ভয়ানক আজভ ব্যাটালিয়ন: রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে যে নাৎসি আধাসামরিক বাহিনী

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বলছেন, ইউক্রেনে হামলার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো- প্রতিবেশী দেশটিকে ‘নাৎসিমুক্ত’ করা। গোটা বিশ্বের কাছে পুতিনের এই দাবি স্রেফ একটা অজুহাত। তবে চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে, ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনীর মধ্যে আসলেই হিটলারের আদর্শে বিশ্বাসী বেশ কিছু ছোট ছোট দল আছে। হিটলারের আদর্শে বিশ্বাসী- এই প্যারামিলিটারি গোষ্ঠীর সদস্যরা স্বীকার করতে দ্বিধা করে না যে, তারা সমকামী ও বাইরের দেশের মানুষকে ঘৃণা করে।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরু করে রাশিয়া। এরপর প্রায় তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। রুশ বাহিনীর হামলায় এ পর্যন্ত দেশ ছেড়েছেন প্রায় ৩০ লাখ ইউক্রেনীয়। ভ্লাদিমির পুতিনের সামরিক বাহিনীর আগ্রাসন অব্যাহত রয়েছে।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বলছেন, ইউক্রেনে হামলার অন্যতম উদ্দেশ্য- প্রতিবেশী দেশটিকে ‘নাৎসিমুক্ত’ করা।

গোটা বিশ্বের কাছে পুতিনের এই দাবি স্রেফ একটা অজুহাত। তবে চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে, ইউক্রেনিয়ান সামরিক বাহিনীর মধ্যে আসলেই হিটলারের আদর্শে বিশ্বাসী বেশ কিছু ছোট ছোট দল আছে।

হিটলারের আদর্শে বিশ্বাসী এমনই একটি আধাসামরিক গোষ্ঠী হচ্ছে আজভ ব্যাটালিয়ন।

কদিন আগেই ইউক্রেনের ন্যাশনাল গার্ড টুইটারে একটি ভিডিও আপলোড করে। তাতে দেখা যায়, আজভ যোদ্ধাদের মোতায়েন করা হয়েছে ইউক্রেনে। অভিযোগ রয়েছে, এই গোষ্ঠীটি রাশিয়ার মিত্র মুসলিম চেচেনদের বিরুদ্ধে শূকরের চর্বি থেকে তৈরি বুলেট ব্যবহার করেছে।

রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো ও বিপজ্জনক লড়াই যারা চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে অন্যতম ইউক্রেনের এই চরম ডানপন্থী মিলিশিয়া।

কী এই আজভ ব্যাটালিয়ন?

আজভ ব্যাটালিয়ন হলো একটি সশস্ত্র আধা-সামরিক গোষ্ঠী। এর সব সদস্যই স্বেচ্ছাসেবী। এই গোষ্ঠীটি অতি-জাতীয়তাবাদী। এরা নব্য-নাৎসিবাদ ও শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

২০১৪ সালের মে মাসে স্বেচ্ছাসেবী গোষ্ঠী হিসেবে আজভ ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়। এর উদ্যোক্তা ছিল একদল ইউক্রেনীয় অতি-জাতীয়তাবাদী এবং নব্য-নাৎসি সোশ্যাল ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি (এসএনএ) গোষ্ঠী। পরে একে ইউক্রেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘ইনটারভেনশন ইউনিট’ হিসেবে যুক্ত করা হয়।

আজভ ব্যাটালিয়নের সদস্যসংখ্যা প্রায় ৯০০। তাদের অধিকাংশই প্যারামিলিটারি। এই ব্যাটালিয়নের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয় ইসরায়েলি আর্মির কর্মকর্তারা।

এই প্যারামিলিটারি গোষ্ঠীর সদস্যরা স্বীকার করতে দ্বিধা করে না যে, তারা সমকামী ও বাইরের দেশের মানুষকে ঘৃণা করে। এছাড়াও নিজেদের এরা সদম্ভে নাৎসি হিসেবে পরিচয় দেয়। এরা অভিবাসী, রোমা সম্প্রদায় এবং বিরোধী মতাবলম্বীদের ওপর শারীরিক হামলা চালায়।

আজভ ব্যাটালিয়নের ‘কীর্তি’র সংখ্যা কম না। ২০১৪ সালে ২ মে এই প্যারামিলিটারি বাহিনী ওডেসায় হাউস অভ ট্রেড ইউনিয়নসে হামলা চালিয়ে গণহত্যা চালায়।

এছাড়া দনবাস (ইউক্রেনের রুশপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদী দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চল) অঞ্চলে রুশপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ওপর হামলা চালিয়ে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে এই আজভ গোষ্ঠী।

২০১৫ সালে এক ব্যক্তিকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার পর কুখ্যাত হয়ে ওঠে আজভ ব্যাটালিয়ন। ইউক্রেনিয়ান সংঘাতেও বেশ কিছু বীভৎস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে এই গোষ্ঠী।

রাশিয়া-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছ থেকে বন্দরনগরী মারিউপোলকে পুনরুদ্ধার করার কয়েক মাস পরই—২০১৪ সালের ১২ নভেম্বর—ইউক্রেনের ন্যাশনাল গার্ডের সঙ্গে আজভ ব্যাটালিয়নকে একীভূত করে নেওয়া হয়।

ইউক্রেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পেত্রো পোরোশেনকো এই ব্যাটালিয়নের ভূয়সী প্রশংসা করেন। ২০১৪ সালে এক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘এরা আমাদের সেরা যোদ্ধা। আমাদের সেরা স্বেচ্ছাসেবক।’

আজভ ব্যাটালিয়নের প্রতিষ্ঠাতা  

প্রথমে এই ইউনিটের নেতৃত্ব দিতেন আন্দ্রেই বিলেতস্কি। তিনি প্যাট্রিয়ট অভ ইউক্রেন (২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত) ও এসএনএ-র (২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত) নেতা ছিলেন। ইউক্রেনের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালানোর জন্য কুখ্যাত ছিল এসএনএ।

২০১০ সালে বিলেতস্কি বলেন, ইউক্রেনের জাতীয় লক্ষ্য হচ্ছে ‘নীচু জাতির বিরুদ্ধে বিশ্বের শ্বেতাঙ্গ গোষ্ঠীগুলোকে একটি চূড়ান্ত ধর্মযুদ্ধে (ক্রুসেড) নেতৃত্ব দেওয়া।’

২০১৪ সালে বিলেতস্কি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচিত কর্মকর্তারা সামরিক বা পুলিশ বাহিনীতে থাকতে পারেন বলে তিনি আজভ ব্যাটালিয়ন ছেড়ে দেন। ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি এমপি ছিলেন।

৪২ বছর বয়স্ক বিলেতস্কিকে তার সমর্থকরা বেলি ভোজদ—অর্থাৎ সাদা শাসক নামে ডাকে। ২০১৬ সালের অক্টোবরে তিনি চরম ডানপন্থি ন্যাশনাল কর্পস পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। দলটির হর্তাকর্তারা সবাই সাবেক আজভ সদস্য।

আজভের অর্থের উৎস

২০১৪ সালে আজভ ইউনিটের খরচ বহন করতে ইউক্রেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ইউক্রেনের নিজস্ব মিলিটারি রুশপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত দুর্বল ছিল বলে এই গোষ্ঠীকে অর্থায়ন করত ইউক্রেন সরকার।

তাছাড়া অলিগার্করা (ব্যাপক রাজনৈতিক প্রভাবসম্পন্ন অতিধনী ব্যবসায়িক নেতা) ব্যক্তিগতভাবে আজভ ইউনিটকে অর্থায়ন করত।

বর্তমানে আজভ ব্যাটালিয়নের খরচ বহন করেন অলিগার্ক ইগর কলোময়েস্কি। তিনি ইউক্রেনিয়ান বিদ্যুৎ গ্রিডের মালিক। ইগর কলোময়েস্ক্রি ইউক্রেনের পাশাপাশি সাইপ্রিয়ট ও ইসরায়েলি পাসপোর্টেরও অধিকারী। এছাড়া তিনি নিপ্রোপেত্রোভস্কা অঞ্চলের সাবেক গভর্নরও।

আজভ ছাড়াও আরও কয়েকটি সেচ্ছাসেবী নাৎসিপন্থি ব্যাটালিয়নকে—যেমন নিপ্রো ১ ও নিপ্রো ২, আইদার ও দনবাস ইউনিট—অর্থ সরবরাহ করেন কলোময়েস্কি।

এছাড়াও দনেৎস্ক অঞ্চলের ধনকুবের গভর্নর ও অলিগার্ক সেরহি তারুতাও আজভকে অর্থ ও অন্যান্য সহায়তা দিয়েছেন।

নব্য-নাৎসি আদর্শে বিশ্বাসী আজভ

বিশ্বের অন্যান্য নাৎসি সংগঠনের—যেমন স্পেনের ফ্রেন্তে ন্যাকিওনাল আইদেন্তিতারিও—সঙ্গে সম্পর্ক রাখে আজভ।

২০১৫ সালে রেজিমেন্টটির মুখপাত্র আন্দ্রেই দিয়াচেঙ্কো বলেছিলেন, আজভের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ সদস্য নাৎসি।

ইউনিটটি মুখে মুখে সর্বতোভাবে নাৎসি আদর্শ লালন করার কথা অস্বীকার করে। কিন্তু আজভ সদস্যদের ইউনিফর্ম ও শরীরে স্বস্তিকা এবং নাৎসিদের এসএস বাহিনীর রাজদণ্ড প্রতীক দেখা যায়।

যেমন, আজভ গোষ্ঠী সগর্বে উল্ফস্যাঙ্গেলের মতো নিজস্ব প্রতীক প্রদর্শন করে বেড়ায়। অনেকটাই স্বস্তিকার মতো দেখতে এই প্রতীক আঁকা হয় হলুদ পটভূমিতে। যদিও গোষ্ঠীটির দাবি, এটি স্রেফ ইংরেজি ‘এন’ ও ‘আই’ অক্ষরের সংমিশ্রণ যা তাদের ‘জাতীয়তাবাদের ধারণা’কে উপস্থাপন করে।

তবে আজভের সদস্যরা ব্যক্তিগতভাবে সগর্বেই নিজেদের নব্য-নাৎসি পরিচয় দিয়ে থাকে। সদস্যদের মধ্যে অতি-জাতীয়তাবাদের অনুভূতিও প্রবল।

২০১৮ সালে আজভ ইউনিট রোমা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সুসংগঠিত লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ড চালায়। এছাড়া এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের ওপরও হামলা চালায়।

২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ন্যাশন ম্যাগাজিনের একজন প্রতিনিধি লেখেন, ‘নিজস্ব সেনাবাহিনীতে নব্য-নাৎসি গড়ে তোলা পৃথিবীর একমাত্র দেশ হলো ইউক্রেন।’

আজভের যত মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধ

২০১৬ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের কার্যালয়ের এক প্রতিবেদনে আজভ রেজিমেন্টের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার-সংক্রান্ত আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলা হয়।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আজভ ইউনিট অস্ত্রের জোরে ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বেসামরিক ভবন থেকে সেখানকার বাসিন্দাদের বিতাড়িত ও বেসামরিক সম্পদ লুটপাট করে। ওই প্রতিবেদনে দনবাস অঞ্চলে আটকদের ধর্ষণ ও নির্যাতন করার অভিযোগও করা হয় এই ব্যাটালিয়নের বিরুদ্ধে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কী করছে?

কিছুই না।

২০১৫ সালের জুনে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দেয় তারা তাদের বাহিনী দিয়ে আজভ রেজিমেন্টকে প্রশিক্ষণ দেওয়াবে না। দেশ দুটি আজভের বিরুদ্ধে নব্য-নাৎসি আদর্শ লালনের অভিযোগ তুলে এ সিদ্ধান্ত নেয়।

তবে পেন্টাগনের চাপের মুখে পরের বছরই আমেরিকা ওই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।

২০১৯ সালের অক্টোবরের মার্কিন কংগ্রেসের ৪০ জন সদস্য আজভকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন’ (এফটিও) আখ্যা দিয়ে চিঠি পাস করানোর চেষ্টা করলেও তা ব্যর্থ হয়।

কিন্তু আজভের সমর্থকেরও অভাব হচ্ছে না। তিন মহাদেশের অতি ডানপন্থি ও শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা আজভে যোগ দিচ্ছে।


  • সূত্র: আল জাজিরা ও মার্কা ডটকম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *