

জীবন নামক নৌকা যখন খেই পাচ্ছিলো না তখন হঠাৎ করেই এর হাল ধরতে এগিয়ে আসেন তার সেই পরিচিত মারজান আপু, যিনি আগেও নিজ উদ্যোগে সাহায্য করেছিলেন। শোভার লেখা কবিতা পড়ে তার ভাল লেগে যায়, তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি কবিতার বই ছাপাতে সাহায্য করবেন। তারপর ২০২১ সালে প্রকাশিত হয় ‘আমি শোভা বলছি’ কবিতার বইটি।

শোভা চৌধুরী বইটি উৎসর্গ করেছেন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তার প্রকাশিত দুটো কবিতার বইয়েই কবিতা সংখ্যা ৭১টি। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হয়েছে এই স্মৃতির স্মরণে সম্মান জানাতে এটা করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

কী করবেন শোভা

জীবন সংগ্রামে হেরে না গিয়ে এখনো একরাশ স্বপ্ন নিয়ে আগামীদিনের সুসময়ের জন্য লড়ে যাচ্ছেন সমাজের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর একজন শোভা চৌধুরী। শুরু থেকে এখনো একাই নিজের যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। মাঝে হঠাৎ দুএকজনকে পাশে পেলেও আবার একা চলতে হয়েছে বাকিটা পথ।

তিনি বলেন, “আমার ইচ্ছা আছে একজন উপস্থাপিকা, সংবাদ পাঠিকা ও লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার”। আমি আমার দেশ ও সমাজের জন্য কিছু করে করতে চাই। সবাইকে দেখাতে চাই সমাজের আর দশজন মানুষের মতো আমাদের জীবনও মূল্যবান”।

শোভা চৌধুরীর ভবিষ্যৎ ভাবনা কী জানতে চাইলে তিনি তার লেখা কবিতা ‘একজন মাধুরীর গল্প’ থেকে কয়েকটি লাইন বলে উঠলেন-

সে এর থেকে পরিত্রাণ চায়
মুক্তি দিতে চায়
এই পৃথিবীকে!
তার তো কোন দোষ ছিল না
সমাজ কি দেবে
তার জীবনের মূল্য
পাবে কি সে পরিত্রাণ
ধীরে ধীরে মৃত্যুর অতল গহ্বরে
নিমজ্জিত হলো!
সে আর কখনো ফিরে এলো না!

কবিতার এই লাইন গুলোই যেন বলে দিচ্ছে তার জীবনের গল্পটা। এই সমাজ কি আদৌ কোনদিন দেবে শোভাদের মর্যাদা ও সুন্দর একটি জীবন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *