রাজকন্যার স্বপ্নের রাত

মোশাররফ হোসেন মুন্না

একটি নিঝুম পরিবেশ। ছিমছাম সাজানো গুছানো। নির্মল পরিপাটী। সারি সারি গাছ; রাস্তায় যেনো ঝরাপাতার বিছানো নকশিকাঁথা। ফুল, ফলে অপরুপ রুপসী জায়গাটি। আর কিছু বৈচিত্র্যময় প্রাণীর বসবাস; এখানে প্রজাপতিরা থাকেন। আরো থাকেন হরিণ, কাঠবেড়ালি, ময়না, শ্যামা ।
এই সুন্দর বাগানের পাশেই বসবাস এক রাজার।
অনেক সুন্দর রাজার বাড়ি
রাণী করে রান্নাবাড়ি
রাজার মেয়ে সুমাইয়া
থাকে শুধু ঘুমাইয়া
গরমে গেছে ঘামাইয়া
মাথা দেছে কামাইয়া
ঘর দিয়া দেছে নামাইয়া।
ঘর ছাড়া হয়ে তার এখন বাগানেই বসবাস। প্রতিদিন  ভোরবেলাতে ময়নাপাখিরর মধুর সুরে ঘুম ভাঙ্গে রাজকন্যের। পড়ন্ত বিকেলে হরিণের সাথে ছোটাছুটি করে সময় কাটে। মিষ্টি রোদ যখন গাছের ডগায় ভাসে তখন দুষ্টমিতে মাতেন কাঠবেড়ালি ও ছোঁচা বানরের সাথে। রাজকন্যার ফল পেরে দেয়ার দ্বায়িত্ব নিলেন দুষ্টমিষ্ট কাঠবেড়ালি। রাজকন্যা রাজ্য ছেড়ে বেশ সুখেই আছেন। তবু মাঝে মধ্যেই মন খারাপ থাকে রাজকন্যার। যখন মন খারাপ লাগে তখনই সে ঘুরে ঘুরে কথা বলে প্রকৃতির সাথে, সেই সুবাদে হঠাৎ একদিন পরিচয় হলো নীলডানার এক প্রজাপতির সাথে। প্রজাপতি অনেকদিন যাবৎ রাজকন্যাকে দেখেন কিন্তু সাহস পাননি কথা বলার; যদি তাকে বন্দি বা আঘাত করে! আজ সাহস করেই তার গায়ে বসে প্রজাপতি বললো; তোমার মন খারাপ রাজকন্যে? আমি তোমার বন্ধু হবো। রাজকন্যেতো মহাখুশি, যেনো আজ ঈদ। রাজকন্যে বললো তোমার পোশাকটাতো বেশ সুন্দর!  প্রজাপতি বললো, এটা আমার মামা দিয়েছে। চলো আমার বাসায় চলো তোমার সাথে গল্প করি একটু সময়। বসে বসে গল্পের ছলে পরিচয় দিলো। বললো আমার নাম নীলপ্রজাপতি। আদর করে সবাই আমাকে নীল বলে ডাকে। আমার নানুর বাসা খুলনার সুন্দরবনে। আমার দাদুর বাসা সিলেটের চাবাগানে। আমি থাকি তোমারি শহর বরিশালে, এখানের পরিবেশটা বেশ শান্ত, আমার খুব ভালো লাগে, আমি চাই প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে। ঘন সবুজে ঘুরে বেড়ানো আমার খুব পছন্দ। কিন্তু মানুষরা আজকাল যেভাবে গাছপালা কাটছে তাতে আমাদের মত নিরীহ প্রাণীর পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। ফুল,ফল, অক্সিজেন কমে যাচ্ছে।  এতে আমাদের খাদ্য কমে যাচ্ছে, আর অক্সিজেন কমে গেলেতো কার্বনডাইঅক্সাইড বৃদ্ধি পাবেই।  ফলে পৃথিবীর ভারসাম্যও নষ্ট হচ্ছে। নীল, গল্পের ফাকে পাতাবাহারের ট্রেতে করে নিয়ে আসলো বিভিন্ন স্বাদের শরবত। নীলকে বন্ধু হিসেবে পেয়ে আনন্দে রাজকন্যের গলাটা শুকিয়ে গিয়েছিল। বিভিন্ন ফুল ও ফলের রসের শরবত পান করে রাজকন্যে তৃষ্ণা মিটালো। অতঃপর  বিদায় নিলো। মনে মনে বললো ভালোমন্দ অবুঝ প্রাণিরাও বোঝে। শুধু বোঝেনা পৃথিবীর বেতাল মানুষ গুলো।

