রাহুর কবলে বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতি

মাহমুদ ইউসুফ

রাহু শব্দটি সংস্কৃত ভাষা থেকে আগত। বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রণীত সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধানে এর অর্থ করা হয়েছে এভাবে- ১ অষ্টম গ্রহ। ২ পুরাণোক্ত যে অসুর গ্রহণকালে সূর্য বা চন্দ্রকে গ্রাস করে। ৩ পৌরাণিক অসুরবিশেষের ছিন্নমুন্ড। ৪ ধ্বংসকারী শত্রু; সর্বনাশসাধনকারী ব্যক্তি, রাহুগ্রস্ত ১। রাহু গ্রাস করেছে এমন। ২। বিপদগ্রস্ত; অত্যন্ত বিপন্ন; অসৎ লোকের কবলে পতিত। রাহুর দশা- ১ অত্যন্ত অশুভ সময়; ২ অত্যন্ত ক্ষতিকর ও জীবন সংশয়সূচক অবস্থা বা কাল। (আহমদ শরীফ সম্পাদিত সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান, দ্বিতীয় পুনর্মুদ্রণ-অক্টোবর ১৯৯১, পৃ-৪৯৭)।

উপরের প্রায় প্রত্যেকটি অর্থই বাংলাদেশের বর্তমান সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। জাতীয় সংস্কৃতি চরমভাবে বিপন্ন, বিপদগ্রস্ত। অশুভ শক্তির কবলে পড়ে সংস্কৃতি তার মূল অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। সাংস্কৃতিক অঙ্গন এমনভাবে নোংরা ও দূষিত হয়ে পড়ছে যে, সেখানে সভ্যতা, ভব্যতা, রুচি, মাধুর্য, নৈতিক মূল্যবোধ বলতে কিছুই নেই। আছে শুধু ভায়োলেন্স, পরকীয়া, নগ্নতা, যৌনতা, বস্তাপচা প্রেমের প্যানপ্যানানি, উঠতি বয়সী তরুণ তরুণীদের বালখিল্য, আর নাগরিক সমাজকে পৌত্তলিকতামুখী করার জোর প্রচেষ্টা। হাল আমলের সংগীত, নৃত্যকলা, নাটক, সিনেমা মানেই ইসলাম বিরোধীতা এবং রবীন্দ্র বন্দনা। পশ্চিম বাংলার কোনো বেতার, টিভি চ্যানেল তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও কাজী নজরুল ইসলাম বা কোনো মুসলমান সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যাবে না। অথচ বাংলাদেশের গণমাধ্যম মহাশে^তা দেবী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথদের নিয়ে অধিক ব্যস্ত। মিডিয়া ও সংস্কৃতির কলাকুশলীরা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ভারতমুখী করতে চাচ্ছে গোটা জাতিকে। মঙ্গল প্রদীপ, ভাই ফোঁটা, শাখা সিঁদুর, রাখি বন্ধনের রাজত্ব কায়েম করছে তারা। আল্লাহ কপাল সৃষ্টি করেছেন সিজদা করার জন্য। তার দরবারে মাথা নত করার জন্য। অথচ সেই কপালে উঠানো হচ্ছে টিপ, চন্দন, আলপনা, টিকিটি। মুসলিম সন্তানদের হিন্দুত্ববাদের সবক দেয়া হচ্ছে। আর অবিবেচক তরুণ সমাজও অতীত গৌরবকে ভুলে গিয়ে অবলীলায় পৌত্তলিকতার কৃষ্টি কালচার বরণ করছে হাসিমুখে। সংস্কৃতি অঙ্গনের পুরো চিত্রটাই বর্তমানে ভয়াবহ। অসৎ লোকের খপ্পড়ে পড়ে সংস্কৃতি অঙ্গন বিপথগামী। এর অধিপতি শ্রেণি মুসলিম জাতিসত্তার বিলোপ সাধন করে আর্য চানক্যবাদীদের ব্রাহ্মণ্যবাদী দর্শন প্রচারে অধিক মনোযোগী। ইসলামই তাদের একমাত্র প্রতিপক্ষ। আর ধর্মনিরপেক্ষতা বা ইহজাগতিকা, মার্কসবাদ, সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ, রবিন্দ্রবাদ, খ্রিস্টবাদ, ইহুদিবাদ, হিন্দুত্ববাদ, গান্ধীবাদ, ইন্ডিয়া ডকট্রিন, নেহেরু ডকট্রিন সবই তাদের স্বপক্ষশক্তি।

সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ছবি এর ছবির ফলাফল

বর্তমান দুনিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হলিউড হল চলচ্চিত্র শিল্পের কেন্দ্রভূমি। হলিউডে নির্মিত ছবিসমূহের মধ্যে ‘মেসেজ’ একটি অন্যতম সেরা ছবি। মোস্তফা আক্কাস পরিচালিত এই ছবিটির কেন্দ্রীয় চরিত্র হলেন মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। তাঁর জীবনের ওপর ভিত্তি করেই ছবিটি নির্মিত হয়। মার্কিন মুল্লুক খ্রিষ্টপ্রধান রাষ্ট্র। সেখানে মুহাম্মদ (সাঃ) এর ওপর মুভি নির্মিত হয়। দর্শক বিপুল আগ্রহ ভরে দেখেও থাকে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র বাংলাদেশে ইসলাম ও নবী রসুলদের ওপর কোনো নাটক, চলচ্চিত্র নির্মিত হয় না। নববর্ষ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, ভাষা আন্দোলনের ওপর, এমনকি বৈশাখী পূর্ণিমা, বড় দিন, জন্মাষ্টমী ও দুর্গাপূজার ওপরও নাটক নির্মাণ ও টিভি, মঞ্চে প্রদর্শিত হয়। এটা মহতী উদ্যোগ ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু মুসলমানদের কৃষ্টি কালচার নিয়ে কোনো নাটক, কোনো চলচ্চিত্র, তথ্যচিত্র বা প্রামাণ্যচিত্র তৈরি হয়না। আশুরা, সিরাতুন্নবী, লাইলাতুল মিরাজ, লাইলাতুল বারাত, রমযান ও ঈদ নিয়ে অদ্যাবধি কোনো নাটক বা ফিল্ম আলোর মুখ দেখেনি। কেউ কোনো উদ্যোগও গ্রহণ করেনি। অথচ রবিন্দ্র, বঙ্কিম, শরৎচন্দ্র, ইশ^রচন্দ্র, ইবসেনের ভুরি ভুরি নাটক বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ও মঞ্চে প্রদর্শিত হয়। তাঁদের জীবন জিন্দেগির নানা দিয়ে থাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা। সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা প্রমুখ ইতিহাসখ্যাত জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের নিয়েও নাটক চলচ্চিত্র, নাটক হচ্ছে। কিন্তু আবুবকর, উমার, উসমান, আলী, খালিদ, সালাহউদ্দিন, তারিক, মুসা, কাসিম, বখতিয়ার, আওরঙজেব, ইলিয়াস শাহ, আজম শাহ, ইশা খা, মুসা খা, মজনু শাহ, খাজা উসমান, রজব আলি, সিরাজদৌলা,  নজির  আহমদ,  আকরম খা,  জামালউদ্দিনদের নিয়ে কোনো নাটক হয় না, চলচ্চিত্র হয়না। দুর্ভাগ্য এ জাতির, দুর্ভাগ্য এ দেশের, দুর্ভাগ্য বাঙালি মুসলিম সমাজের।

বর্তমানে দেশের কয়েক ডজন টিভি চ্যানেল এবং বেশ কয়েকটি বেতার চ্যানেল রয়েছে। টেলিভিশন চ্যানেল বর্তমানে বিনোদনের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। ছোটো, বড়, ধনী, গরিব, মুসলমান, অমুসলমান, তরুণ, যুবা, বৃদ্ধ তথা সকল শ্রেণির মানুষ এ বিনোদনের অংশীদার। রেডিও, টিভি’র অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষের নৈতিক চরিত্রকে পরিশুদ্ধ করা সম্ভব। দুর্নীতি, অনিয়ম, সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, সুদ, ঘুষ, ছিনতাই, রাহাজানিতে দেশ আক্রান্ত। চারিত্রিক অধপতন যত বাড়ছে, অপরাধ প্রবণতাও তত বাড়ছে। ক্রাইম জগতকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে মানুষের নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে জাগ্রত ছাড়া বিকল্প পথ নেই। আইন করে অপরাধ, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা দূর করা অসম্ভব। একমাত্র আল্লাহভীতি ও পরকালে জবাবদিহিতাই পারে অসৎ কাজ থেকে মানুষকে দূরে রাখতে। এর বিকল্প ভাবার কোনো যৌক্তিকতা নেই। খোদাভীতি, অহির শিক্ষা ও নৈতিকতার উন্নতির মাধ্যমেই যেকোনো জাতিরাষ্ট্রকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা সম্ভব। রেডিও, টিভি হতে পারে এক্ষেত্রে প্রধান মাধ্যম। বিনোদনের উপকরণগুলোকে প্রেম, ভায়োলেন্স, মাজার পূজা, প্রতিকৃতি পূজা, ধর্মনিরপেক্ষতা বা ইহজাগতিকতা থেকে মুক্ত করতে পারলে এগুলো জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। নাটক, চলচ্চিত্র, সংগীত, নৃত্য, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, আলেখ্যানুষ্ঠান, টকশোগুলোকে আদর্শ চরিত্র গঠনের হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। আর তাহলেই দেশ তার কাঙ্খিত লক্ষ্যস্তরে পৌঁছতে সক্ষম হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *