ভাষাবিজ্ঞানী ড. এস. এম. লুৎফর রহমান

 মাহমুদ ইউসুফ 

অধ্যাপক ডক্টর এস. এম. লুৎফর রহমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নামজাদাসম্পন্ন একজন মৌলিক চিন্তাবিদ, ভাষাবিদ, লিপিতত্ত্বদি, ঐতিহাসিক, কবি ও কলামিস্ট হিসেবে আদৃত, স্বীকৃত ও সুপরিচিত। চিকিৎসাবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানের অন্যান্য ননটেকনিক্যাল বিষয়েও তাঁর নিবন্ধাদি সুধীজনদের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয়েছে। বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় তিনি একালের সেরা বাংলাভাষা গবেষক হিসেবে খ্যাতিমান। তাঁর গবেষণাকর্ম সূর্যের মতো দীপ্তি ছড়াচ্ছে অনুসন্ধিৎসুদের মাঝে।

উনিশ শতকের আগে বাংলাভাষা-সাহিত্যের রূপ, গতি, প্রকৃতি ও সিলসিলা যেভাবে ছিলো বর্তমানে ঠিক তার উল্টো। বাংলাবুলির উষালগ্ন থেকে ১৮০০ সন পর্যন্ত ইহা ছিলো গণমুখী। সাধারণ জনকওম তথা মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের কথোপকথনের সাথে ছিলো এ ভাষার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। সরকারি প্রশাসন, শিল্প-সাহিত্য-কৃষ্টি-কালচার এবং ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ভাষার রূপ ছিলো একই। কথ্যরূপ ও লেখ্যরূপ মৌলিক কোনো তফাত ছিলো না। ১৮০০ সালে স্থাপিত হয় কলকাতা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। এখানকার পণ্ডিতরা বাংলাজবানের মূলধারা বদলিয়ে নতুন আঙ্গিকে পয়দা করে যার নাম সংস্কৃত বাংলা। অদ্যাবধি ইহা প্রচলিত। এই পরিবর্তনযুগে যারা কথিত নায়ক (আসলে ভিলেন বা খলনায়ক) হিসেবে কাজ করেন তারা হলেন হ্যালহেড, ডানকান, ফরস্টার, উইলিয়াম কেরি, রামমোহন রায়, দেবেন্দ্রনাথ, অক্ষয়কুমার, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, তারাশঙ্কর তর্করত্ন, ইশ্চরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। প্রায় হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা বাংলাভাষাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে সংস্কৃতের আদলে সাধারণ জনগণের বোধগম্যের বাইরে একটা নবরূপ (সংস্কৃতবাংলা) দাঁড় করায়। বাংলাকে সংস্কৃতের সন্তান বলেও তারা মিথ্যা প্রচারণা চালায়। বাংলার এ জগাখিচুড়ি বা পাঁচমিশালী রূপটি দুর্বোধ্য, উচ্চারণ কঠিন এবং বাঙালির বুঝ বিবেক বিরুদ্ধ। স্যার জর্জ গ্রিয়ারসন বলেন, ‘বাঙালা ভাষায় শতকরা নব্বইটা প্রকৃত বাঙালা শব্দ ছিলো। তা তাড়িয়ে সে-সব জায়গায় সংস্কৃত শব্দ এনে বসিয়ে বাঙালা ভাষাকে সংস্কৃতায়িত করা হয়েছে।’ (উদ্বৃতি, অধ্যাপক ড. এস. এম. লুৎফর রহমান: বাঙালীর লিপি ভাষা বানান ও জাতির ব্যতিক্রমী ইতিহাস প্রথম খ-, পৃ ৯) ফোর্ট উইলিয়ামের সংস্কৃত আক্রান্ত পণ্ডিতরা যে গদ্যভাষা পয়দা করে তার সম্পর্কে তিনি বলেন, Anything more monostrous than this prose dialect.’ তরযমা- ‘এই গদ্যভাষার মত অধিকতর দানবীয় আর কিছু নেই।’ (পূর্বোক্ত, পৃ ১০০-১০১) monostrorus এর আভিধানিক অর্থ-কিম্ভূতকিমাকার, বিকট দর্শন, নিষ্ঠুর, উৎকট, বিরাটকায়, ভীমদর্শন, পৈশাচিক, ভয়ংকর, বিকট, অর্থহীন, অবিশ্বাস্য, কেলেঙ্কারিজনক, কুৎসিত ইত্যাদি। (বাংলা একাডেমি ইংলিশ বাংলা ডিকশনারি, পৃ ৪৫৬)

কলকাতাকেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবীদের আজব মগজে তৈরি হয় এই কিম্ভূতকিমাকার সংস্কৃত বাংলা। সংস্কৃত বিশেষজ্ঞ বুদ্ধিজীবীদের প্রদত্ত থিওরি থেকেই পরবর্তীকালে রচিত হয় বাংলাভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস। ‘এ পর্বে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক মুসলমানদের অবদান সম্পূর্ণ চাপা দিয়ে বরং তাদেরকেই বাংলার শত্রু বলে প্রচারণা চলে। অথচ এর কিছুদিন পূর্বেও ব্রাহ্মণ প-িতরা বাংলা না-জানাকে অহংকারের বিষয় বলে ভাবতো।’ (ফয়েজ আলম: ড. এস. এম. লুৎফর রহমানের প্রবন্ধ ‘‘বাঙলা দেশ, বাঙালা ভাষা … ’’ ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা, দৈনিক আজকালের খবর, ১৩ই নভেম্বর, ২০০৩, পৃ ৬, স্বকাল বিভাগ) সহিহ সত্য তথ্য উপাত্তকে বাদ দিয়ে এ কাজে নেতৃত্ব দেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ড. সুকুমার সেন, ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, গোপাল হালদার, ড. অসিতকুমার বন্দোপাধ্যায়, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ। আরও পরে ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, মুহাম্মদ আবদুল হাই, কাজী দীন মুহাম্মদ, ড. আহমদ শরীফ, হুমায়ুন আযাদ একই বৃত্তের আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছেন।

এই গতানুগতিক ধারার বাইরে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস উপস্থাপনের প্রয়াস পেয়েছেন শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন, অধ্যাপক আনিসুল হক চৌধুরী, নাজিরুল ইসলাম মোহাম্মদ সুফিয়ান, পশ্চিম বাংলার ঐতিহাসিক গোলাম আহমাদ মোর্তজা। তবে এক্ষেত্রে পরিপূর্ণ সার্থক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও নজরুল অধ্যাপক ড. এস. এম. লুৎফর রহমান। বাংলাদেশের কিংবদন্তী ঐতিহাসিক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. আবদুল করিম বলেছেন, ‘ইতিহাসে কোনো কথার শেষ নেই। আজ যা সিদ্ধান্ত করা হয় নতুন তথ্য আবিষ্কৃত হলেই কালই হয়তো তা পুনর্বিবেচিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে।’ (আবদুল করিম: বাংলার ইতিহাস সুলতানী আমল, পৃ ৮) ড. রহমানের মৌলিক ও সৃজনশীল চিন্তাগবেষণার ফসল বাংলা সাহিত্যের নব আবিষ্কৃত ইতিহাসের আলোকে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাভাষা ও সাহিত্যে পঠিত ইতিহাস বদলে নতুন ধারায় সৃষ্টি করার দাবি রাখে। এ আলোকে সিলেবাস বা পাঠ্যসূচি পরিবর্তন আবশ্যক।

ড. রহমানর জন্ম ১২ অক্টোবর ১৯৪১। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ সালে বাংলায় এমএ এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৯ সালে লোক সাহিত্যে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান ও নজরুল অধ্যাপক পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি ও বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতির আজীবন-সদস্য, তিনি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিউটের স্টিয়ারিং কমিটি ও বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য এবং বাংলা একাডেমির কাউন্সিল সদস্য।