যাইহোক এতোদিন পরে একজন জ্ঞানী বন্ধু পেলো ঘরছাড়া রাজকন্যে। কিন্ত তাহা কি আর মানুষ বন্ধুর বিকল্প হয়! কেননা মানুষ সামাজিক জীব, একে অপরকে ছাড়া বাঁচতে পারেনা। কারণ বন্যেরা বনেই সুন্দর, মানুষ সমাজে সুন্দর।
রাজকন্যার এই দুঃখ বুঝতে পারে ছোঁচা বানর ও দুষ্ট কাঠাবেড়ালি। দুজন বুদ্ধি পাকালো। কাঠাবেড়ালি বিভিন্ন রকম ফলমুল যোগার করলো। ছোঁচা বানর কিছু মজার কৌতুক শিখে নিলো। তারা আজ বন্যেরানির বাসায় তার সমবয়সী কাউকে আতিথিয়েতা করাবে।
একদিন তারা বনের ধারে পথের ঘাসে বসে থাকলো, স্কুল ছুটি হলো তামান্না, অনিক ও তুলি যাচ্ছে।
ছোঁচা বানর ও কাঠবেড়ালি একটু আগাতেই ওমনি ওরা ভয়ে দিলো দৌড়।
এখন চলছে দোষ খোজার পর্ব;
চালাক কাঠবেড়ালী বললো ছোঁচা বান্দর সাথে থাকলেতো সবাই পালাবেই,
বানর বললো; তোমার মতো দুষ্ট কাঠবেড়ালী সাথে নিয়ে ঘুরলে কালো কাকও ফিরে তাকাবেনা আমার দিকে। দুই দোস্ত বলে কথা,
কিছুক্ষণ পরে দুজনেই অভিমান ভাঙলো বললো চল আবার কালকে চালাবো আমাদের চালাকি।
বাসায় ফিরে দুজন রাজকন্যের খাবার গুছিয়ে দিলো। রাজকন্যেও ওদের দুজন ছাড়া কখনোই খায় না। একসাথে খাওয়া শেষ করলো। রাজকন্যা তার নতুন বন্ধুর কথা আনন্দের সাথে  বানর ও কাঠবেড়ালিকে বললো। তারা দুজন মহাখুশি। যেনো ভারতবর্ষ জয় করেছে।
বানর বললো: রাজকন্যে তোমার বন্ধুটাকে রাতে নিমন্ত্রন করোনা! বাসায় আমরা চারজন মিলে গল্প করবো মজার মজার বই পড়বো।

ওকে চুপ করে দিয়ে রাজকন্যা বললো, এই আমার নীল বন্ধটা অনেক সুন্দর, তোমরা লোভ সামলাতে পারবেনা, শেষে আমার বন্ধুত্বে ভাগ বসাবে? তা হবেনা তা হবেনা,,,,,,কাঠবেড়ালি ভেজাকন্ঠে বললো, রাজকন্যে তোমার একজন ভালো বন্ধু আমাদের বন্ধু হলে তোমার কি এমন ক্ষতি হবে? রাজকন্যা বললো আরে ভাই আমি সিরিয়াসলি বলিনাই। আর ভালো বন্ধুর সাথে চললে তোর (বানরকে) ছোঁছামি আর তোর  (বেড়ালিকে) দুষ্টামানি টা একটু কমবে তাতে আমারও ভালো।  (হাহাহা) সাবাই একসাথে হাসলো। কেনো জানিসনা “সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ” । আচ্ছা আমার কাজ আছে আমি কিন্তু প্রজাপতিকে নিয়ে আসতে পারবোনা। নিয়ে আসার দায়িত্ব তোদের। যেই বলা সেই কাজ। দুজন ছুটলো প্রজাপতির বাড়ি। বিকালটা প্রজাপতির বাসায় বেশ কাটলো বানর ও কাঠবেড়ালীর। সন্ধায় রওয়ানা হলো,  পথিমধ্যে প্রজাপতির বিপদ হলো একটি ডানায় আঘাত পেয়েছে তাই উড়তে কষ্ট হচ্ছে। তবুও পথ চলতে চেষ্টা করছে নীল। বানর ও বেড়ালের চোখ এড়াতে পারলোনা। বললো তুমি আমাদের কাঁদে চড়ে যাবে। এমন উদারতা দেখে নীল বললো, সত্যি তোমরাই প্রকৃত বন্ধু। বেড়ালি বললো নীল তুমিই বলো, বন্ধুর বিপদে বন্ধু যদি এগিয়ে না আসে তাহলে বন্ধুত্বের কি প্রয়োজন? বন্ধু মানেইতো একে অপরের সুখে দুঃখে সাথি হওয়া। পাশে থাকা।

অবশেষে পৌঁছল বাসায় । প্রজাপতির গায়ে বাহারি রঙের পোষাক, কানে জবাফুলের দুল, গলায় কনকলতার মালা, যেনো রুপনগরীর রুপকন্যা। রাজকন্যার গায়ে বাবার দেয়া গত জন্মদিনের রাজকীয় গাউন, হাতে কাকন, গলায় হার, পায়ে নূপুর যেনো লাস্যময়ী রাজরুপসী। আর বানরও বেড়ালি সেজেছে মনের মতো আপন সাজে। গল্পের আসর বেশ জমেছে। প্লান হলো আগামীকাল পিকনিক হবে রাজকন্যের বাসায়। অনেক রাত হলো এখন ঘুমোবো; বললো প্রজাপতি। বানর ও বেড়ালি একরুমে ঘুমালো, দুই বান্ধবী একসাথে ঘুমিয়ে পড়লো, কিন্ত রাজকন্যের মনের একটাই আশা একটা মানুষ বন্ধু চাই, কারণ প্রাণীদের সাথে বন্ধুত্ব করা যায়। কিন্তু বসবাস করা যায়না। সকাল সকাল ময়না, দোয়েল, শ্যামার গানে ঘুম ভাঙলো চারজনের।
বানর ও বেড়াল গেলো সেই পথের ধারে আজকে তুলি একাই আসছে, ক্লাশের ফার্ষ্ট গার্ল। পড়াশুনা, গান শেখা, ছবি আঁকা, খেলাধুলায় বেশ পারদর্শি। বেশ সাহস ও আছে এক কথায় অলরাউন্ডার।
তাই ওর জানার আগ্রহটা সব সময়ই বেশি।

তাই আজ তার উল্টো হলোনা; বানর ও বেড়ালিকে জানতে তুলি বানরের মজার মজার কৌতুক ও বেড়ালের দুষ্টমিতে মন দিলো তার পর পরিচিত হলো। বানর ও বেড়ালী রাজকন্যের কথা খুলে বললো,
আজ স্কুল টিফিন টাইমেই ছুটি হয়েছে তাই বেশ কৌতুহল নিয়েই ওদের সাথে চললো। বাসার কড়া নাড়তেই রাজকন্যে বললো কি রে তোরা কোথায় ছিলে। বানর বললো আরে দেখো কাকে নিয়ে এসেছি। রাজকন্যেতো অবাক। ছোটবেলার বন্ধু তুলিকে দেখে। গলা জড়িয়ে ধরে বাসার ভিতরে ঢুকলো রাজকন্যে ও তুলি।
বানর আর কাঠবেড়ালি ছুটলো পিকনিকের উপাদান সংগ্রহ করার কাজে। বানর সংগ্রহ করলো গাছ থেকে সকল ধরনের মশলাদি। আর শহরের বিভিন্ন যায়গায় খেলা দেখিয়ে পেয়েছে পোলাউর চাল। আর  নানান পদের ফল যোগার করেছে জনাব কাঠবেড়ালি। দুজন একত্রিত হলো, এবার মাছ সংগ্রহ করার পালা।
দুজন বুদ্ধি পাকালো রাজকন্যের বাবার দিঘী থেকে  মাছ শিকার করবে এবং তাই করলো। সব নিয়ে হাজির হলো রাজকন্যের বাসায়, মজাদার রান্না করলো রাজকন্যে ও তুলি।
অতঃপর বসলো খাবার টেবিলে । খাচ্ছে আর মজার মজার স্মৃতি শোনাচ্ছে তুলি। হঠাৎ তুলির প্রশ্ন তোমরা মাছ কোথায় পেলে ; ওরা দুজন কোনো কথা বললোনা। এবার কর্কশ কন্ঠে রাজকন্যের জিজ্ঞাসা: অতঃপর খুলে বললো। তুলি বললো ; তোমরা কি জানো চুরি করা মহা অন্যায়।
বানর ও বেড়ালি বললো আমরা রাজার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে এই কাজ করেছি । কারণ তিনি রাজকন্যেকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলেন।
প্রজাপতি বললো ; তোমরা তাও জানো না, যে রাগ করে সে হারে। আসলে আল্লাহ যা করেন সবার ভালোর জন্যই করেন। সেদিন রাজকন্যেকে ঘর থেকে বের করে না দিলে আজকে আমাদের এই সুন্দর বন্ধুত্ব ও একসাথে  থাকা হতো না। কষ্ট কী তা উপলব্ধি করতে পারতাম না।  আমরা এভাবেই থাকতে চাই। তুলি বললো আসলে রাজামশাই তার ভুল বুঝতে পেরে  রাজকন্যেকে সারাদিন রাত হন্য হয়ে খুজে বেড়াচ্ছে।
এই কথা শুনে হাউমাউ করে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো রাজকন্যা।
কাঁদতে কাঁদতেই ঘুম ভাঙলো রাজ কন্যার ।
এভাবেই শেষ হলো রাজকন্যার স্বপ্নের রাত,,,, নিজেকে আবিস্কার করলো রাজমহলের পালংকের উপর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *