অস্তিত্বে বৈশাখ

নীলা আহমেদ ।।

দোয়েল, শ্যামা, শালিক, চড়ুই, বুলবুলির কিচিরমিচির সম্মোহনে মনে যেনো এক অচেনা সুর খেলে গেলো। জেগে উঠতেই উদাস হাওয়ার শীতল স্পর্শে প্রাণ ভরে যায়। খালি পায়ে শিশির ধোয়া ঘাসের নরম কার্পেটে হাঁটার মজাই আলাদা। ঘাসের বুক থেকে টপটপ করে ঝরে পড়া শিশিরে আলতো করে পা ধুলে হৃদয়ে অপূর্ব শিহরণ জাগে। এ ভালো লাগা ইট কংক্রিটের দেয়ালবাসী কখনও বুঝতে পারবেনা।

ভোরবেলা না জাগলে স্রষ্টার এ অপার স্বর্গীয় সৃষ্টির যে কতো বৈচিত্র্য যা কিছুতেই উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কী যে মুগ্ধতা! শান্তির পরশ প্রাণে দোলা দেয়! যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ গালিচা সবুজের স্বর্গ। জ্ঞানী ব্যক্তিরা তাই বলেছেন ‘প্রকৃতির সবুজকে যে যতো বেশি দেখতে পারবে তার চোখের জ্যোতি ততই স্বচ্ছ থাকবে’।

হঠাৎ ঘুঘুর ঘুক গু ঘুক গু ডাকে শিরিষ চূড়ায় চোখ পড়তেই দেখি সাদা আর গোলাপি রঙের রেশমি সুতায় কে যেনো ছোটা ছোটো ফুল বুনে রেখেছে সবুজ পাতার ভেতরে। ফুলের মিষ্টি গন্ধে বুক ভরে কিছুটা শান্তির শ্বাস নিলাম। মৌ মৌ করছে সবুজ বৃক্ষ বেষ্টিত পুরো বাগান।

হঠাৎ মনে পড়ল এপ্রিলের ১৪ তারিখের কথা, মানে বাংলা নববর্ষ? নিমিষেই হারিয়ে গেলাম বহুদিনের ফেলে আসা অবাধ দুষ্ট মিষ্টি সোনালী শৈশবে। ‘বৈশাখ ‘ মানেই রোমাঞ্চকর শিহরণ, হরেক রকম ভর্তা আর পান্তা মাখানো ভোজনরসিক বাঙালির চিরঅমৃত ভাজা ইলিশ। কাঁচা পেঁয়াজ আর ইলিশ ভাজা মনে হলেই জিবে জল চলে আসে। পাড়ায় পাড়ায় আনন্দের ঢেউ যেনো উছলে উঠে। গ্রামের মেয়ে বউদের কোমল হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় ভাঙা ঘরগুলোও চকচকে হয়ে ওঠে। ঘরের সমস্ত আসবাবপত্রের পুরনো ময়লা ধুয়ে মুছে বছরের নতুনত্বকে সাদরে বরণ করতে প্রস্তুত সবাই।

নানি দাদীরা বলতেন বছরের প্রথম দিনে ভালো খাবার খেলে ভালো পোশাক পড়লে সারা বছরই ভালো কাটানো যায়। তাই খাল বিল পুকুরে সবাই মিলে একত্রে বড় মাছ ধরার আনন্দে মাতোয়ারা হতো। মা বাবা সন্তানদের সাধ্যমতো পোশাক অথবা খেলনায় খুশি রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চলতো। খাবার তালিকায় সকালে পান্তা ইলিশ আর দুপুরে মাছ মাংসের পরে থাকতো দই মিষ্টি, সন্দেশ, বাতাসা, মুড়কি, চমচম আরো নানারকম মিষ্টান্ন।

সবাই এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ীতে নানারকম ভর্তা আর দই মিষ্টি লেনাদেনা করতো। মেয়ে বউরা মেহেদীতে হাত রাঙাতো সাথে নানানরকম সুগন্ধি বেটে চুলে লাগাতো ওসবের ঘ্রাণে পুরো গ্রামে যেনো আনন্দের রোল পড়ে যেতো। অনেক বাড়িতে আবার কাঁচা কাঁঠালের সাথে নানারকম সবজি দিয়ে পাঁচন রান্না করে বেশ পরিতৃপ্তির সঙ্গে ভোজন সাঙ্গ করতো।

আমাদের গ্রাম থেকে ৯ কিলোমিটার অদূরে ‘বৌ বাজার’ নামক ছোট্ট একটি বাজারে প্রত্যেক বৈশাখে মেলা বসতো। গ্রামের সর্বস্তরের জনগনের মিলনসেতু ছিল সেই ‘বৌ বাজার’। গ্রামের অন্যান্য ছেলে মেয়েরা পায়ে হেটে গেলেও আমি, বিনু, হাসি পল্টু বড় ভাই, মেঝো ভাই এরা সবাই রিক্সায় চড়ে হৈচৈ রবে পাড়াসুদ্ধ মাথায় তুলে তারপর মেলাস্থলে পৌঁছতাম। নানা ছিলেন স্বচ্ছল পরিবারেরই একজন তাই নিজেদের ব্যক্তিগত রিক্সায়ই যাতায়াত করতাম। মেলা চলতো বিকেল ৪ টা থেকে রাত ৮ টা অবধি।

স্কুলে টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে তা দিয়ে যে যার পছন্দসই মাটির হাঁড়ি কলসি, বাহারি রঙের বেলুন, হাতি, ঘোড়া, জড়ি ফিতেয় মোড়ানো বাঁশের বাঁশী, পুঁতির মালা, কাঁচের চুরি ইত্যাদি কিনতো। এসব যদি না কিনতে পারা যায় তো কিসের বৈশাখ? এক বৃদ্ধ হিন্দু বিধবা ঢালা ভর্তি টক মিষ্টি দই  ও ফল বিক্রি করতেন- আমরা খুব মজা করে ওগুলো খেতাম, বাড়ির জন্যও নিয়ে আসতাম। চিনি মাখানো বাতাসা, একটাকা পিচের কাটা তরমুজ আরো নানারকম খাবারের সন্নিবেশ ছিল। শিবু ঘোষালের ঢাকের শব্দে মোহিত ছিল পুরো মেলা স্পট। মাঠের এক কোণে দুটো সাদা ঘোড়া বাধা থাকতো ১০ টাকায় টিকিট কেটে সবাই ঘোড়ার পিঠে চড়তো। ঘোড়ার পিঠে চড়লে কিছুটা ভয় আর আনন্দ একসাথে খেলতো। ভয়কে জয় করে যখন ছুটতে পারতাম নিজেকে বীরাঙ্গনা মনে হতো।

মেলাতে লক্ষ্যভেদ করে পছন্দের পুরস্কার জেতার খেলা চলতো। গোল করে পাকানো বেতের চুরি আর কিছু দূরত্বে সাজানো থাকতো খেলনাসহ বিভিন্ন কসমেটিকস। নির্দিষ্ট দূরত্বে দাঁড়িয়ে সাজানো জিনিসপত্রের ওপর বেতের চুরি লাগাতে পারলে উচ্ছ্বাসের শেষ থাকতোনা, আর না পারলে ১০ টাকা তো গেলোই। বুকভরা আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরতাম আর সপ্তাহ জুড়ে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের সুখস্মৃতি চোখের সামনে ভাসতো।

একবার বড় আর মেঝো ষড়যন্ত্র করে আমাকে মেলায় নেয়নি আমিতো কেঁদে সাড়া। এতো আনন্দের লোভ সামলাতে না পেরে গ্রামের অন্যান্য ছেলে মেয়ের সাথে উদভ্রান্তের মতো ছুটে কি করে যে এতো পথ পার হয়ে মেলায় গেলাম ভাবতেই হাসি পায়। দুই ভাইয়ের ভয়ে ওদের দলের পেছনে থেকে চোরের মতো সবকিছু দেখলাম। ফিরতে রাত হলো পথিমধ্যে মাথা কাটার মোড়ে এসে গা ছমছমে ভুতুড়ে অন্ধকারে পুটির গলা জড়িয়ে ধরলাম। যেই পুটির শরীরের দুর্গন্ধে কেউ কাছে আসেনা নিরুপায় হয়ে সব ভুলে গেলাম। পুটি মনে সাহস না জোগালে সেদিন হয়তো খারাপ কিছু হয়ে যেতো। শৈশবের সেই পুটি এখন কোথায় কেমন আছে জানিনা যদি তাকে সামনে পেতাম প্রাণভরে কৃতজ্ঞতা জানাতাম।

ছেলেবেলার ছোট্ট মধুর সুখ স্মৃতি আজও হৃদয় দুয়ারে একটি দিনে আনন্দ বেদনার ঘন্টা বাজিয়ে চলে। এই দিনে বৈশাখী হাওয়া আসে নতুনের বারতা নিয়ে রঙে রঙে ছেয়ে যায় বাঙালির নতুন পৃথিবী। সেই মুড়কি বাতাসা, মতিদাসের দোকানের সন্দেশের স্বাদ যেনো আজও মুখে লেগে আছে। পবিত্র মাহে রমজানের এই শুভক্ষণে, করোনাকালীন দুঃসহ নির্বাসনে বৈশাখ হোক সুষ্ঠু চেতনা ও সংস্কারের ধারক, মানব মনের মুক্তচিন্তার দ্বার উন্মুক্ত করে সুখের অনাবিল শান্তির বারতা নিয়ে শুরু হোক বাঙালির প্রতিটি সকাল।

Next Barisal banner ads

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *