সোনালী অতীত

কামরুন নাহার আঁখি

প্রিয় তুমি

আজ একটা গল্প বলি তোমায়… আমার ছোট বেলার গল্প….. আমার ভালোলাগা ভালোবাসার গল্প…. ভালোলাগা দিন গুলো যখন বর্তমান… তখন সেগুলো … পরিতৃপ্ত সুখ, যখন লিপিবদ্ধ কাগজে, তখন… সাহিত্য, আর যখন পুরাতন… তখন সোনালী অতীত! সোনায় বাঁধানো এই অতীত গুলো আমাদেরকে বাঁচতে শেখায়, শেখায় স্বপ্ন দেখতে, সবাই বলে… ফেলে এসেছি ছোট বেলাটা, আবার…. যদি ফিরে পেতাম! কিন্তু আসলেই কি ফেলে এসেছি? নাকি সাথে করেই নিয়ে চলেছি সোনালী সে দিন গুলো!

যদি ফেলেই আসবো… তবে আজও কেন ঝুম বৃষ্টিতে দোস্যিপনায় মাতি ? শিশুর সাথে অবুঝ হই ! ফুলের দামে বিকিয়ে যাই ! প্রজাতির পেছন ছুটি, জোনাকির ঐ মৃদু আলোয় রুপকথাতে হারিয়ে যাই ! বলার মতো অনেক গল্প আছে ছোট বেলার, তারই একটি অধ্যায় বলছি… তোমায় –

তখন আমি স্কুলে পড়ি, একটা টিয়া পাখির সাথে আমার বন্ধুত্ব ছিল, ওকে নিয়ে আমার অনেকটা সময় কাটতো! সব ছেলে মেয়েরা যখন পুতুল খেলায় ব্যাস্ত আমি তখন পাখিটা নিয়ে ছাঁদে । পাখি টা ছিল আমার এক প্রতিবেশীর, বাড়ির সবাই ওকে খুব ভালোবাসতো, আর ও আমাকে। ভাবছো- বাড়িয়ে বলছি ? মোটেও না, ও আমার জন্য ই খাঁচার শিক কাটতো, স্কুল থেকে ফিরে যখনি শুনতাম পাখিটি পালিয়েছে তখনি চলে যেতাম ছাঁদে কয়েক বার আঁখি নামে ডাকতেই ও নেমে আসতো, ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কতো কথা যে কইতাম ওর সাথে…. তার ঠিক নেই , এগুলো অবশ্য দুই এক দিনে বা খুব সহজে হয়নি, আমার তর্জনী ও বৃদ্ধা আঙ্গুলীকে বহু মুল্য দিতে হয়েছে এর জন্যে, কতোবার যে ওর ধারালো ঠোঁটে রক্তাক্ত হয়েছে আমার হাত তার গোনা গাথা নাই, আমার নামটা ওর খুব পছন্দের ছিল, আমাকে দেখলেই নাম ধরে ডাকতো বার বার, তাই বাড়ির সবাই ওই নামেই ওকে ডাকা শুরু করলো! আমার নামের একটা অংশীদার তৈরী হলো, তাতে অবশ্য আমার কোন দুঃখ নেই বরং এক ধরনের ভালোলাগা ই ছিল, তখন থেকে আমরা দুজন মিতা হলাম ।

ঐটুকু বয়সে হাতে একটা টিয়া নিয়ে রাস্তা ঘাটে ঘুরে বেড়াই.. আর আমার পিছু পিছু সমবয়সী বহু কৌতুহলী চোখ, নিজেকে বিশাল একটা কিছু মনে হতো, হ্যামিলনের বাশিওয়ালার মতো আমি হাটছি পাখি নিয়ে….. আর পিছনে এক ঝাঁক নতুন কুঁড়ির দল। সেখানে সকল দৃষ্টির কেন্দ্র বিন্দু… দুই আঁখি। তবে ওর সাথে একলা সময় টাই বেশি ভালো কাটতো আমার, যখন ছাঁদে বসতাম পাখিটা নিয়ে…. ওকে দেখে হয়তো…. কৌতুহলী হয়ে আরো কিছু পাখি নামতো ছাঁদে, দোয়েল, বুলবুলি, চড়ুই, ফিঙে কখনো মাছরাঙা। পাখিগুলো আমাকে যে মোটেও ভয় পেতো না সেটা ওদের আচরণে বোঝা যেত, টিয়া টা আমার কোলে আর ওরা সবাই অনেকটা কাছাকাছি ই ঘোরাঘুরি করতো, সন্ধায় যখন পাখিটি কে খাঁচায় রাখতে যেতাম… বুঝতাম ও খাঁচায় যেতে চায় না, তখন থেকেই খাঁচায় পাখি রাখাটা আমার অপছন্দ। এভাবেই অনেকগুলো ভালো সময় কাটলো ওর সাথে। কিছুদিন পরপর ওর শিক কেটে পালানো আর আমার ওকে নিয়ে সময় কাটানো এটা একটা রুটিন হয়ে গিয়েছিল। আমাদের মাঝে মান অভিমান ও চলতো কখনো কখনো, আমার মনে হতো ও আমার সব কথা বুঝতে পারে, আমিও হয়তো কিছুটা বুঝতাম ওকে, তখন ও আমার এক মাত্র বন্ধু। একদিন স্কুল থেকে ফিরে শুনি ও পালিয়েছে, আমি তো মহাখুশি!! এক দৌড়ে ছাঁদে গিয়ে উঠলাম, ডাকলাম বহুক্ষণ কিন্তু ও নামলো না, অথচ কখনো এমনটা হয়না, ও আশেপাশের কোন একটা গাছে থাকে, আমি ডাকলেই নেমে আসে নিচে, সেদিন একটা শিশও শোনা গেলো না, বাড়ির কেউ এটা নিয়ে মাথা ঘামায় নি, সবার ধারণা… সন্ধায় ঠিক ফিরে আসবে, আমার মনে ভয়, আমি তো জানি… ও সারাবেলা আমার সাথে থাকে, সেদিন ও আর ফিরলো না ,পরের দিনও না, আর কখনোই না।

কেঁদেছিলাম খুব, আজও ওকে স্বপ্নে দেখি মাঝে মাঝে। অনেক পরে জানতে পেরেছিলাম- ওকে কেউ ধরে সেই দিনেই অন্য কোথাও বিক্রি করেছিল, অথচ অনেকগুলো দিন আমরা প্রতিক্ষা করতাম ওর জন্য, এলাকায় এমন কোন গাছ ছিলো না যেখানে ওকে খোজা হয়নি, ওর শূন্য খাঁচাটায় আর কখনো কোন পাখি রাখা হয়নি তারপর। আমি আমার কবুতরগুলোকে খাঁচায় বাধিনা ওরা মুক্ত আকাশে ওড়ে, আমার বানিয়ে দেয়া বাসায় দোয়েলের চারটি বাচ্চা হয়েছে, ওরাও স্বাধীন, আজও চড়ুইদের দল আমাকে উপেক্ষা করে কবুতরের খাবারে ভাগ বসায়, ওদেরকেও খুব ভালোবাসি, তবু- কোথায় যেন একটা শূন্যতা । ঘরে না ফেরা সেই পাখিটির জন্য! সে আমার উজ্জ্বল সোনালী অতীত হয়ে আমাতেই করে বাস। ইতি টানছি এখানেই… ভালো থেকো!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *