মধুসূদনের সাগরদাঁড়িতে একদিন

আযাদ আলাউদ্দীন ।।
‘হে বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ রতন, তা সবে অবোধ আমি অবহেলা করি’ বাংলা সাহিত্যে আধুনিক পথিকৃৎ মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। অনেক দেশ ঘুরে কবি অবশেষে নিজ মতৃভূমি বাংলাতেই আবিস্কার করেছেন বিবিধ রতন। বাংলা রেনেসাঁর এই সার্থক প্রতিনিধি মাইকেল মধুসূদনের পৈত্রিক নিবাস সাগরদাঁড়িতে ২০০২ সালের ১৫ মার্চ সরকারি বিএম কলেজের বাংলা বিভাগের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকরা মিলে ভ্রমণে গিয়েছিলাম আমরা।
নির্ধারিত সময় ভোর ৬ টায় কলেজ ক্যাম্পাস থেকে শুরু হলো আমাদের যাত্রা। এর পূর্বে যাবতীয় প্রস্তুতি পর্ব অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সম্পন্ন ও পরিচালনা করিয়েছেন বাংলা বিভাগের সর্বকনিষ্ঠ শিক্ষক শ্রদ্ধেয় মনজ স্যার। স্যারের উদার মনোভাব, আমাদের প্রতি তার অপরিসীম মমতা মনে রাখবো চিরদিন। পরীক্ষা থাকার কারণে অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীরা এই ভ্রমণে অংশ নিতে পারেনি। পিকনিক সুচারু রুপে সম্পন্ন করতে সকল বর্ষ থেকে ছাত্র প্রতিনিধি নির্ধারন করে দেয়া হয়েছে।
মাস্টার্সের ছাত্র-ছাত্রীদের তত্ত্বাবধান করেন জাকির ভাই ও সুমন ভাই। তাদের প্রচেষ্টায় প্রথমবারের মত বিপুল সংখ্যক মাস্টার্সের ছাত্র-ছাত্রী পিকনিকে অংশ নিয়েছে। যার ফলে তাদের জন্য নির্ধারিত একটি বাস বরাদ্দ ছিলো। আর অনার্স দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের ছাত্রদের প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেছে যথাক্রমে নাঈম/দোলন ও জাকির/সুক্ত।
বরিশাল থেকে সাগরদাঁড়ির দুরত্ব অনেক বেশী- যার কারণে খুব ভোরেই আমাদের যাত্রা শুরু হলো। একে একে আমাদের গাড়ী দুটি অতিক্রম করলো বরিশাল ঝালকাঠি-পিরোজপুর-বাগেরহাট ও খুলনা হয়ে যশোরের সাগরদাঁড়ি। সকাল ৮টার দিকে বেকুটিয়া ফেরীঘাট স্থলে সকলের জন্য নাস্তা পরিবেশিত হলো। গাড়ীর শাঁ শাঁ তোড়ের মাঝে মিউজিকের উম্মাতাল শব্দে তারুণ্যের সেকি উচ্ছলতা। যেন এইসব তরুণ-তরুণীরা ছুটে চলছে জীবনের উল্লাসে অমৃত সদনে। এই উচ্ছাসের মাঝে অনেক বিক্রি করেছে লটারির কুপন। স্যারদেরকেও আনন্দিত আর উৎফুল্ল মনে হয়েছে। সেই সময় স্যাররাও যেন তাদের তারণ্য ফিরে পেয়েছে। এভাবেই উৎসবমুখর  পরিবেশর  মধ্য দিয়ে আমরা অতিক্রম করেছি ষাট গম্বুজ মসজিদ এবং খানজাহান আলীর মাজার। আমাদেরকে বহনকারী গাড়ী যখন মাইকেলের স্মৃতি বিজড়িত সাগরদাঁড়িতে পৌছল তখন সময় বিকেল ৩টা। গাড়ী থেকে নেমে সকলেই চঞ্চল প্রজাতির মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো মধুসূদনের এই পৈত্রিক নিবাস। সাগরদাঁড়ি গ্রামের এই জমিদার দত্ত বাড়িতেই ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেছিলেন মধুসূদন দত্ত। সেকালে এখানে ছিলো বিরাট পুকুর,  আমবাগান ও প্রসাদপম বাড়ি। এসব পুরাকীর্তি বিলীন হওয়ার  অনেক পর লম্বালম্বি কয়েকটি  কক্ষ সংস্কার করে প্রত্মতত্ত্ব বিভাগ বাড়িটি তদারক করছে। ওইসব কক্ষের সামনেই নির্মিত হয়েছে কবির আবক্ষ ভাস্কর্য। মধুসূদন জাদুঘরে কাঁচের আসবাবপত্রে সংরক্ষণ করা হয়েছে কবির পরিবারে ব্যবহৃত অনেক জিনিসপত্র। এসব দেখলেই দর্শনার্থীদের প্রাচীন ঐতিহ্যের কথা মনে পড়ে যায়। এখানে রয়েছে মধুসূদন একাডেমী, ডাকঘর, হাইস্কুল, মসজিদ, হাফেজী মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন রকমের প্রতিষ্ঠান। মিউজিয়ামের পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে জেলা পরিষদ কর্তৃক নির্মিত ডাকবাংলো, যার চারপাশে রয়েছে মনোরম ফুলের বাগান। ডাকবাংলোর তীর ঘেষেই বয়ে গেছে মাইকেলের স্মৃতি বিজড়িত কপোতাক্ষ নদ। প্রতিদিন শতশত দর্শনার্থী দেখতে আসে সাগরদাঁড়ি। ভ্রমণ পিয়াসুদের ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দ তরঙ্গকে মনে হয়েছে সুর-ছন্দনী।
সব কিছু ঘুরে দেখার ফাঁকে বন্ধুদের সাথে চুঁপি চুঁপি আলাপে প্রমাণিত হলো এই ভ্রমণের সেরা বিউটি কুইন ছিলো- বীথি এবং মারুফা। সুদর্শন যুবকের তালিকায় শীর্ষে ছিলো রিয়াজ। যদিও তাকে খুব বেশী উৎফুল্ল দেখা যায়নি সেদিন। সুক্তকে মনে হয়েছে সে যেন হানিমুনে গিয়েছে। নোমানকে ‘কাভি খুশি কাভি গাম’র মত কখনো আনন্দিত আবার কখনো বেদনার্ত মনে হয়েছে, সম্ভবত: তার প্রিয় মানুষটি সাথে ছিলোনা বলেই এরূপ হয়েছে তার। এভাবেই বাংলা বিভাগের শতাধিক তরুণ-তরুণী উৎসাহ-উদ্দীপনা আর আনন্দ-উচ্ছলতার মধ্য দিয়ে কাটিয়েছে এই ভ্রমণের দিনটি। পরিপাটি ভোজন শেষে কুপনের আকর্ষণীয় ড্র এবং চেয়ারম্যান স্যারের কন্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান ‘ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু….  যা আমাদের মনের মাধুরীতে মিশে থাকবে অনেকদিন। রাত তিনটায় আমাদের গাড়ি যখন বিএম কলেজ ক্যাম্পাসে পৌছে তখন পুরো ক্যাম্পাস নিঝুম ও নিস্তব্দ। তারপর যে যার গন্তব্যের  দিকে…।
আযাদ আলাউদ্দীন, সাবেক শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, সরকারি বিএম কলেজ, বরিশাল।
তথ্যসূত্র: দৈনিক দক্ষিণাঞ্চল, ২৩ মার্চ ২০০২

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *