মাহমুদ ইউসুফ
সমাজ সভ্যতার অগ্রযাত্রায় সুশিক্ষা প্রধান সহায়। সমাজ রাষ্ট্র ব্যবস্থার সুনিয়ন্ত্রণ এবং শান্তি আনয়ন করতে নৈতিকতার বিকল্প নেই। আর নৈতিকতা ও সুনাগরিক সৃষ্টির একমাত্র অবলম্বন ধর্মশিক্ষা। দীনের ইলম না থাকলে সেখানে মূল্যবোধ পয়দা হয় না। ধর্মশিক্ষা মূলধর্মগ্রন্থ থেকেই নেয়া বাঞ্ছনীয়। মূলকিতাব বাদ দিয়ে অন্যকোন উৎস থেকে ধর্মবিদ্যা গ্রহণ করলে সেখানে নকল প্রবণতা বা মেকি শিক্ষা থাকাই স্বাভাবিক। ইসলামের প্রধান ধর্মপুস্তক হলো আল কুরআন ও মহানবি স. এর সুন্নাহ বা আল হাদিস। এ দুটি কিতাবের উৎস হলো অহি বা লাওহে মাহফুজ। কুরআন ও হাদিস ছাড়া ইসলাম চর্চার সুযোগ সীমিত। আর কুরআন হাদিস কেবল মুসলমানদের জন্য নয়। সব মানুষের।
পবিত্র কুরআনুল হাকিমে এরশাদ হয়েছে, ‘আল কুরআন তো দুনিয়ার সকল নাগরিকের জন্য নসিহত বৈ আর কিছু নয়।’ (সুরা কালাম: আয়াত ৫২, সুরা তাকবির: আয়াত ২৭) ইহা সমগ্র মানব কওমের জন্যে অবতীর্ণ (সুরা বাকারা ১৮৫, সুরা ইউসুফ ১০৪)। মুসলিম, খ্রিস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি, নাস্তিক, শিখ, জৈন, মুরতাদ, ধর্মনিরপেক্ষবাদী, মার্কসবাদী, রবীন্দ্রপুজারী, গান্ধীপুজারি, কমিউনিস্ট, তাওবাদী, সাম্যবাদী, ধর্মহীন, ধর্মপ্রিয়, প্রকৃতি পূজারি, মূতি-প্রতিমা পূজারি, অগ্নিউপাসক, কুনফুসিয়াসধর্মী তথা সকল ইনসান কওমের জন্য আল কুরআন। তাই কুরআন শুধু ইমানদার বা অযুকারীদের জন্য নয়। বেইমান বা অযুহীনদের জন্যও কুরআন। তদ্রুপ ইসলাম কেবল মুসলিমদের দীন নয়। ইহা সকল জিন-ইনসানের দীন। শুধু তাই নয়, আল্লাহর রসুল স. এর সব মানুষের নবি। যাঁর সম্পর্কে স্রষ্টা নিজেই বলেন, ‘আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্যে রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া : ১০৭)। তিনি ছিলেন কূল কায়নাতের জন্য রহমত বা অনুকম্পা। শুধু মানবজাতি নয়, বরং জিনজাতি সহ সকল সৃষ্টির প্রতি রহমত হয়ে এই ধরাধামে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
অতএব, কুরআন, হাদিস, মহানবি স. এর শিক্ষা সকল মানুষের, সকল জাতির, সকল দেশের জন্য প্রযোজ্য। এ দুটি কিতাবের শিক্ষা মানবকে মহৎ করে, মহিয়ান করে, মহামানবে রূপান্তরিত করে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘উমর ফারুক’ কবিতায় যথার্থই বলেছেন, ‘ইসলাম – সে তো পরশ-মানিক তাকে কে পেয়েছে খুঁজি?/পরশে তাহার সোনা হল যারা তাদেরেই মোরা বুঝি।’ জাজিরাতুল আরবের বর্বর বেদুইনরা সেদিন ‘ইসলাম’ নামক পরশ পাথরের সংস্পর্শে সোনার মানুষ হিসেবে বিশ্বে খ্যাতি লাভ করে।
আদর্শ চরিত্র, আদর্শ মানুষ, আদর্শ নাগরিক, আদর্শ পরিবার, আদর্শ সমাজ, আদর্শ রাষ্ট্র গড়তে হলে অবশ্যই কুরআন-হাদিসের শিক্ষা দরকার। সত্যিকার সৎ নাগরিক বানাতে নৈতিক শিক্ষা অপরিহার্য। ধর্মবিদ্যাই বদলে দেয় মানুষকে। অন্যথায় সে পাশবিক হতে বাধ্য। নেমে যেতে পারে পশু থেকে নিম্নস্তরে।
নামজাদা মনীষী ও দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে, If you give there ‘R’ sie reading, writing and arithmetic and do not give the fourth ‘R’ i e religion they are sure to became the fifth ‘R’ ‘i’ ‘e’ rascal. অর্থাৎ আপনি শিক্ষার্থীকে কেবল পঠন, লিখন ও অঙ্ক কষা শেখালেন কিন্তু ধর্ম শেখালেন না তাহলে সে দুষ্ট হতে বাধ্য। এ কারণেই আলবার্ট সিজারও শিক্ষা ব্যবস্থায় আধ্যাত্মিকতার উপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ Three kinds of progress are significant : progress in knowledge and technology, progress in socialization of man and progress in spirituality. The last one is most important.
আজ আমাদের উচ্চ পর্যায়ের শিক্ষাঙ্গণের অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী বার্ট্রান্ড রাসেল বর্ণিত Fifth R i e rascal- এর শিকার। আর এ অবস্থায় ঢালাওভাবে শিক্ষার্থীদের দোষী করা যায় না। ধর্মহীন শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থায় ত্রুটি, শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান প্রচারে প্রচার মাধ্যমগুলোর ব্যর্থতা কম দায়ী নয়। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে অনেক শিক্ষক আছেন যারা ক্লাশে পাঠদানের মাঝে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ধর্মহীনতার তালিম দেন, ‘স্রষ্টা বলতে কিছু নেই’ এই ধারণা প্রদান করে থাকেন। আর এ কারণেই শিক্ষার্থীদের মাঝে জবাবদিহিতার অনুভূতি থাকে না। তারা নিজেদেরকে স্বাধীন ও বন্ধনহীন মনে করে যে কোন পাপ কর্মে প্রবৃত্ত হতে কুণ্ঠাবোধ করে না। (দৈনিক ইনকিলাব, ২১ জুলাই ২০১৭, পৃ ১১)
মুসলিম শাসনামল (১২০১-১৭৫৭) তথা সুলতানি ও নবাবি আমলে বাঙলাদেশে কুরআনিক শিক্ষাই ছিলো মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থা। কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যিক যুগে দীনি শিক্ষা মুক্ত পাশ্চাত্য ধাচে সেকুলার শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়। সাম্রাজ্যবাদীদের প্রয়োজনে প্রণীত সেই ঔপনিবেশিক শিক্ষাকাঠামো ছিলো এদেশিয় কৃষ্টিকালচার বহির্ভূত। তাছাড়া ব্রিটিশরা তাদের অনুগত শ্রেণি তৈরি করতেই সেই শিক্ষানীতি চালু করে। ইংরেজ মন মগজ তৈরি করতেই ছিলো ওই এডুকেশন সিস্টেমের মূল লক্ষ্য।
ভারতের গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিংক (১৭৭৪-১৮৩৯) ১৯৩৫ সালের ৭ ই মার্চ প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন, ‘শিক্ষার উদ্দেশ্যে যে অর্থ আলাদা করে রাখা হয়েছে, তার একমাত্র সার্থক নিয়োজন হবে ইংরেজি শিক্ষাতে।’ এরপূর্বে ১০ ই ফেব্রুয়ারি ১৯৩৫ কলকাতার গণ্যমান্য বর্ণহিন্দুরা অবিলম্বে ফার্সির বদলে ইংরেজিকে সরকারি ভাষা করার দাবিতে ভারতের ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে এক গণদরখাস্ত দাখিল করে। এই দরখাস্তে রাধাকান্ত ব্যানার্জি, প্রশান্ত কুমার ঠাকুরসহ মোট ৬,৯৪৭ জন হিন্দু নাগরিকের দস্তখত ছিলো।
এভাবেই ভারতবর্ষে ইংরেজি ভাষা ও পাশ্চাত্য শিক্ষা চালু হয়। এই শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে লর্ড বেন্টিংকের আইন উপদেষ্টা টমাস বেবিংটন মেকলে (১৮০০-১৮৫৯) ‘নেটিভদের’ মাঝ থেকে একটি সমর্থক গোষ্ঠী সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৮৩৪ সালে এ মর্মে ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন যে, এদেশে এমন এক শ্রেণি বানানো দরকার ‘‘যার বর্ণ এবং রক্ত ভারতীয়দের, কিন্তু রুচি, অভিমত, নীতিবোধ এবং বুদ্ধিশীলতা ইংরেজের।’’ (এম আর আখতার মুকুল: কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী, পৃ ১৩৫, ১৮৯)
১৮৩৬ সালে মহারানি ভিক্টোরিয়া ইংল্যান্ডের সিংহাসনে আরোহন করেন। সে সময় ভারতে পাশ্চাত্য প্রণালীর শিক্ষা প্রবর্তন নিয়ে কমন সভায় ব্যাপক আলোচনা হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গ্লাডস্টোন একখানি বই হাতে নিয়ে কমনসভায় গিয়ে পবিত্র গ্রন্থখানি উঁচু করে ধরে বলেছিলেন, ‘এটা মুসলমানদের আল কুরআন। ব্রিটিশেরা বর্তমানে অনেকগুলো মুসলিম দেশ দখল করে নিয়েছে। যদি এই দেশগুলোর ওপর বিনা বাঁধায় ব্রিটিশদের আধিপত্য বজায় রাখতে চায় তাহলে এই কুরআন শিক্ষা থেকে পরিকল্পিতভাবে মুসলমানদের দূরে সরিয়ে রাখতে হবে।’ (সরকার শাহাবুদ্দীন আহমদ: আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল প্রথম খ-, পৃ ৫১৮) অতএব দেখা যায় বিগত দুশ বছর যতসব শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে সবই শিক্ষার্থীদের কুরআন থেকে দূরে রাখার প্রয়াস। এই ইসলাম বিমুখ শিক্ষা আহরণ করে ছাত্র-ছাত্রীরা অনৈতিকতা ও ভোগবাদিতার অতল সাগরে হারিয়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৪০টির মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। তাছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত শতাধিক কলেজে রয়েছে চার বছর মেয়াদি সম্মান পড়ার সুযোগ। একমাত্র কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ^বিদ্যালয় ছাড়া অন্যকোন প্রতিষ্ঠানে কুরআন হাদিসে অনার্স মাস্টার্স পড়ার সুযোগ নাই। মেডিকেল, বুয়েট বা কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা বাদই দিলাম। সাধারণ শিক্ষায়ই কুরআন হাদিস শিক্ষার এই দূরাবস্থা। অথচ বাংলাদেশ দুনিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম।
আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস শিক্ষাব্যবস্থায় কুরআন হাদিস থাকলে দেশে সৎ লোকদের এত ঘাটতি হতো না। ধর্মব্যবসা, কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি, ধর্মান্ধতারও পয়দা হতো না- মানব হৃদয়ে থাকত যদি আল কুরআনের আলো। তাই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষা অতীব জরুরি। অহির শিক্ষা দ্বারাই সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে ঘুষ, দুর্নীতি, সুদ, স্বেচ্ছাচারিতা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, প্রতারণা, দুশমনি, বদামায়েশি, হিংসা, বিদ্বেষ, উৎপীড়ন, হীনপ্রতিদ্বন্দ্বিতা, কপটতা, ধর্ষন, ব্যভিচার, লুটতরাজ, জুলুম, নিপীড়ন, জঙ্গিবাদ, সহিংসতা, বোমাবাজি, অস্ত্রবাজি, মাদকতা, নেশা নির্মূল সম্ভব। এজন্য সবার আগে দরকার কুরআন ও হাদিস পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা। বিশেষ করে অনার্স লেভেলে বা সম্মান শ্রেণিতে আল কুরআন ও আল হাদিস বিষয়ভুক্তি। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং অনার্স কলেজসমূহে সর্বাগ্রে এর সূচনা করতে পারে।
আল কুরআনে ৩০টি পারা, ৫৪০টি রুক এবং ১১৪টি সুরা আছে। চার বছরের সম্মান কোর্সে কুরআনের সম্পূর্ণ তরযমা ও তাফসির শেষ করা যেতে পারে। ৩০ পারাকে চার বছরে ভাগ করে সিলেবাসভুক্ত করা যেতে পারে। যেমন- প্রথম তিন বছরের প্রতিবর্ষে ৭ পারা করে ২১ পারা এবং শেষবর্ষে ৯ পারা পাঠ্যভুক্তকরণ। অথবা ১০ পারা করে প্রথম তিনবর্ষে সম্পূর্ণ কুরআনের সমাপ্ত করে চতুর্থ বর্ষে তাফসিরের ওপর রিভাইস দেয়া যেতে পারে। এর সাথে তাফসির শাস্ত্রের ইতিহাস, গুরুত্ব, বিভিন্ন তাফসিরকারক বা মুফাসসিরদের ইতিকাহিনি তো থাকবেই। আল হাদিস বিষয়ে চারবছরের অনার্সকোর্সে হাদিস সংকলনের ইতিহাস, সাহাবি-তাবে তাবেইনদের ইতিকথা এবং সিহাহ সিত্তাহর হাদিসশাস্ত্রসহ অন্যান্য হাদিসশাস্ত্রসমূহ সিলেবাসভুক্ত করা যেতে পারে। সর্বোপরি কুরআন-হাদিস বিষয়ে বিজ্ঞ ইসলামিক স্কলারদের মতামত অবশ্যই গ্রহণীয়।
হদিস:
১। এম আর আখতার মুকুল: কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী, সাগর পাবলিশার্স, জিপিও বক্স ৩০৫৭ ঢাকা, প্রথম মুদ্রণ: ১৪ই ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭
২। মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান: শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মহীনতার তালিম, দৈনিক ইনকিলাব, ২/১ রামকৃষ্ণ মিশন রোড ঢাকা ১২০৩, ২১ জুলাই ২০১৭ ইসায়ি
৩। সরকার শাহাবুদ্দীন আহমদ: আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল [প্রথম খ-], বুকস ফেয়ার, ৩৯ বাংলাবাজার ঢাকা ১১০০, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০৪
৪। নজরুল রচনাবলি তৃতীয় খণ্ড-, বাংলা একাডেমি ঢাকা ১০০০
৪ বছরের কোর্সে প্রতি বছরে ৭ পারা নিয়ে একটি বিষয়, সাথে চারটি তাফসির দিয়ে মোট পাচটি বিষয় থাকা উচিত।
এবং প্রতি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কোরআন হাদিস গবেষনা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা উচিৎ।
hello everyone