বাংলাভাষার বস্তুনিষ্ঠ, আসল, প্রকৃত, তথ্যবহুল, যথার্থ, অবিকৃত ইতিহাস রচনায় তিনি দুর্লভ কৃতিত্বের দাবিদার। যা কিছু সুন্দর, যা কিছু সত্য, যা কিছু খাঁটি, নির্ভেজাল, বিশুদ্ধ, হিতকর, নৈতিক, ইতিবাচক তাই তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর গবেষণাপুস্তকে। নকল, বেইনসাফি, অসততার সংস্পর্শ থেকে বহুদূরে তার অবস্থান। কপটতা, ভণ্ডামি, ভাঁড়ামো তাঁর ওপর ছোবল হানতে পারে নাই। তার প্রবন্ধ নিবন্ধ মানব মনকে নতুন কিছু ভাবায়, স্বপ্ন দেখায়, সত্য উদঘাটনে উদ্বুদ্ধ করে। জ্ঞানের গভীরে যেতে সাহসী করে তোলে, দৃষ্টিকে প্রসারিত করে বহুদূর। সত্য ও ইনসাফের প্রতীকতার এসব বই-কিতাবাদি। স্বদেশপ্রেম, দেশাত্ববোধ, জাতির প্রতি মমত্ববোধ, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা তার গ্রন্থরাজির মূল প্রতিপাদ্য।

তাঁর পুস্তকে বিম্বিত হয়েছে ভাষা-সাহিত্যের হাজার বছরের ইতিহাসের ইতিহাস। তাঁর চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র জগৎ, গণমানুষের ভাব-ভাবনার ভাষাবুলি, হারিয়ে যাওয়া ভাষা পুনরুদ্ধারে তিনি সফলকাম। শহুরে, সভ্য সমাজে যা বটতলার পূঁথি হিসেবে খ্যাত। মূলত: সেটাই আমাদের ভাষা পরিচয়। সেই ভাষাতেই আমাদের জীবন মরণ। সেই ভাষাই আমাদের পূর্বপুরুষদের ভাষা যার জন্য জীবন দিয়েছেন ভাষা সংগ্রামীরা। আবদুল লতিফের সেই বিখ্যাত গান: কইতো যাহা আমার দাদায়, কইছে তাহা আমার বাবায়/ এখন কও দেহি ভাই মোর মুখে কি অন্য কথা শোভা পায়। আমাদের বাবা-দাদাদের সেই ভাষা বর্তমানে অপাঙক্তেয়। ড. রহমান বাংলাভাষা ও সাহিত্যের জগতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। ফোর্ট উইলিয়ামের বানানো কৃত্রিম ভাষার কালো অন্ধকার অধ্যায় তুলে ধরেছেন জাতির সামনে। তাই ফোর্ট উইলিয়াম ও কলকাতার কৃত্রিম-আত্মবিধ্বংসী ভাষাকে ঝেটিয়ে বিদায় করার এখনই উপযুক্ত সময়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বাংলা একাডেমি, পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রচারমাধ্যমকেই এই গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে।

তিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, গবেষক, ভাষাবিজ্ঞানী, জাতীয় বুদ্ধিজীবী এবং অসাধারণ মেধাসম্পন্ন সৃজনশীল লেখক। লোকসাহিত্যকর্মেও তার অবদান অপরিসীম। তাঁর রচিত লোকসাহিত্য বিষয়ক কিতাবাদি হলো বাংলাদেশী জারী গান, বাউল তত্ত্ব ও বাউল গান, লালন-জিজ্ঞাসা, লালন শাহ- জীবন ও গান, লালন গীতি চয়ন (দুই খন্ড), দুদ্দু শাহ, বোন বিবির জহুরানামা ও আঠার ভাটির ইতিহাস, বাউল সাধনা ও লালন শাহ, লালন জিজ্ঞাসা প্রভৃতি। এছাড়া অন্যান্য রচনাবলিসমূহ হলো বৌদ্ধ চর্যাপদ, বাংলাদেশী কথা সাহিত্যের তিন আমল, ধুমকেতু ও তার সারথি, মেসেপটেমিয়ায় নজরুল, উন্নয়ন আধুনিকায়ন, আধুনিক কালে কবি ও কবিতা, দৌলতপুরে নজরুল, বাঙলাদেশী জাতীয়তাবাদ, বাঙালা ভাষা ও বানানের ঐতিহাসিক বিপর্যয়। আবহমান বাংলার লোক চিকিৎসা তাঁরা একটি অসাধারণ গবেষণাকর্ম। ১৯৮১ সালে বৃহত্তর যশোর জেলাকে কেন্দ্র করে এ গবেষণা সম্পন্ন করা হয়। লৌকিক চিকিৎসা বিজ্ঞান, বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতির ইতিহাস এবং ঔষধকোষের ওপর সার্থকগ্রন্থ ‘বাংলাদেশী লোক-চিকিৎসা’ বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় ২০০৩ সালে। বাঙলা লিপি, বাঙলাভাষা, বাঙালি জাতির অজ্ঞাত উৎস নির্ণয় এবং ভাষাবিজ্ঞান, ভাষালিপি সম্পর্কীয় পঠন পাঠন ও চিন্তা ভাবনার বিশেষ দলিল হলো বাঙালা লিপির উৎস ও বিকাশের অজানা ইতিহাস এবং বাঙালীর লিপি ভাষা বানান ও জাতির ব্যতিক্রমী ইতিহাস শীর্ষক গ্রন্থরাজি।

বরেণ্য ঐতিহাসিক ড. মুহাম্মাদ সিদ্দিক বলেন, ‘ভাষা নিয়ে এ পর্যন্ত যারা গবেষণা করেছেন তাঁর ভিতর শ্রেষ্ঠ গবেষণাকর্মের হকদার ড. এস. এম. লুৎফর রহমান। তিনি গুরুদের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করলেও, গুরুবাদের শিকলে বাঁধা পড়েননি। কখনো কখনো মুরিদ পীরকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন, তারই নমুনা তাঁর চমৎকার গবেষণাকর্মে। তাঁর তিন খণ্ডের ‘বাঙালির লিপি ভাষা বানান ও জাতির ব্যতিক্রমী ইতিহাস,’ একটা ‘বিগ ব্যাং’ স্বরূপ। এটা একটা বৃহৎ বিস্ফোরণই। যেসব তথ্য এতদিন নিষিদ্ধ ছিল প্রচারে, তাই তিনি আরও বেশি বেশি তথ্য ও প্রমাণ সহযোগে এনে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করলেন। (দৈনিক সংগ্রাম, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৩)

দোহাই :
১। ড. এস. এম. লুৎফর রহমানঃ বাঙালা লিপির উৎস ও বিকাশের অজানা ইতিহাস, বাংলা একাডেমি ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ২০০৫
২। অধ্যাপক ড. এস. এম. লুৎফর রহমান: বাঙালীর লিপি ভাষা বানান ও জাতির ব্যতিক্রমী ইতিহাস প্রথম খ-, ধারণী সাহিত্য সংসদ, ঢাকা, প্রকাশকাল ফেব্রুয়ার ২০০৪
৩। ড. মুহাম্মাদ সিদ্দিক: ভাষা নিয়ে ‘থেফ্ট হিস্টরি, দৈনিক সংগ্রাম, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৩
৪। আবদুল করিম: বাংলার ইতিহাস সুলতানী আমল, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, বাংলাবাজার ঢাকা ১১০০, জানুয়ারি ১৯৯৯
৫। বাংলা একাডেমি ইংলিশ বাংলা ডিকশনারি, পুনমুদ্রণ জুন ২০১৫, বাংলা একাডেমি শাহবাগ ঢাকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *